বাঁ পা টা ডান পায়ের ওপর তুলে দিল সে। শেষ তিন ঘণ্টায় এটাই ছিল তার প্রথম নড়াচড়া। ঠোঁটের ওপরটা একবার জিভ দিয়ে বোলালো। পিঠের ওপরে থাকা ক্যামেলব্যাক ডিহাইড্রেশন প্যাকের সরু নলটা মুখে নিল ও। শুধু একটা ছোট্ট সিপ। মিষ্টি মিষ্টি হাইড্রেটেড লিকুইড জিভ বেয়ে নেমে গেল নিচে। ও শুনেছিল ডিআরডিও বানিয়েছে এই স্পেশাল লিকুইড। এক সিপ মানে ৪৫ মিনিট জলের চাহিদা থাকবেনা। ওর চোখ পড়ল পাশেই চিৎ হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা শক্ত পোক্ত চেহারার লম্বা ছেলেটার মুখের ওপর। ঘুটঘুটে অন্ধকারেও চোখের নাইট ভিশন ডিভাইসে একটা হাল্কা সবজে আভা। ইনফ্রারেড ইল্যুমিনেশনে দেখা গেল পাশের বার্চ গাছটার গুঁড়ি থেকে গুঁড়ি মেরেই কখন উঠে এসেছে পাহাড়ি বিছেটা। ছোট কিন্তু একটু সামান্য বিপদের সম্ভাবনাতেই বিষাক্ত হুল ফুটিয়ে দিতে ওস্তাদ এই বিছেগুলো। ছেলেটার গালের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে কপালের দিকে এগোল বিছেটা। সাদার ওপর কালো ক্যামুফ্ল্যাজ দাগ কাটা জমিটা পেরিয়ে ওপাশের ঘন ঘাসজমিতে নেমে গেল সেন্টিপেডটা। চোখ খুলে লম্বা ছেলেটা তাকাল একবার। বিছেটা বোঝেই নি ওটা মানুষের মুখ ছিল। আসলে হিট সেন্সর এড়ানোর জন্য যে হাল্কা মাটির আস্তরন মুখে লাগানো থাকে বিছেটা তাকেই সাধারন মাটি বলে ভুল করেছিল। ওরা ৬ জন ছড়িয়ে ছিল ৩oo মিটার জায়গা জুড়ে। একটা শুকনো নালার পাশে বুড়ো শ্যাওলা পড়া বার্চ গাছটার নিচের ঝোপের ভেতরে ছিল ওরা দুজন, বাকিরাও অমনভাবেই, ঘন জঙ্গলের ভেতরে ছায়া হয়ে। ওরা এখনও ছায়া হয়েই থাকবে, যতক্ষন সময় না হয়, যতক্ষন না নির্দেশ আসে। পির পাঞ্জালের মাথার ওপর ঘন কালো আকাশে তখন লক্ষ তারার মেলা। মঘা নক্ষত্র ধীরে ধীরে ঢলছে কেতুর দিকে। একটু পরেই কৃষ্ণ চতুর্দশী, মহাদেব জাগছেন।

২৮শে সেপ্টেম্বর, রাত ২২:৩০ঃ পুঞ্চ থেকে ২৮০ কিলোমিটার দূরে উধমপুরে নর্দান আর্মি কমান্ডের সদর দপ্তরে তখন চূড়ান্ত ব্যস্ততা। লেঃ জেনারাল ডি.এস. হুদা তখন উধমপুর থেকে নয়া দিল্লীর সাউথ ব্লকে মিলিটারি অপারেশন রুমে সিকিওর ইনজিনিয়ারড লিংকে যুক্ত, ভিডিও কনফারেন্সিং এ আপডেট দিচ্ছেন ডিজিএমও লে: জেনারাল রনবির সিংকে। জানিয়ে দিচ্ছেন ২৭ তারিখের সন্ধ্যাতেই ১০ ডোগরা, ৬ বিহার আর ১৯ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ানের ঘাতক প্ল্যাটুনের কমান্ডোরা পৌছে গিয়েছে টার্গেটের কাছাকাছি। আর বাকি “ছেলেরা” তৈরি।

