রতন মাথাটা গোঁসাইয়ের কাঁধ থেকে তুলে গোঁসাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বলতে পারবে না? তবে কিসের সাধু হলে তুমি? তারপর? মোবাইলে 'চাঁদের উদয়' পড়তে হলে স্ক্রল করুন নিচে...

চাঁদের উদয়

গোঁসাই বলল, শরীরের পিছনে মন হাঁটে, না মনের পিছনে শরীর?

রতন বিড়ি ফেলে বলল, ওই হল। দুই আছে। কখনও এ আগে, কখনও সে।

গোঁসাই বলল, আজ থাকবি?

রতন বলল, টোটো দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি। এই যে কমলা। প্রণাম কর।

কমলা প্রণাম করল। গোঁসাই বলল, বেশ বেশ।

রতন বলল, নতুন।

গোঁসাই হাসল, বলল, মানুষ তো রোজই নতুন। পুরোনো বলে কিছু থাকলে সে মনের আবর্জনা। জমাস না। ফেলে দে। যত জমাবি তত ভারী হবি।

রতন উদাস হয়ে ডুবে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে। সূর্যের রঙ গঙ্গার জলে গুলে যাচ্ছে দেখছে। আশ্রমে এলে এই গঙ্গার ধারটা ভীষণ প্রিয় রতনের। রতন নিজেকে এই সন্ধ্যের মধ্যে খুঁজে পায়। যেমন এ সময়টা দিন রাত্রি কিছুই না, সেও তেমন, না পুরুষ, না নারী।

গোঁসাই কোথাও গিয়েছে। কমলা ঘাটের শেষ সিঁড়িটায় নেমে দাঁড়িয়ে আছে। অল্প অল্প দুলছে। মানে গান গাইছে। মন ভালো আছে তবে। রতনের মন ভালো হয় না। কিছুতেই হয় না। গোঁসাইয়ের কাছে এলে শান্ত হয়। তবে ভালো হয় না। আগে এমন ছিল না। আগে মানুষকে কাউকে কাউকে সন্দেহ করত। এখন কাউকে বিশ্বাস করে না। এখন জমাট বাঁধা অবিশ্বাস বুকে।

গোঁসাই এলো। রতনের পাশে বসল। রতন গোঁসাইয়ের মুখের দিকে তাকালো। কাজল বেয়ে মোটা জলের বিন্দু নামল গাল গড়িয়ে কাজল ঘেঁটে। রতন গোঁসাইয়ের কাঁধে মাথা রাখল।

গঙ্গার জলের আওয়াজ। কবে থেকে হয়েই যাচ্ছে। সে যখন থাকবে না, গোঁসাই যখন থাকবে না, কমলা যখন থাকবে না… তখনও এই আওয়াজ হয়েই যাবে।

রতন বলল, গোঁসাই আমি কবে মরব?

গোঁসাই বলল, তাড়া কিসের রে এত?

রতন মাথাটা গোঁসাইয়ের কাঁধ থেকে তুলে গোঁসাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বলতে পারবে না? তবে কিসের সাধু হলে তুমি? আমাদের গ্রামে এক সাধু ছিল, সবার মরার দিনক্ষণ এক্কেবারে বলে দিত। তবে কেউ মরত না সেই হিসাবে সে আলাদা কথা….

গোঁসাই আর রতন দু’জনেই হেসে উঠল। গোঁসাই বলল, বেশ সাধু বটে… নিদান হাঁকা সাধু…, বলেই আবার হাসল দু’জনে…

রতনের হাসতে গেলে বুকের ভিতর দম ফুরিয়ে যায়। হাওয়া শেষ হয়ে যায়। বুকটা যেন বদ্ধ গুদামঘর।

রতন বলল, গোঁসাই, আমি ভালো হলাম না কেন?

গোঁসাই, রতনের হাতের উপর হাত রাখল। বলল, এতো ভাবিস কেন রে? এতটা পথ পেরিয়ে এলি, এত কিছু সইলি? তবু এত এত ভাবনা কেন তোর? তোর ভাবনার সঙ্গে ভবের মিল পেলি কতটা?

গোঁসাইয়ের আঙুলগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে রতন বলল, আর মিল…. তবে মনের মধ্যে এ ভাবনাগুলো ভাবায় কে? তোমার গোবিন্দ?

গোঁসাই বলল, ভাবনা ঢেউয়ের মত। এই যে ঢেউয়ের পরে ঢেউ আসছে যাচ্ছে, তুই পারবি এগুলো গুনে রাখতে? এদের ধরে রাখতে? সেরকমই ভাবনা নিয়ে ভাবিস না এত রে… ভাবনাকে ভাবনার মত ছেড়ে দে… তুই দেখ তোর ভাব জগতে চাঁদের উদয় হল কিনা…. চাঁদ খোঁজ…. শীতল হ…

গ্রহণ গোঁসাই… চাঁদ আর বেরোবে না….

গোঁসাই কমলার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, এই যে তুই বললি ও নতুন…. ওর মনেও গ্রহণ লাগাবি?

রতন হঠাৎ চমকে গিয়ে বলল, এ কথা কেন বলছ গোঁসাই… একে আমাদের জীবন মানেই অভিশাপ… তার উপর তুমিও….

রতনের গলা বুজে এলো। গোঁসাই দাঁড়িয়ে বলল, তবে? কেমন ধাক্কা খেলি বল? কেন বল তো? ওকে ভালোবাসিস বলে। ওকে স্নেহ করিস বলে। যার মনে এত স্নেহ, এত ভালোবাসা সেকি গ্রহণ নিয়ে বাঁচে রে?

রতন উত্তর করল না। কমলা এসে রতনের পাশে দাঁড়ালো। রতন বলল, আসলে আমি আমাকেই ঘেন্না করি গোঁসাই…

গোঁসাই বলল, সেই নিজেকে ঘেন্নাই তোর মনের গ্রহণ রে…. যে নিজেকে ঘেন্না করে তার কোথাও ঠাঁই হয় না দিদিভাই… তার প্রাণে বসে গোবিন্দও কষ্ট পায়…. তুই এ ভাব ছাড়…. নিজেকে ভালোবাস…. নিজেকে ক্ষমা কর…. নিজেকে স্বীকার কর…..

চাঁদ উঠেছে। টোটো চলছে। রতন আর কমলা পাশাপাশি বসে। গোঁসাই তাকে দিদিভাই বলে। কারণ সে মনেতে একজন মেয়ে। শরীরের ভুল মনেতে কেন বয়ে বেড়াবে সে? গোঁসাই ঠিকই তো বলে!

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?

লেখক পরিচয় |

জন্ম ১৯৭৬-এ হাওড়ার সালকিয়ায়। বর্তমান নিবাস হালিশহরে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশা শিক্ষকতা। সাহিত্য জীবন শুরু কবিতা দিয়ে। 'উদ্বোধন' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা। প্রিয় বিষয় দর্শন ও মনোবিজ্ঞান। জীবনে জীবন যোগ করার কাজ করে চলেছেন লেখনীর মাধ্যমে আর পাঠককে এক জীবনে অনেক জীবন যাপন করাচ্ছেন প্রতিটা শব্দের অভ্যন্তরস্থ অনুভূতির মধ্যে দিয়ে, সেতু বাঁধছেন লেখকে-পাঠকে।

Start typing and press Enter to search