হাম্পির মহারাজ বীরবাহুর আদেশে চিত্রাঙ্কনের জন্য পাহাড় জঙ্গল ঘেরা বিরূপাক্ষ নদীর কূলে বিল্ব মুনি’র আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছে রাজচিত্রকর চিত্রকানন্দ। জগতের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর চিত্রঙ্কনের আদেশ দিয়েছেন মহারাজ বীরবাহু। এর পূর্বে চিত্রকানন্দ শুধুই প্রকৃতির চিত্র অঙ্কন করেছে। তার তুলিতে চিত্রিত হয়েছে পাহাড়ের রুক্ষতা অথবা ঝর্ণার উচ্ছলতা কিম্বা নদী জঙ্গলের নৈসর্গিক নিরবতা। ওর চিত্রে বহমান সময় যেন থমকে যায় প্রকৃতির কোলে। চিত্রকানন্দ এই প্রথমবার রাজাজ্ঞায় প্রতিকৃতি অঙ্কনের উদ্দেশ্যে হাতে তুলে নিয়েছে তুলি। সে অঙ্কন করতে চাইছে সেই রমনীয় প্রতিকৃতি যেখানে সময় থমকে দাঁড়ায় না। যেখানে প্রকৃতি আর নারী মিলেমিশে সময় অথবা নদীর স্রোতের মতো বিরামহীনভাবে প্রবাহিত হতে থাকে অসীম সাগরের সঙ্গমের খোঁজে।

এক পক্ষকাল অতিবাহিত। চিত্রকানন্দের চিত্রপটে তুলির আঁচড়ে বিমূর্ত প্রাকৃতিক চিত্রকল্পে কল্পিত নারীর অবয়ব। পাহাড়ের পাথুরে কাঠিন্যে রমনীয় মুখশ্রী খুঁজেছে চিত্রকর। বর্ষার উচ্ছল ঝর্ণায় দেখেছে শরীরী বিভঙ্গ। গভীর জঙ্গলের স্নিগ্ধ আঁধারে নিষিদ্ধ আদুরে পরশ অথবা দিগন্ত বিস্তৃত মনোরম সবুজে রমণীয় পেলবতা। রিনিঝিনি নুপুরের ধ্বনি তুলে সাগরের উত্তাল পৌরুষে সঙ্গমের আহ্বানে সারা দিতেই নদী যেমন স্রোতস্বিনী ঠিক সেই রকম গতিময়তা অঙ্কন করতে চেয়েছে কল্পিত নারীর অবয়বে।

চিত্রপটে কল্পিত নারীর কবরীবন্ধে জংলী গোলাপ। মরালী সম গ্রীবায় জংলী পুষ্পমালার আভরণ ছুঁয়েছে নাভিপদ্ম। গিরিশৃঙ্গ সদৃশ পীনোন্নত স্তনযুগল আবৃত পাহাড়ি গুল্মলতায়। ক্ষীণ কটিদেশ পুষ্পামালা শোভিত। কটিবন্ধ থেকে আজানুলম্বিত জংলী পাতাবাহার লজ্জা নিবারক।

