চার বন্ধুর একজন একদিকে আর তিনজন অন্যদিকে। পারবে কি তারা হাতে হাত রাখতে? জীবন্ত পৃথিবী আর মৃতের দুনিয়ার মধ্যে এক অত্যাশ্চর্য্য সেতু বেঁধেছেন অনীশ। মোবাইলে পড়ার জন্য স্ক্রল করুন নিচে...

এপারে তিনজন, ওপারে একজন

প্ল্যানচেটের টেবিল ঘিরে আমরা তিন বন্ধু বসে আছি। আমি চন্দ্রশোভন ওরা সবাই আমাকে ‘চ্যানি’ বলে ডাকে। আমার ডান পাশে, মোটামুটিভাবে একশো কুড়ি ডিগ্রির কৌণিক দূরত্বে সুরপতি। ও যেমন মোটা, ঠিক ততটাই ভারী ইন্টেলেকচুয়াল। আমরা ঠাট্টা করে ওকে ‘ডক্টর’ বলে ডাকি— যদিও ওর ডক্টরেট ডিগ্রি নেই। সুরপতির ডান দিকে, আরও একশো কুড়ি ডিগ্রি পর বসেছে রুনিয়া। প্ল্যানচেটের গোল টেবিলের ওপরে পাতা আছে একটা তেকোনা বোর্ড। বোর্ডের তিনটে খাটো পায়া তিনটে স্টিলের বল দিয়ে তৈরি— যাতে বোর্ডটা সহজেই টেবিলের ওপরে চলে বেড়াতে পারে।

ঘরটা অন্ধকার। শুধু নীল রঙের দুটো শিখা জ্বলছে। আবছা আলোয় দেখে মনে হচ্ছে, টেবিলে দাঁড়িয়ে থাকা মোমবাতি থেকেই আলোটা বেরোচ্ছে, তবে সাধারণ মোমবাতি ওগুলো নয়। বোধহয় সিজিয়ামের কোনও কম্পাউন্ড দিয়ে তৈরি। রুনিয়ার সাবজেক্ট ছিল কেমিস্ট্রি। আর ছিল নানান আবিষ্কারের বাতিক। সে বাতিক যে এখনও সুপার অ্যাক্টিভ, সেটা এই মোমবাতিগুলো দেখেই বোঝা যায়। এসব নির্ঘাত ওর কাণ্ড। প্ল্যানচেটে বসলে যে নীল আলোর মোমবাতি জ্বালতে হবে, তার কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তবে হলদে শিখার চেয়ে নীল শিখা খারাপ কী! বরং নীল আলোর মধ্যে একটা যেন সুপারন্যাচারাল এলিমেন্ট রয়েছে।

মোটরবাইকে চড়ে শান্তিনিকেতন বেড়াতে যাওয়ার অ্যাডভেঞ্চার প্ল্যান করেছিলাম আমরা। দুটো মোটরবাইক, আর আমরা চারজন সবুজ ছেলেমেয়ে। আমি আর পমপম বলতে গেলে এক্সপার্ট বাইকবাজ। আমার পেছনে সুরপতিকে লোড করেছি, আর পমপমের বাইকে সঙ্গিনী হয়েছে রুনিয়া। পমপম সবসময় হেসে বলত, রুনিয়া পেছন থেকে জড়িয়ে না ধরলে ওর নাকি বাইক চালানোর মুড আসে না। এতে রুনিয়া চোখ সরু করে ইশারায় ওকে ধমক দেওয়ার চেষ্টা করত বটে, কিন্তু পমপম সেটা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনত না। শুধু হাসত। আর হাসলে ওর গালে ফ্যান্টাস্টিক একজোড়া টোল পড়ত।

আমি তখন পমপমকে চোখ মটকে বলতাম, ‘ঠিক, ঠিক। তোর পিঠের টেম্পারেচারটাই তো তোর বাইক চালানোর আসল ইন্সপিরেশন, বস। এইভাবে হাসিঠাট্টা করতে করতে, নানান জোক মারতে মারতে আমরা শান্তিনিকেতনে পৌঁছে গিয়েছিলাম।

আমরা ঠিক করেছিলাম একটা রাত্তির থাকব। তার জন্যে পমপম ওর চেনা একজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে একটা বাড়ি ফিট করেছিল। তবে বাড়িটা মোটেই শান্তিনিকেতনে নয়। শান্তিনিকেতন ছাড়িয়ে প্রান্তিক— সেই প্রান্তিকের শেষ প্রান্তে।