রাত ২৩-ooঃ লেঃ জেঃ হুদার সামনের স্ক্রীনে এবার নতুন তিনজন। উঠে দাঁড়ালেন হুদা, সামনে স্বয়ং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিক্কর, জেনারাল দলবীর সিং সুহাগ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার অজিত ডোভাল। নর্দান কমান্ডের প্রধান হিসেবে লে: জে: হুদা ব্যাখ্যা করে বোঝালেন টার্গেট এবং আক্রমনের পরিকল্পনাটি৷ তিন দিকের দেওয়ালে দেওয়াল জোড়া মনিটর। একদিকের মনিটরে ভেসে উঠল এনটিআরও-র লাইভ ফিড। রাত ২১:০০ টার কিছু পরেই উধমপুর বেস থেকে উড়ে গেছিল হেরন ইউএভি৷ শক্তিশালী ইনফ্রারেড ক্যামেরায় তখন ঘাতক প্ল্যাটুন এর কমান্ডোরা। সবুজ মনোক্রমে ঘাতক কম্যান্ডোদের ব্যাকপ্যাকের পেছনে লাগানো আইআর প্যাচ জঙ্গলের ভেতরে তাদের পজিশান বোঝাচ্ছিল। লে.জে. হুদার গলা ভেসে এল – “এলওসি থেকে ২৫০ কিলোমিটার রেডিয়াসে আমরা বেছে নিয়েছি কেল, লিপা, ভিমবের, নৌশার। আমাদের টার্গেট সাতটি লঞ্চপ্যাড। …”

লে.জে. হুদা যখন তার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে বোঝাচ্ছেন আক্রমনের রূপরেখা তার বেশ খানিকক্ষণ আগেই উধমপুরের অন্যপ্রান্তে দুটো ধ্রুব হেলিকপ্টারে সওয়ার হয়েছে ৪৮ জন প্যারা এসএফ কম্যান্ডো। নাইন প্যারা (এসএফ) এর কর্নেল কপিল যাদব আর ফোর প্যারা (এসএফ) এর কর্নেল জে.এস.সান্ধু নিজেরা বেছে নিয়েছেন তাদের সেরা অপারেটিভদের। ২৪ জন করে মোট ৪৮ জন। নামার পরেই ৬ জন করে চার টি দলেভাগ হয়ে যাবে তারা। ঘাতক জওয়ান দের বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আক্রমন করবে প্যারা (এসএফ)এর অপারেটিভরা। শিকারের ভাগ তারা অবশ্যই পাবে কিন্তু তাদের মূল কাজ হবে প্যারা ( এসএফ) এর রিয়ার এবং ফ্ল্যাংক গার্ড দেওয়া। খানিকক্ষণের মধ্যেই তাদের হেলিকপ্টার পৌছে যায় মেন্ধার সেক্টরের কেল, টুটমারি গলি, নাংগিটেকরি আর বালনোই এলাকাতে। রাত বারোটার কিছু আগেই কম্যান্ডোরা পার হয়ে যায় এলওসি-র তার কাঁটার বেড়া। রাত একটার মধ্যেই অন্ধকার জঙ্গল, শুকনো গিরিখাত, পাকিস্তানি ইলেকট্রনিক সারভেইলেন্স সেনসর পেরিয়ে কম্যান্ডোরা পৌছে যায় ডেসিগনেটেড কো অর্ডিনেটে। শুরু হয় প্রতীক্ষা। মহাদেবের জাগার জন্য।

রাত ২-৩০ঃ
“আন্ধেরা আপকি দোস্ত হ্যায়, সায়া নেহি আপকো আন্ধেরা বননা হ্যায়”। ওর মনে পড়ছিল কর্নেল সান্ধুর কথা। অন্ধকার ওদের বন্ধু। ওরা প্যারা (এসএফ)। ভারতের সেরার সেরা বাহিনী। “No mercy, this mission is to kill each and everyone – এক ভি বাদ না যায়৷” দাঁতের নিচে ঠোঁট চেপে ও মনে মনে বলল “কোই জিন্দা নেহি রহেগা “। ইয়ারপিসে গ্রুপ লিডারের গলা ভেসে এল। “থ্রী মিনিটস টু H Hour”৷ ওর ঘড়িতে সময় ০২-৩০। সস্নেহে একবার হাত বুলিয়ে নিল পাশে শোয়ানো ট্যাভরটাতে। ১৫ কেজির ব্যাকপ্যাকটা পিঠে উঠে গেছে অনেকক্ষন। ডান দিকে শোয়ানো RP07 ফ্লেম থ্রোয়ারটা নিঃশব্দে ঘাড়ের ওপর উঠে গেল ওর। ৬ জনের গ্রুপটাতে ও হল মূল ডেমোলিশান ম্যান। ৬-৫-৪ -৩ – ২-১ … রাতের অন্ধকার আর নৈঃশব্দ ভেঙ্গে খান খান। PK মেশিনগানের র‍্যাটট্যাটট্যাট ৫o মিটার দূরে থাকা জঙ্গীদের লঞ্চপ্যাডের কুঁড়েঘর গুলোকে ফুঁড়ে দিল। দুদিকের দুটো গাছের মাথায় থাকা আধঘুমন্ত পাহারাদাররা গাছের ওপরেই খতম। পাকিস্তানী আর্মির পোষাকে কয়েকজন ঘর থেকে AK47 নিয়ে বেরোনোর মুখেই M203 গ্রেনেড লঞ্চার কাম অ্যাসল্ট রাইফেলের গ্রেনেড আর গুলিতে ঝাঁঝরা।