চিত্রকানন্দের দৃষ্টি নিবদ্ধ সদ্য চিত্রিত চিত্রপটে। চিত্রপটে নারীর সব কিছুই যথাযথ কিন্তু চিত্রে যেন প্রাণ নেই। নীরব চোখে নেই কামনার হাতছানি। শরীরী বিভঙ্গে নেই রমণীয় অহ্বান। চিত্রকানন্দ অনুধাবন করতে পারছে নারীর সৌন্দর্য শুধু শরীরে নয়, মননেও। তার অঙ্কিত চিত্রে কালিদাস বর্ণিত নারী শরীরের প্রায় সব কিছুই আছে যথাযথভাবে। তবুও নিজের সৃষ্টিতে সে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। বিরূপাক্ষ নদীতীরে এক বটবৃক্ষের ছায়ায় উপবিষ্ট হয়ে নদীর অপর প্রান্তে সুদূর দিগন্তরেখায় আবছা পর্বতশ্রেণীর দিকে উদাস দৃষ্টিতে কী যেন খুঁজে চলেছে চিত্রকানন্দ। শিল্প অনুরাগী মহারাজের আদেশে এক পক্ষকাল ধরে তিলে তিলে সে চিত্রপটে ফুটিয়ে তুলেছে তার মানসকন্যাকে। গভীর জঙ্গলের লতাগুল্ম পত্র বল্কল আর পুষ্পের নির্যাস থেকে আহরণ করেছে রঞ্জক। প্রকৃতির সঙ্গে নিজের মনের মাধুরি মিশ্রিত করে অঙ্কন করেছে কল্প সুন্দরী। কিন্তু তাতে ফোটাতে পারেনি প্রাণের স্পন্দন। ব্যর্থতার অনির্বচনীয় মনোকষ্টে জর্জরিত জাগতিক অনুভূতিহীন চিত্রকানন্দ নিজের কাঁধে আকস্মিকভাবে অনুভব করল এক কোমল স্পর্শ। সচকিত হয়ে পিছন ফিরতেই দৃষ্টিগোচর হল এক অনিন্দ্য সুন্দর আশ্রম কন্যা। সেই কন্যার কেশরাশিতে দারুণ দাবদাহে ঘনকালো বর্ষামেঘের শীতল আশ্বাস। নিরব নিশ্চল ওষ্ঠে যেন না বলা শব্দেরা খেলে বেড়াচ্ছে অনাবিল। কাজলটানা দু’চোখে সম্মুখে বহমান বিরূপাক্ষ নদীর অতল গভীরতা। শরীরী বিভঙ্গের শৃঙ্গ আর উপত্যকায় যেন গিরিখাত বেয়ে নেমে আসা পাহাড়ি ঝর্ণার উচ্ছলতা। আচম্বিতে চিত্রকানন্দ খুঁজে পায় তার কাঙ্ক্ষিত চিত্রপটের কল্পিত নারীকে। প্রকৃতির অনির্বচনীয় সৌন্দর্য যেন এক অঙ্গে ধারণ করেছে এই কন্যা। এই রকম প্রাণোচ্ছল রমনীয় অবয়বই তো চিত্রিত করতে চেয়েছে চিত্রকানন্দ। বিস্ময়াভিভূত চিত্রকানন্দের সম্বিৎ ফিরল মৃদু সুরেলা স্বরে,

– “হে শিল্পী, আপনি আপনার চিত্রাঙ্কনে মোহিত হয়ে সম্ভবত বিস্মৃত হয়েছেন যে দ্বিপ্রহর গড়িয়ে সায়াহ্ন আগতপ্রায়। আপনি আজ দ্বিপ্রাহরিক অন্নও গ্রহণ করেননি। আপনার সংবাদ নিতে পিতা আমায় এখানে প্রেরন করলেন।”

– “তুমি কি মহর্ষি বিল্ব মুনি’র কন্যা?”

চিত্রকানন্দের সংক্ষিপ্ত প্রশ্নে আশ্রম কন্যা, “যথার্থ অনুমান করেছেন” বলেই তার কোঁচড়ে বাঁধা দুটো পাকা রসালো ফল চিত্রকানন্দের হাতে দিয়ে বেশ শাসনের সুরে বলল,

– “এইভাবে অনাহারে থাকলে পিত্ত পড়বে। এগুলো খেয়ে নিন। তারপর আবার অঙ্কন শুরু করুন…”

আশ্রমকন্যা ফেরার পথ ধরতেই চিত্রকানন্দ বলে উঠল,

– “আমার অঙ্কন শুরু তো করেছি কিন্তু শেষ করতে পারছি না যে। তুমি কি আমায় সাহায্য করতে পারো? দেখেছো, এত বাক্যালাপের পরেও তোমার নামটাই জানা হল না…”

– “আমার নাম পল্লবী। বলুন চিত্রকর আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? আমি কিন্তু অঙ্কনবিদ্যায় একেবারেই কাঁচা, এ আপনাকে আগেই বলে রাখলাম। পরে কিন্তু আমায় দোষারোপ করতে পারবেন না।”

তরুণী সুলভ চপলতায় কথাগুলো বলেই পল্লবী তাকাল চিত্রকানন্দের দিকে। ওর পাহাড়ি ঝর্ণার মতো অনাবিল উচ্ছলতায় মুগ্ধ হয়ে মৃদু হেসে বলল,

– “আমার নাম চিত্রকানন্দ তবে তুমি চিত্রক বলেই ডাকতে পারো। আমার মাতা বাল্যে আমায় সেই নামেই ডাকতেন।”