অযত্নে পড়ে থাকা ছোট মাপের একটা দোতলা বাড়ি। সঙ্গে লাগোয়া বাগান। বাড়ির যেমন লজঝড়ে চেহারা, বাগানেরও তা-ই। বাগান জুড়ে শুধু আগাছা। তবে তারই মধ্যে ছোট ছোট গোলাপি আর হলদে রঙের সব মিলিয়ে বোঝা যায়, বাড়িটা বহুকাল মানুষজনের মুখ দেখেনি। অনায়াসে তার গায়ে ‘ভুতুড়ে বাড়ি’ তকমা এঁটে দেওয়া যায়।

এ নিয়ে পমপমকে আমরা কম আওয়াজ দিইনি। তাতে ও একসময় খেপে গিয়ে বলল যে, আমরা অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছি। সেই স্পিরিটের সঙ্গে বাড়িটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট মানিয়ে গেছে। শুধু সেই স্পিরিট কেন, বাড়িটা অন্যরকম স্পিরিটের পক্ষেও বেশ মানানসই। এ কথা বলেছিল ডক্টর সুরপতি। আর তখন ওর মোটা শরীরটা ভুঁড়ি কাঁপিয়ে নাচছিল, কারণ ও হাসছিল।

পমপম তার উত্তরে এক পশলা খিস্তি দিয়ে সুরপতিকে বেদম ঝেড়েছিল। রুনিয়া হাত-পা ছুড়ে চেঁচামেচি করে পমপমকে মুখ খারাপ করতে বারণ করছিল, কিন্তু পমপম শুনলে তো!

রুনিয়া যখন রাগ-টাগ করে গুম মেরে গেল, তখন পমপম ওকে মাস্টারির স্টাইলে বোঝাতে শুরু করল, ‘শোন, রুনিয়া শোন — প্লিজ। খিস্তি হচ্ছে বাংলা ভাষার আর্লিয়েস্ট ক্রুড ফর্ম। সেটাই ছ’সাতবার চোলাই হয়ে ভদ্দরলোকেদের ভাষা তৈরি হয়েছে। ফিলোলজির কোনও প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করে দেখিস… প্লিজ… এবার টেম্পারেচারটা একটু কমা… ।

আমি রুনিয়াকে চোখ মেরে বললাম, ‘বেশি কমাস না – তাহলে ফ্রিজিড হয়ে যাবি। পমপম ওর গায়ের টি-শার্টটা খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ‘শালা, ফ্রয়েডের বাচ্চা!” বলে ওটা আমার মুখে হুড়ে মারল।

বাড়িটায় পৌঁছোনোর পর থেকেই আমাদের ঠাট্টা-ইয়ারকি, হইহল্লা চলছিল। তখনও জানি না, রাত্তিরে কী হতে চলেছে। জানি না, আমাদের তিনজন আর পমপমের মাঝে ‘লক্ষ্ণণরেখা টানার জন্যে নিয়তি কলম নিয়ে তৈরি হচ্ছে। এখন ঘরে ঠান্ডা বাতাস চলে বেড়াচ্ছিল। নীলচে অন্ধকারে সেটাকে আরও ঠান্ডা বলে মনে হচ্ছিল। ঘরের দরজা হাট করে খোলা। এ ছাড়া দু’দিকের দেওয়ালের দু’দুটো জানলাও। বাতাসটা এত ভারী যে, মনে হচ্ছিল আমি কত হালকা। এই বুঝি পালকের মতো বাতাসে ভেসে পড়ব।

একতলার এই ঘরটা আমাদের কাছে নতুন। কিন্তু উপায় কী! দোতলার ঘরটার তো একদিকের দেওয়াল আর নেই। সে রাতে আমরা দোতলার বড় ঘরটাতেই ছিলাম। মাত্র দু’সপ্তাহ আগের ব্যাপার, অথচ মনে হচ্ছে কত যুগ আগের কথা।

প্রান্তিকের শেষ প্রান্তের সেই অভিশপ্ত বাড়ি। তার দোতলার অভিশপ্ত ঘরটা আর ঠিকঠাক নেই বলেই আমরা এবার একতলার বাগানের লাগেয়া একটা ঘরে আস্তানা গেড়েছি। পমপমকে প্ল্যানচেটে ‘নেমন্তন্নের আসর বসিয়েছি। ওকে একটিবার দেখার জন্যে পাগল। আমাদের টানে পমপমকে আজ আসতে হবে। আসতে তো ওকে হবেই! রুনিয়া গুমরে কেঁদে উঠল।

