মাসকাবারি ভুষিমালের ফর্দ লিখতে লিখতে বাবা মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে উঠতেন– “বেসন এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেল!” কিংবা “তেলের কত দর যাচ্ছে, জানা আছে?” অথবা “ডাল এখন এক কেজি লিখছি, শেষ হলে আবার আনা যাবেখন।” মা কিছু বলতেন না, গেরস্তালি সামলাতে সামলাতে ‘বাড়ন্ত’ জিনিসপত্রের নাম মুখস্ত বলে যেতেন শুধু। আসলে তাদের মধ্যেকার আরও লক্ষ লক্ষ বোঝাপড়ার মধ্যে এ-ও ছিল একখানি বোঝাপড়া। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রাইমারি স্কুল মাস্টার কর্তা খুব ভালোভাবে জানতেন তার গৃহিনী কখনই অন্যায্য বিলাসিতায় তার মুদির খাতা ভরিয়ে দেবেন না। মা-ও জানতেন, সংসার চালনার অনিবার্য চাপে ন্যুব্জ মানুষটা যদি অগ্ন্যুৎপাত করে সাময়িক হালকা হন, তাতে ক্ষতি কী! সেই অগ্ন্যুৎপাতের আঁচ নির্দ্বিধায় সয়ে নিতে তার কোনো কুন্ঠা ছিল না। অবশ্য মিতভাষী ঠাকুমা তুলসীর মালা জপতে জপতে মা-র পক্ষ নিয়ে নিজ পুত্রকে প্রচ্ছন্ন ধমক দিতেই পিতৃদেব সে যাত্রায় ক্ষান্ত দিতেন। আমি আর দিদি ইতিউতি ঘোরাঘুরি করতে করতে বাবা-মা কে সাহায্যের (পড়ুন বিরক্ত করার) নামে “চিনি, নুন, হলুদ, জিড়ে, আপেল, কমপ্ল্যান থেকে শুরু করে মায় সেলাই-এর সুতো হয়ে কার্বলিক অ্যাসিড অবধি বলে ‘আন্দাজে বক মারা’-র চেষ্টা করতাম। এক-আধ বার লাগত না তা না, আর তখন আমাদের উদ্বাহু নেত্য দেখে কে! মৃতপ্রায় লক্ষণের জন্য মহৌষধী বিশল্যকরণী নিয়ে এসে হনুমানও বুঝি এতটা নাচেননি!

যাইহোক, বাবার বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া এবং সেখান থেকে ফিরে আসার মধ্যে আমরা ততক্ষণে ভাঁজ করে রাখা বিছানায় ডিগবাজি দিয়ে, টিউবওয়েলের মুখ চেপে ধরে কৃত্রিম ঝর্ণা তৈরি করে, ঘরের দেওয়ালে সাদা চকের কারুকার্য করে, শেষে নাগাল না পাওয়া কুলুঙ্গিতে আচারের বয়েম পাড়তে গিয়ে তা ভেঙ্গে ফেলে মা-র খুন্তির বাড়ি থেকে নিজেদের বাঁচাতে ঠাকুমার আঁচলের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে ফেলেছি। পরিবেশ খানিক শান্ত হলে ঠাকুমা চোখ টিপে ইশারা করতেন। আমরা খুবই সন্তর্পণে ক্ষণিকের জন্য গৃহত্যাগী হতাম।

পাড়ার মোড়ের রাস্তায় ঢুকতে না ঢুকতেই বাবা ক্রিং-ক্রিং বেল বাজাতে শুরু করতেন। আমরা যেখানেই থাকি ধূলিমাখা মলিন পায়ে ছুট্টে বাবার সাইকেলের পিছু নিতাম– এ’ও নিজের অজান্তে বাপ-বেটার মধ্যে তৈরি হওয়া এক নামহীন বোঝাপড়া। সাইকেলের হ্যান্ডেলের দুই পাশে সারের বস্তা কেটে বানানো খান চারেক জিনিসপত্রে ভর্তি হলদে ব্যাগ। বাড়ি ফিরেই “কী এনেছ… কী এনেছ?” শব্দের যৌথ আন্দোলনে বাবা নিজের হাতখানি পকেটস্থ করতেন। আমরা অধীর অপেক্ষায় চুপ… চোখ-মুখ প্রায় বৃত্তাকার। তারপর খুবই সাবধানে বেরিয়ে আসত রঙিন রাংতায় মোড়া প্রবল আকর্ষণী গুণ সমৃদ্ধ বেশ কিছু লজেঞ্জুস। আমার হাতে দিয়ে বলতেন, “দিদির সাথে ভাগ করে খেয়ো।” ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে অবশ্য আর পাঁচ জনের মত আমার আর দিদির মধ্যে কখনও সমস্যা হয়নি। বলতে দ্বিধা নেই, এ’বিষয়ে আমি বরাবর তার নমনীয়তার সুযোগ নিয়ে একপাক্ষিক সমঝোতার সুবিধা ভোগ করে গেছি।

এরপর কংক্রিটে বাঁধানো, গোবর দিয়ে নিকানো মাটির বারান্দায় একটা একটা থলি খালি করা হত। কোনোটাই সবজি, কোনোটায় মুদির জিনিসপত্র, কোনোটায় চাষের কীটনাশক বা ফুল-সবজির চারা গাছ। ঠাকুমার হাতে পানের তাড়াখানি গুঁজে দিয়ে শিশুমনের আনন্দে ললিপপ চুষতে চুষতে আমরা দেখতাম, প্রায় নিঃশেষিত থলির কোণ থেকে বেরিয়ে আসছে এক পাতা মেরুন-রঙা টিপ ও এক জোড়া আলতার শিশি; যদিও ফর্দতে সেগুলো লেখা ছিল না…

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?