“এখন আর ওই নামে ডাকেন না?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পল্লবী চিত্রকানন্দের দিকে তাকাতেই ওর বিষন্ন প্রত্যুত্তর,

– “মাতা গত হয়েছেন যখন আমি দশম বর্ষীয় বালক। আর পিতা আমার জন্মের পূর্বেই। মাতা ছিলেন মহারাণীর দাসী আর আমি দাসীপুত্র। আমি নাম কুল গোত্রহীন রাজানুগ্রহে পালিত। আমার এই চিত্রকানন্দ নামটাও মহারাজেরই দেওয়া। তুমি আমায় চিত্রক নামেই ডেকো। মাতা গত হওয়ার পরে ওই নামে ডাকার আর কেউ নেই।”

চিত্রকরের করুন জীবনকাহিনী শুনে যারপরনাই ব্যথিত হল পল্লবী। মনে মনে ভাবল চিত্রকরের কোনও কাজে লাগতে পরলে ওর ভালই লাগবে। পল্লবীর দেওয়া ফল দুটি খেয়ে নদীর জলে হাত ধুয়ে নদীর জল আঁজলা ভরে পান করে আবার সেই বটবৃক্ষের তলায় ফিরে এলো চিত্রকানন্দ। সুদূর পর্বতশ্রেণীর খাঁজে ততক্ষণে রক্তিম সূর্য ধীরলয়ে অস্তমিত হচ্ছে। কিচিরমিচির শব্দে পাখির দল বাসায় ফিরছে। বিরূপাক্ষ নদীর জলেও অস্তমিত সূর্যের লালচে আভা। বটবৃক্ষের তলায় ফিরে এসে চিত্রকানন্দ দেখল ওর সেই অসমাপ্ত চিত্রপট হাতে নিয়ে পল্লবী তখনও তার জন্য অপেক্ষা করছে। চিত্রপট চিত্রকানন্দের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে পল্লবী বলল,

– “বড় সুন্দর অঙ্কন করেন আপনি। আপনার চিত্রে প্রকৃতি আর মানবী মিলে যায় আশ্চর্য রকমভাবে।”

– “কিন্তু এই চিত্র যে প্রকৃতির পাহাড় জঙ্গল নদীর মতোই নিষ্প্রাণ! এই চিত্র অঙ্কন করে আমি তো খুশি হতে পারিনি। আমি চিত্রে প্রাণের স্পন্দন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই তো তোমার সাহায্য চেয়েছি।”

– “এ মা! আমি কী করে সাহায্য করবো? পূর্বেই তো বললাম…”

পল্লবীর মৃদু আপত্তি কর্ণগোচর না করেই চিত্রকানন্দ বলে চলল,

– “তুমি আমার চিত্রকল্পের নারী হবে? সেই নারীকে ভূষিত করবো প্রাকৃতিক আভরণে এবং আবৃত করবো প্রাকৃতিক আবরণে। তার দৃষ্টিতে থাকবে বিরূপাক্ষ নদীর শীতল গভীরতা। তার শরীরের প্রতিটি খাঁজে শব্দ করে বহে যাবে পাহাড়ি ঝর্ণা। তার নীরব ওষ্ঠে নিরুচ্চারিত কাব্য অথবা সংগীতের মূর্চ্ছনা। তুমি হবে আমার সেই কল্পনার নারী?”

রাতের বিরূপাক্ষ নদীর কালো জলে চৈতী পূর্ণিমার চাঁদের প্রতিবিম্ব প্রতিমুহূর্তে ভাঙছে আবার গড়ছে জলস্রোতের সঙ্গে সঙ্গত করে। সেই প্রতিবিম্বের প্রতিচ্ছবি যেন পল্লবীর মুখমণ্ডলে। উদ্ভাসিত জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দৃশ্যমান পল্লবির নীরব সম্মতি। পল্লবির দৃষ্টি আজ পড়তে পেরেছে চিত্রকানন্দ। চৈতী পূর্ণিমার চাঁদের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না আর বিরূপাক্ষ নদীর জল ছুঁয়ে আসা শীতল বাতাসকে সাক্ষী রেখে চিত্রক তার দু’হাতের তালু ছোঁয়াল পল্লবীর দুই গালে। পল্লবীর চোখে চোখ রেখে চিত্রকের কন্ঠে ভীষণ চাপা স্বরে অত্যন্ত ধীর লয়ে উচ্চারিত কালিদাসের শ্লোক-