‘পমপম! পম! হানি বানি, তুই কোথায়?’ রুনিয়ার গলাটা হঠাৎই ফিসফিসে হয়ে গেল— ‘আয় রে … জলদি আয়…. আই নিড য়ু, হানি বানি….। মোমবাতির নীল শিখা দুটো কাঁপতে লাগল। ভারী বাতাস ধাক্কা মারতে লাগল আমাদের গায়ে। দরজা আর জানলা দিয়ে বাইরের আগাছার জঙ্গল চোখে পড়ছিল। অন্ধকারেও গোলাপি আর হলদে ফুলগুলো স্পষ্ট যেন ফ্লুওরেসেন্ট রঙে আঁকা ছবি। আগাছার ডালগুলো এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ছে। ওরা যেন পাগল হয়ে গেছে। এমন সময় পায়ের শব্দ শোনা গেল। কারা যেন এগিয়ে আসছে এই ঘরের দিকে। পমপম? নাকি ওর সঙ্গে আরও কেউ রয়েছে? আমরা তিনজনে ফিসফিস করে পমপমের নামটা বিড়বিড় করতে লাগলাম। যেন ওই চার অক্ষরের নামটা একটা অমূল্য বীজমন্ত্র। ‘পমপম … পমপম… পমপম… পম….”

সে দিন রাতে অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা হয়েছিল মাঝরাতে। আমরা দোতলার ঘরের মেঝেতে দুটো বিছানা পেতে গল্প করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর আচমকা একটা মেগা এক্সপ্লোশনে আমরা জেগে গিয়েছিলাম। কয়েক সেকেন্ডের টুকরো ছবিতে যা দেখেছিলাম তা এককথায় অবিশ্বাস্য।

আমাদের ঘরের পুব দিকের দেওয়ালটা ভ্যানিশ। আমরা সব বোমার স্প্রিন্টারের মতো শূন্যে পাগল করা গতিবেগে ছুটে চলেছি। চারপাশে দাউদাউ আগুন, চোখে কোটি-কোটি সরষে ফুল। আমাদের শরীরগুলো আস্ত, না ধ্বস্ত জানি না। তবে সেগুলো বিস্ময় আর যন্ত্রণায় যে অসাড় সেটা এক মুহূর্তের জন্যে হলেও অনুভব করেছিলাম।

এই মারাত্মক দুর্ঘটনার কথা আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল অঞ্চলে। আর বিস্ফোরণের দাপটে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল প্রায় এক বর্গকিলোমিটার এলাকা। লোকের মুখে মুখে আর পুলিশের কথাবার্তায় জানা গিয়েছিল, প্রান্তিকের ওই ছন্নছাড়া বাড়িটা নাকি জঙ্গিদের হাই মেগাটন বোমা বানানোর গোপন ঘাঁটি ছিল। আমরা যে ঘরটা ঝাড়পৌঁছ করে এক রাতের জন্যে বেডরুম বানিয়ে নিয়েছিলাম, ঠিক তার পেছনের ঘরটাতেই নাকি বারুদের মশলা আর ইলেকট্রনিক সুইচিং সার্কিটের কাজ-টাজ চলত।

ওই একটা মারণ দুর্ঘটনা পমপমকে আমাদের কাছ থেকে দূরে ঠেলে ম্যাজিক? দিল। “পমপম পমপম” রুনিয়ার পেনসিল ধরা হাত উত্তাল সমুদ্রে ডিঙিনৌকোর মতো টলছে।

কে, কে এসে দাঁড়াল দরজায় ? ওই তো একটা ছায়া ! ‘চ্যানি— চ্যানি, পমপম এসে গেছে।’ ফিসফিস করে বলল রুনিয়া। –
‘ডক্টর, ওই দেখ—’আমি সুরপতির হাত সাঁড়াশি মুঠোয় চেপে ধরলাম। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পমপম নয় – পমপমের ছায়া। ছয়াটা যে ওর, কী ঠাণ্ডা ! সেটা বোঝা যাচ্ছে ঝাঁকড়া চুলের সিলুয়েট দেখেই। কিন্তু তার পেছনে আরও দু’জন ছায়া। পমপমের তুলনায় আরও রোগা, কিন্তু লম্বা। রুনিয়া হঠাৎ যেন পাগল হয়ে গেল। পমপমের নাম ধরে ও চিৎকার শুরু করল।

