ভোরের দিকে দরজায় ― বেল বাজল।
টুং টাং…
নির্ঘাৎ, কাজের মাসি এসেছে। এছাড়া লকডাউনে এত ভোরে আর কে আসবে !
বউ ― আমাকে ঠেলল। আমি, বউকে। বেশ কিছুক্ষণ কুস্তি লড়ার পরে, বউ, দুত্তোর বলে ঘুম চোখেই, কাজের মাসিকে মৃদু স্বরে গালমন্দ করতে করতে দরজা খুলতে গেল, ” এত ভোরে, মালতিকে যে কে আসতে বলে… !! “
আমি নিশ্চিন্তে পাশ বালিশ জড়িয়ে উল্টোদিকে মুখ করে শুলাম।
হঠাৎই ‘ও মা, গো…’ বলে একটা বিপদসঙ্কুল মহিলা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। সঙ্গে ধপাস করে ভারী কিছুর পতনের শব্দ। বউয়ের গলা বলেই ― মনে হল। ঘুম ― লাটে উঠল। কোনরকমে পড়িমড়ি করে দৌড়ে গিয়ে দেখলাম বউ দরজার গোড়ায় ― প্রায় অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে।
ঘুম চোখে, কাজের মাসি মনে করে গালমন্দ করতে করতে আমার বড় মাসিকে তথা নিজের মাসি শাশুড়িকেই ― দরজা খুলে দিয়েছে !
বড় মাসি, দরজার বাইরে, গোপালকে কোলে নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে, যেন বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে ― স্বল্প রাত-পোশাক পরিহিত তার বোনপো জায়া-র দিকে তাকিয়ে আছেন। কথা হারিয়ে ফেলেছেন। চোখ দুটো বিস্ময়ে গোল গোল হয়ে গিয়েছে । মুখটা ― হাঁ হয়ে আছে । এতটাই যে কোনও একটা মাঝারি সাইজের নাচিয়ে ব্যাঙ ‘ গ্যাঙর গ্যাঙর গ্যাঙ.. ‘ ― ব্যান্ড বাজিয়ে, অনায়াসে দু চার স্টেপ নেচে নিতে পারবে।
নিজের আঁচল দিয়ে, কোনোরকমে গোপালের চোখ দু’টো ― ঢেকে রেখেছেন ! নিজে নষ্ট হন ― হোন। রুপোর তৈরি গোপালের চরিত্র যেন নষ্ট না হয়।
কোনোরকমে বলতে পারলাম ― মাসি এয়েচো !
মাসি শর্ট প্যান্ট আর প্রায় দিলখোলা টপ পরিহিত আমার সহধর্মিণীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ― বুলু, তোর বউয়ের একি পোশাকের ছিরি রে ! হায় হায়… সক্কাল সক্কাল এ কি দৃশ্য দেখলাম রে !!!…
বড় মাসি চিরকালই ― ধার্মিক। বিয়ের প্রথম ক বছরের মধ্যেই মেসো মারা যাওয়ার পরে, সেই যে সাধের গোপালকে দত্তক নিলেন, আর ছাড়লেন না। নিজের ছেলের বদলে বোনের ছেলেগুলোকেই ― বড় করলেন। শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তিতে কোনো ঘাটতি ছিল না। কলকাতায় এখনও ― দু’টো ফ্ল্যাট। তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি চলে। মাসি গেলে কে পাবে ! কেউ মাসিকে ― চটায় না।
মাসি অবশ্য আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসেন। বুলু অন্ত প্রাণ। বুলুর বউ মিলি ― আরো চালাক। মাসি মাসি করে মাথায় তুলে রেখেছে। সুযোগ পেলেই, মাসির শাড়ি পরে, মাসির সাথে ঠাকুর ঘরে গোপাল সেবায় হাত লাগিয়েছে। কিন্তু আজ বেচারির ― হার্ড লাক। সাক্ষাৎ বিপদের সামনে পড়ে গিয়েছে।
মাটিতে পড়ে থাকা বউকে দেখে আমার নিজেরই লোভ লাগছিল ― মাসির তো পিলে চমকাবেই। বউ আমার দিকে চেয়ে চোখ মারছিল। মানে, সিগন্যাল দিচ্ছিল। অর্থ ― তুমিই, ম্যানেজ করো।
মাসিকে বললাম ― আরে মাসি, তুমি ভুল বুঝছো। ও সক্কাল সক্কাল আজকাল ঘরের ভেতর দৌড়ে বেড়ায়।
মাসি বললেন, এ তো পাগলের লক্ষণ !