“তন্বী শ্যামা শিখরি-দশনা পক্কবিম্বাধরোষ্ঠী

ক্রমেই চিত্রকের হাত পল্লবীর গ্রীবা ছুঁয়ে নেমে এলো ক্ষীণ কটিদেশে। উন্মুক্ত নাভিপদ্মে হাত ছুঁইয়ে চিত্রকের কন্ঠে-

“মধ্যেক্ষামা চকিত-হরিণী প্রেক্ষণা নিম্ন-নাভি;!”

পল্লবীর শরীরজুড়ে অকস্মাৎ বিদ্যুতের ঝলক। শরীরের মৃদু কম্পনের সাথে সাথে ক্ষীণ কটিদেশ পেরিয়ে চিত্রকের দুই হাত পল্লবীর গুরুনিতম্বে। নিজের একেবারে নিকটে পল্লবীকে টেনে নিয়ে চিত্রকের মননে মেঘদূত –

“শ্রোনীভারাদলস-গমনা স্তোক-নম্রা স্তনাভ্যাং

যা তত্র স্যাদ যুবতি-বিষয়ে সৃষ্টি রাদ্যের ধাতু;!”

পল্লবীর হাত ধরে বিরূপাক্ষের জলে ডুব দিয়ে চিত্রক নিজের হাতে অসম্পূর্ণ চিত্রপট জলে ভাসিয়ে দিল। সিক্ত বসনে পাড়ে উঠে এসে চরাচর ভাসিয়ে দেওয়া জ্যোৎস্নায় দু’চোখ ভরে দেখতে লাগল সিক্ত বসনা পল্লবীর শরীরী বিভঙ্গ। চোখ বুঁজলেই যেন শুনতে পাচ্ছে সুদূর পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণার শব্দ। সিক্ত বসন ত্যাগ করে সম্পূর্ণ নিরাবরণ পল্লবীর সারা অঙ্গে যেন গলানো জ্যোৎস্নার আভরণ। সিক্ত অঙ্গের উপত্যকায় জমে থাকা প্রতিটা জলবিন্দুতে যেন হীরক দ্যুতি। পল্লবীর কাঁধ সামান্য ঝুঁকে আছে স্তনভারে নাকি লজ্জায় সেটা ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। জ্যোৎস্না স্নাত গুরুনিতম্বে ঈর্ষান্বিত যেন চৈতী পূর্ণিমার চাঁদও। চিত্রকের হাতে তুলি। নতুন চিত্রপটে সুনিপুণ রেখায় ফুটে উঠছে পূর্ণাঙ্গ নারীর আবছা অবয়ব।

—–

তারপর আরও মাসাধিক কাল অতিবাহিত। অঙ্কন সমাপ্ত করে নিজের অঙ্কিত চিত্রপটে দৃষ্টি নিবদ্ধ চিত্রকানন্দের। এই মাত্র মাসাধিক সময়ে নিজের পরিবর্তিত মননে চিত্রকানন্দ নিজেই বিস্মিত। চিত্রপটে ওর সৃষ্ট মানসকন্যার দু’চোখের দৃষ্টিতে যেন বিরূপাক্ষের শীতল গভীরতা। সেই গভীরতায় ডুবে যাওয়াই যেন শিল্পীর নিয়তি। চিত্রপটের মানসকন্যার নীরব ওষ্ঠে যেন অনুচ্চারিত আহ্বান। পুষ্পমালার আভরণের আড়ালে শরীরের প্রতিটা শৃঙ্গ আর উপত্যকার অনিবার্য অমোঘ আকর্ষণ।

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের পরে বর্ষা নেমেছে প্রকৃতিতে এবং পল্লবী চিত্রকের মনেও। বিরূপাক্ষ নদীর অপর পাড়ে পাহাড়ের কোলঘেঁষা এক পরিত্যক্ত পর্ণকুটিরে প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে গন্ধর্ব মতে মিলে গেল দুটো শরীর আর মন। পর্ণ কুটিরের বাইরে প্রবল বৃষ্টিধারায় স্নাত হয়ে উত্তপ্ত ধরিত্রীর শরীর যখন চরম রাগমোচনে শীতল হচ্ছে তখন ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে চিত্রকের প্রতিটি স্পর্শে পল্লবীর দেহ বিভঙ্গে নবযৌবনের বাঁধনছেঁড়া উচ্ছাস।