কৃষ্ণচতুর্দশী শুরু। রুদ্র দেব জেগেছেন। প্রলয় শুরু।

মহাদেব যেন সাক্ষাৎ ভর করলেন ওর ওপর। কাঁধের RPO-A Bumblebee তাক করল সে একটা বেশ বড় কুঁড়ে ঘরের দিকে। ঢাকনা খুলে ট্রিগার টেপার সাথে সাথেই রকেটটা তীর বেগে একটা ধোঁয়ার রেশ রেখে বেরোল লঞ্চার থেকে। প্রথম বিস্ফোরনটা হওয়ার সাথে সাথেই রকেটটার ফুয়েল ট্যাঙ্ক থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে মিশে গেল বাতাসে। মূহূর্তের মধ্যে ধোঁয়া ছড়িয়ে গেল ঘরগুলোর চারিদিকে। এবারে হল দ্বিতীয় বিস্ফোরন। বিস্ফোরেনের সাথে সাথে বাতাসের অক্সিজেনের সাথে ফুয়েলের ধোঁয়া মেশার সাথেসাথে আগুন ধরে গেল। মুহূর্তে তাপমাত্রা হয়ে গেল ৩০০০ ডিগ্রী। মাটি আর পাথরের ঘরগুলোর ভেতরে বাইরে তখন পৃথিবী কাঁপানো বিস্ফোরন আর আগুন। মাত্র ৪o মিনিটে অপারেশন শেষ। পড়ে থাকল কিছু গুলিতে ঝাঁঝড়া হওয়া পাকিস্তানি সেনা, পুড়তে থাকা বেশ কিছু লস্কর-এ-তৈবা, জামাত-উল-মুজাহিদ্দিন -এর জঙ্গীর মৃতদেহ, যাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ভারতে ঢুকে নিরীহ জনসাধারনের নৃশংস হত্যা।

ভোর ৪-৩০ঃ
কালো রাতের আকাশে শুকতারা তখন পূবদিকে ঢলে পড়েছে। ৫০০ মিটার দূরে জঙ্গলের ভেতরে থাকা ১০ ডোগরার ঘাতক প্ল্যাটুনের ক্যাপ্টেন স্যাটেলাইট রেডিও আর ভিডিও কাস্টিংএ প্যারা(এসএফ) এর তান্ডবলীলার সরাসরি সম্প্রচার করল। উধমপুরে লে.জে. হুদার সামনের ভিডিও মনিটরে মোট সাতটি লঞ্চপ্যাডে ধ্বংসের ছবি। একই সাথে আরও ছটি লঞ্চপ্যাড একই সময়ে ধ্বংস হয়েছে। এবার শুরু হল একসফিলট্রেশন।

জঙ্গী লঞ্চপ্যাড ছেড়ে এলওসি-তে পৌছাতে প্যারা (এসএফ) কম্যান্ডোদের সময় লেগেছিল মাত্র দেড় ঘন্টা। ফেরার সময় নাইন প্যারা (এসএফ) এর এক জওয়ানের পা একটি মাইনের ওপর পড়াতে সে চোট পায়। সকাল ৬টার মধ্যে প্যারা(এসএফ) কম্যান্ডোদের দুটো ধ্রুব হেলিকপ্টারে করে পৌছে দেওয়া হয় উধমপুর আর নাগরোটাতে।

ঝকঝকে নতুন একটা দিন শুরু হল। খানিকপরেই দিল্লীতে ডিজিএমও ঘোষনা করবেন সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে পিওকে তে ৭টি জঙ্গী লঞ্চপ্যাড ধ্বংস হয়েছে।

উরির ১৮ জন জওয়ানের মৃত্যুর বদলা সম্পূর্ণ।

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?