আমি উত্তর দিলাম, না না আসলে ও লকডাউনের মধ্যে ―দেবী ঊষার দীক্ষা নিয়েছে ।
দেবী ঊষা ! সে কে ! আমি তো ঊষা ফ্যান, দেখেচি। দেবী ঊষার কথা তো কে তো কোনো দিন, শুনিনি ! তিনি আবার ― কোন দেবী !
তুমি কী করে দেখবে ― মাসি ! এই দ্যাখো, দেবী ঊষার ছবি !
মোবাইল থেকে পি.টি.ঊষা-র ছবি বার করে মাসিকে দেখিয়ে দিলাম।
মাসি দেখে বললেন, ইনিও তো হাফপ্যান্ট পরে আছেন দেখছি ! ইনি আবার …
আরে মাসি , ইনি হলেন ― ঊষা দেবী । সাউথের সবথেকে ― বড় দেবী। ওনার প্রচুর শিষ্যা, আর একটাই মন্ত্র ― মানুষের উপকার করো কিন্তু জামাকাপড় কম পরো। বস্ত্র ত্যাগ করো কিন্ত দয়া আর মায়া ত্যাগ কোরো না। সব সমস্যার একটাই সমাধান ― শুধু দৌড়তে হবে। ভোরের আলো ফোটার আগে। যত রাউন্ড পারো। যতক্ষণ না তোমার বৌমার মতন, মাথা ঘুরে না পড়ে যাচ্ছ, ততক্ষণ। পড়ে গেলে জ্ঞান প্রাপ্তি হবে। জ্ঞান প্রাপ্তি হলে ― আরও ত্যাগের দরজা খুলবে…
মাসি পি টি ঊষার ছবিটা ডান হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভক্তি ভরা চোখে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর ” মা, মা গো, তুমি বুলুর ভালো করো, মিলির ভালো করো, আমার ভালো করো, জগতের ভালো করো…” বলে, আমার মোবাইলটা মাথায় ঠেকালেন।
তারপর বললেন ― হ্যাঁ রে বুলু, পরের বার সাউথে গেলে আমাকে, এই ঊষা দেবীর আশ্রমে নিয়ে যাবি !!!
এই রে, সলিড কেস খেয়ে গেছি। মাসি যখন যেতে চেয়েছে – ঠিকই নিয়ে যেতে হবে। চিন্তায় পড়ে গেলাম।
আমতা আমতা করে বললাম ― কিন্ত মাসি ওনার কাছে দীক্ষা নিলে তো তোমায় ওই হাফ প্যান্ট পরে, ভোরবেলায় গোল গোল হয়ে ঘুরতে হবে ! তুমি কি, পারবে ! এই বয়সে , পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙবে, কী দরকার ! তুমি না হয় গোপালকে নিয়েই…
সে তোকে ভাবতে হবে না, হতভাগা। তোর বউ এই ধিঙি চেহারায় হাফ প্যান্ট আর এই ন্যাতা পরে থাকতে পারলে, আমিও না হয় তোর একটা শার্ট পরে নেবো কিন্তু দীক্ষা আমার চাই…
ততক্ষণে আমার বউ মিলি, জড়সড় হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কথা ঘোরাবার জন্য মাসির দিকে তাকিয়ে বলল ― মাসি এসেছো ! কতদিন তোমায় দেখিনি, গো !
মাসি মিলির দিকে তাকিয়ে বললেন ― শোনো , বাসি কাপড়ে আমাকে ছুঁও নি, বাপু । আমার কোলে, গোপাল রয়েছে। তোমাদের না দেখে আমি বেশিদিন থাকতে পারি না, তাই ভোরভোর ঘন্টা খানেক পায়ে হেঁটে চলে এলুম…
বেশ করেছো মাসি, তুমি ছাড়া আমাদের আর কে আছে বলো ! চলো, ঘরে চলো। তবে তার আগে একটা পেন্নাম তো, করতে দাও !
মাসি আপত্তি করার আগেই আমরা দু’জনে মাসির চরণে ― ফ্ল্যাট হয়ে গেলাম।
ওঁ, দু ডোজ ভ্যাকসিনবান ভব… ওঁ, দু ডোজ ভ্যাকসিনবতী ভব…
নিজের কান দুটোকে বিশ্বাস করতে না পারলেও, স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারলাম যে আশীর্বাদটুকু মাসি নিজের মন থেকেই করছেন…

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?