দীর্ঘদিন পরে আশ্রম ছেড়ে রাজধানীতে ফিরল চিত্রকানন্দ। অশ্রুসজল বিদায় পর্বে খুব দ্রুত প্রত্যাবর্তনের অঙ্গীকার করে এসেছে পল্লবীর কাছে। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে রাজধানীতে ফিরতে ফিরতে সূর্য অস্তাচলে। যত দ্রুত সম্ভব চিত্রপট মহারাজের নিকট সমর্পণ কোরে চিত্রকানন্দ আবার ফিরতে চায় বিরূপাক্ষ নদীর তীরে বিল্ব মুনির আশ্রমে। পল্লবীর ঘনিষ্ঠ সংসর্গে এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে চিত্রকানন্দ। উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে পল্লবীর স্পর্শে চিত্রকানন্দ ওর সৃষ্টিতে খুঁজে পেয়েছে প্রাণের স্পন্দন। তাই সে দ্রুত ফিরতে চায় আশ্রমে। সময়ের অপচয় করে পরবর্তী রাজসভার জন্যে অপেক্ষা করতে চায় না চিত্রকানন্দ। মহারাজের অন্দরমহলে চিত্রকানন্দের অবাধ যাতায়াত সেই বাল্যকাল থেকেই। সেই অধিকারে মহারাজের রক্ষী মারফত মহারাজের সাক্ষাতপ্রার্থী হওয়ার আবেদন পাঠাল। মহারাজের সম্মতিক্রমে উপস্থিত হল মহারাজের কক্ষে। শয্যায় অর্ধ শায়িত বিশ্রামরত মহারাজের পাদপদ্মে চিত্রকানন্দ সমর্পণ করল সেই চিত্রপট। সেই চিত্রে নারী যেন প্রকৃতিতে বিলীন। মুগ্ধ চিত্তে মহারাজ বীরবাহু সেই চিত্রপটে ক্ষণিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অস্ফুট স্বরে বিস্ময় প্রকাশ করলেন,

– “সত্যিই অনির্বচনীয় চিত্রকলা। এই রমনীয় সৌন্দর্যকেই বোধহয় খুঁজে চলেছি এতদিন ধরে। চিত্রকানন্দ এটা কি শুধুই তোমার কল্পনার নারী? নাকি বাস্তবেও সে আছে এই ধরিত্রীতে? যদি সে বাস্তবে থাকে তাহলে তুমিই খুঁজে এনে দাও তাকে। আমি এই নারীকে বিবাহ করতে চাই।”

মহারাজ বীরবাহু অক্ষরিক অর্থেই চিত্রকানন্দের পালক পিতা। মাতার মৃত্যুর পরে সে যখন অনাথ তখন মহারাজ বীরবাহুর অভিভাবকত্বে চিত্রকানন্দের অঙ্কন শিক্ষা শুরু হয় রাজচিত্রকর সুবর্ণের কাছে। সুবর্ণের মৃত্যুর পরে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয় চিত্রকানন্দ। মহারাজ বীরবাহুর কাছে তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তাই মহারাজের কাছে সে অনৃতভাষী হতে পারবে না। আবার নিজের স্ত্রীকেও তাঁর হাতে তুলে দিতে পরবে না মহারাজের মহিষী হিসেবে। চিত্রকানন্দের কাছে এ এক ভীষণ ধর্ম সংকট। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে মনের সমস্ত ভয় আর সংকোচ কাটিয়ে চিত্রকানন্দ মিনতি করল,

– “মহারাজ চিত্রপটের নারী কল্পিত নয় বাস্তবে সে বিল্ব মুনির কন্যা এবং আমার স্ত্রী। গন্ধর্বমতে আমরা বিবাহ করেছি।”