রুনিয়া দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল, অথচ ওর পেনসিল ধরা হাত কাগজের ওপরে চলছিল। মোমবাতির নীল আলোর আভায় কাগজটা দেখা যাচ্ছিল, তবে তার ওপরে পেনসিলের লেখা বোঝা যাচ্ছিল না। হঠাৎই ঘরের ভারী বাতাস ছুটোছুটি শুরু করে দিল। মোমবাতির শিখা দুটো পতাকার মতো লতপত করতে লাগল। কাগজের একটা কোনা বাতাসি পাখির মতো উড়াল দিতে চাইল। আমরা তিনজনে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

করে উঠল। কিন্তু পমপম কিছুই শুনতে পেল না। রুনিয়াকে ফিসফিসে ধমক দিয়ে আমি আর ডক্টর চুপ করাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও শুনলে তো!
ঘরের দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল পমপম। সেই অ্যাক্সিডেন্টের পর ওকে নার্সিং হোমে এগারো দিন কাটাতে হয়েছে। তারপর আরও দু’বন্ধুকে জোগাড় করে ও আবার প্ল্যানচেটের আসর বসানোর ব্যবস্থা করেছে। এবং চোদ্দো দিনের মাথায় ফিরে এসেছে অকুস্থলে প্রান্তিকের প্রান্তে সেই অভিশপ্ত বাড়িটায়।

প্ল্যানচেটের সব আয়োজন ও একার হাতে করেছে। টেবিল, চেয়ার, তেকোনা বোর্ড, কাগজ, পেনসিল, মোমবাতি — সব। তারপর ও আরও দু’জন বন্ধুকে ডাকতে গিয়েছিল। কারণ, প্ল্যানচেট করতে হলে অন্তত তিনজন তো দরকার!
পমপম চোখের জল থামাতে পারছিল না। কারণ, রুনিয়ার কথা মনে পড়ছিল। গলার ভেতরে একটা উলের বল যেন নড়াচড়া করছে সবসময়। ওর আরও মনে পড়ছিল চ্যানি আর ডক্টরের কথা।

একটা রাত, একটা ভয়ঙ্কর অ্যাক্সিডেন্ট। মৃত্যু এসে এক ছোবলে ওদের চারজনের বন্ধুত্বে চিড় ধরিয়ে দিল। চিড় নয়, চওড়া এক কালো ফাটল। তার এদিকে একজন, আর একদিকে তিনজন। সেই তিনজনকে আজ, এখন, প্ল্যানচেটে ডাক পাঠাবে পমপম। ওঃ, কতদিন দেখেনি ওদের। ঘরের অন্ধকারে মোমবাতির শিখা দুটো ওর নজরে পড়ল। ও তো মোমবাতি জ্বেলে যায়নি। দেশলাই তো এখনও ওর পকেটে!
তা ছাড়া নীল রঙের শিখা কেমন করে তৈরি হল? কোনও অলৌকিক
ঘরের তিনটে চেয়ারই খালি, অথচ পেনসিলটা নিজে থেকেই খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে কাগজের ওপরে। আর শুধু দাঁড়িয়ে নেই, কাগজের ওপরে চলে বেড়াচ্ছে!
কোন এক লুকোনো বাতাসে মোমবাতির শিখা দুটো ছটফট করছিল। সেই বাতাসের ঝাপটা পমপমের গায়ে লাগতেই ওর গায়ে কাঁটা দিল।
ও ভয় পেয়ে গেল। চোখের জল মুছে পাগলের মতো দৌড় লাগাল। ওর বাকি দুজন বন্ধু কোনও কিছু না বুঝেই ওর পিছনে পিছন ছুটতে
পমপম বুঝতে পারল না, ওর প্রাণের তিন বন্ধু প্রাণ চলে যাওয়ার পরেও ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আর সেই জন্যই ওরা পমপমকে “ডাকতে” ওদের প্ল্যানচেটের আসর বসিয়েছিল।

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?

লেখক পরিচয় |

সাহিত্যিক অনীশ দেবের জন্ম ১৯৫১ সালে কলকাতায়। নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। লেখালিখি শুরু করেন ১৯৬৮ সালে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ– ঘাসের শীষ নেই, সাপের চোখ, তীরবিদ্ধ, জীবন যখন ফুরিয়ে যায় ইত্যাদি। করোনা আক্রান্ত হয়ে লেখকের মৃত্যু হয় ২৮ শে এপ্রিল ২০২১।

Start typing and press Enter to search