হঠাত যেন এক অসীম নিস্তব্ধতা মহারাজের কক্ষে। এই অসীম নিস্তব্ধতায় মহারাজের মুখপানে চেয়ে দেখার মতো ধৃষ্টতা দেখাতে পারে না চিত্রকানন্দ। নতমস্তকে বোঝার চেষ্টা করে মহারাজের অভিব্যক্তি এবং অনুমান করতে চেষ্টা করে পরবর্তী প্রতিক্রিয়া। কয়েক মুহূর্ত অসহনীয় প্রতীক্ষার পরে চিত্রকানন্দকে বিস্মিত করে ভেসে আসে মহারাজের শান্ত স্বর,

– “ঠিক আছে তুমি এখন আসতে পারো। আগামীকাল এই বিষয়ে আলোচনা করা যাবে…”

এর পরে আলোচনার আর কী বাকী থাকতে পারে বুঝতে পারে না চিত্রকানন্দ। মনের ভেতর একরাশ প্রশ্ন নিয়ে ধীর পদক্ষেপে মহারাজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে চিত্রকানন্দ।

রাজপ্রাসাদ আলোক মালা আর পুষ্প সাজে সেজে উঠেছে। নহবতে দীপক রাগের সুর। রাজকীয় অথিতিরা একে একে ফিরতে শুরু করেছে অথিতি নিবাসে। ফুলশয্যায় অবগুণ্ঠিত পল্লবী অপেক্ষায় মহারাজ বীরবাহুর…

নিদ্রা ভেঙে শয্যায় উঠে বসতেই চরম তৃষ্ণা অনুভব করছে চিত্রকানন্দ। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নে সারা শরীর ঘর্মাক্ত। ও আর ভাবতে পারছে না। রাজবাড়ীর ঘণ্টাধ্বনি জানান দিচ্ছে রাত্রি দ্বিপ্রহর। পল্লবীর বিরহকে সঙ্গী করে জীবিত থাকার চেয়ে চিত্রকানন্দের কাছে মৃত্যুও শ্রেয়। ও বুঝতে পারছে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে পুরো বিষয়টাই হাতের বাইরে চলে যাবে। একটা ঝোলায় ওর সারাজীবনের সঞ্চিত কিছু মুদ্রা আর অঙ্কনের সরঞ্জাম এবং পথের বিপদের কথা ভেবে হাতে একটা বল্লম নিয়ে একবস্ত্রে পথে বেরিয়ে এলো চিত্রকানন্দ। পথে ইতিউতি নৈশ প্রহরী আর সারমেয় ব্যতীত আর কেউ নেই। নৈশ প্রহরীদের সন্তর্পণে এড়িয়ে গিয়ে নগর পেরিয়ে জঙ্গলের মেঠো পথ ধরল চিত্রকানন্দ। রাজধানী থেকে আশ্রম প্রায় বিশ ক্রোশ পথ। বিশ্রাম না নিয়ে একটানা হেঁটে গেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সূর্য পাটে যাবে। জংলী গাছের আড়াল এড়িয়ে চুঁইয়ে আসা জ্যোৎস্নার আবছা আলোয় পথ চলতে চলতেই দূর থেকে ভেসে আসছে জংলী শ্বাপদের হিংস্র আওয়াজ। তুলি ধরা কোমল হাতে শক্ত করে বল্লমটা ধরে দ্রুত পা চালায় চিত্রকানন্দ। যত দ্রুত সম্ভব ওকে পৌঁছাতে হবে আশ্রমে। পল্লবীকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি দিতে হবে কোনও নতুন দেশে নতুন রাজ্যে, যেখানে ওদের পরিচিত কেউ নেই। সেখানে ওরা দু’জনে হাতে হাত মিলিয়ে গড়বে নিজেদের পর্ণকুটির। রাতের অন্ধকার ফিকে হতে শুরু করেছে। এক্ষুণি মুখ দেখাবে সূর্যদেব। জঙ্গলের পথ শেষ হয়ে চিত্রকানন্দ পৌঁছায় বিরূপাক্ষ নদীর তীরে। এই নদীর তীর ধরে এখনও চলতে হবে প্রায় আঠারো ক্রোশ পথ। গতরাতের অভুক্ত শরীরে জোর আনতে আঁজলা ভারা নদীর জল পান করে হাঁটতে শুরু করে।

প্রত্যাশার অনেক পূর্বেই চিত্রক পৌঁছে গেল গন্তব্যে। বৈকালিক সূর্য তখনও আকাশে প্রজ্জ্বলিত। নদীতীরে যে বটবৃক্ষের তলায় চিত্রকানন্দ নতুনভাবে খুঁজে পেয়েছিল নিজেকে সেখানে কয়েক মুহুর্ত দাঁড়াল। চোখেমুখে আঁজলা ভরে নদীর জল ছিটিয়ে ক্লান্তি দূর করে পা বাড়াল আশ্রমের দিকে।

একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে চিত্রকের মুখোমুখি হয়ে বিহ্বল পল্লবী। এত দ্রুত ওরা আবার মুখোমুখি হবে তা ওর কল্পনারও অধিক। অকল্পনীয় আনন্দের আতিশয্যে পল্লবী ওর চিত্রককে জড়িয়ে ধরতেই চিত্রকানন্দের নজরে পড়ল ওদের সামনে মূর্তিমান বিভীষিকার মতো উপস্থিত অশ্বারোহী মহারাজা বীরবাহু। অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবরহণ করে এক শক্তিশালী ধাক্কায় চিত্রকানন্দকে ছিটকে ফেলে একহাতে পল্লবীর হাত অন্য হাতে কটিদেশ ধরে বিরবাহু বলপূর্বক অশ্বপৃষ্ঠে উত্তরণে সচেষ্ট হতেই চিত্রকানন্দ ভুলে গেল পালক পিতার কথা। মহারাজ বীরবাহু ওর চোখে শুধুই আজ স্বেচ্ছাচারী শাসক এবং ধর্ষক। তুলি ধরা কোমল হাতে শক্ত করে ধরল বল্লম। শরীরের সমস্ত শক্তি এবং মনে জমে থাকা রাগ দুই হাতে পুঞ্জীভূত করে বল্লমটি আমূল বিদ্ধ করল মহারাজের পিঠে। রক্তাক্ত মহারাজ মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই শোনা গেল মহারাজের অশ্বারোহী রক্ষীদের অশ্ব ক্ষুরের শব্দ। ঘটনার আকস্মিকতায় ভীত সন্ত্রস্ত পল্লবী চিৎকার করে উঠল,

– “চিত্রক অতি দ্রুত অশ্বারোহণ করুন। আমাদের দ্রত পালাতে হবে।”

ভয়ার্ত কণ্ঠে চিত্রক “আমি তো অশ্ব চালনা জানি না” বলতেই “আমি জানি” বলেই দ্রুত অশ্বারোহণ করল পল্লবী। চিত্রকের হাত ধরে পিছনে বসিয়ে লাগামে টান দিতেই অশ্ব দৌড়াতে শুরু করল। প্রচণ্ড গতিশীল অশ্বের লাগাম শক্ত হাতে ধরে পিছনে বসা চিত্রকের উদ্দেশে আশ্বাসের সুরে চেঁচিয়ে উঠল পল্লবী,

– “ভয় পাবেন না। আমার কটিদেশ শক্ত করে ধরুন। রাজ পেয়াদারা আমাদের ধরতে পারবে না…”

বেশ কিছুক্ষণ বিরূপাক্ষ নদীর তীর ধরে এগিয়ে গিয়ে বাঁহাতে হাম্পি রাজ্যকে ফেলে ডানদিকে জঙ্গলের পথ ধরল ওরা। সন্ধে পেরিয়ে অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় পথ ঠিকমতো ঠাওর করা দায়। এই বিস্তৃত জঙ্গল পেরোলেই এক নতুন রাজ্য। জঙ্গলে প্রবেশ করার পূর্বে অশ্বের গতি রোধ করে পিছন দিকে ঘাড় ঘোরালো পল্লবী। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় তখনও চিত্রকের পাংশুটে মুখে আতঙ্কের চিহ্ন স্পষ্ট। চিত্রকের ওষ্ঠে দীর্ঘ চুম্বন করে ঠাট্টার সুরে পল্লবী বলে উঠল,

– “শিল্পীর তুলি ধরা হাতে যে বল্লম তুলতে পারে শুধুই তার প্রেয়সী…”

প্রত্যুত্তরে চিত্রক পল্লবীর ওষ্ঠে হালকা দংশন করতেই পল্লবী অশ্বের লাগামে টান দিল। শুরু হল যাত্রা নতুন দিনের পথে…

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?