বাঁশঝাড়টার পাশ দিয়ে দিনেই কেউ যায় না। আর রাতে? কিন্তু সেই যেতেই হচ্ছে। পূর্ণিমার চাঁদের আলো এই নিশ্ছিদ্র বাঁশপাতার কাছে হার মেনেছে। আলো আঁধারির খেলা। হাতের মিটমিটে টর্চের আলোটা হাতেই শেষ। খসখসে আওয়াজটা তক্ষুনি কানে এল। কুকুর? কই কোথায়? আবার আওয়াজ। এবারে পেছন থেকে। কেউ কি নিঃশ্বাস ফেলল? এত ঠাণ্ডা লাগছে কেন হঠাৎ? গলার ভেতরের শুকনো ভাব আর শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে হিমেল ঠাণ্ডা কি যেন নেমে যাওয়া… পা দুটো পাথরের মতন ভারি হয়ে যাওয়া… হাতের তালু আর পায়ের তালুতে বিন বিনে ঘাম – মশাই, ঘাবড়াবেন না একদম। অন্য কিছু নয়. আসলে আপনি ভয় পেয়েছেন।

শুধু আপনি নন, ভয় একটি বিশ্বব্যাপি অনুভূতি। আসলে ভয় হোল এক আদিম ডিফেন্স সিস্টেম, প্রাচীণ কিন্তু অত্যন্ত এফেক্টিভ। প্রকৃতির সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতি যেটা মানুষ দেখতে পায় না তার সম্পর্কে আগাম সতর্কবার্তা দেয় ভয়৷ কিন্তু ভয়ের স্বরূপটা কি? কি হয়, যখন আমরা ভয় পাই? কিভাবে উপকার করে এই ভয়?

বিজ্ঞান কি বলছে?
বিজ্ঞান ভয়ের ব্যাখ্যা করেছে কেমিস্ট্রি দিয়ে। পারিপার্শ্বিকের প্রভাবে মস্তিষ্ক কখনও কখনও এক বিশেষ রকমভাবে সাড়া দেয় এবং তার ফলে শরির এক বিশেষ ধরনের পরিস্থিতির জন্য তৈরি হয়। এই পরিস্থিতির নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন ‘Fight or Flight’ মানে ‘মারো অথবা ভাগো’ পরিস্থিতি। মস্তিষ্ক বিশেষ ধরনের কেমিকেল নিঃসরন করে হৃৎপিন্ডের গতি বাড়িয়ে দেয়, পঞ্চেন্দ্রিয়কে অতিরিক্ত মাত্রায় সচেতন করে তোলে এবং প্রায়শই হাত এবং পায়ের পেশি দৃঢ় করে তোলে। অর্থাৎ শরির আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য তৈরি হয়।

একটু দেখা যাক পরিস্থিতিটা কেমন হয়। চলুন, ফিরে যাত্তয়া যাক বাঁশঝাড়টার কাছে। নির্জন জায়গা। জায়গার বিশেষত্ব সম্পর্কে আপনার চোখ, নাক, কান ইনফরমেশন পাঠাতে শুরু করেছে ব্রেনের থ্যালামাস অংশটির কাছে। থ্যালামাস কাজ করে অনেকটা রিসিভিং স্টেশনের মতন। সংকেত পাওয়ার সাথে সাথে থ্যালামাস দুটো রাস্তা দিয়ে সেই ইনফরমেশন ব্রেনের আরো গভীরে পাঠায়। একটা রাস্তা হল হাই রোড আর অন্যটা লো রোড। হাই রোড যায় আমাদের ব্রেনের করটেক্স অংশে। আর লো রোড যায় ব্রেনের অ্যামিগডালা অংশে। ভয় পেলে আমাদের যে ন য যৌ ন তস্থৌ অবস্থা হয় সেটা এই অ্যামিগডালারই কেরামতি। তো, বাঁশঝাড়ের পাশের গা ছমছমে নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আপনার সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো বিশেষ করে চোখ আর কান এর পাঠানো ইনফরমেশন অপটিক আর অডিটরি নার্ভের মাধ্যমে এসে পৌছায় ব্রেনের থ্যালামাসে। গা ছমছমে নির্জন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যে ইনফরমেশন চোখ আর কান পাঠিয়েছে সেটা থ্যালামাস রিলে করেছে কর্টেক্সে। কর্টেক্স এক দুই সেকেন্ডের মধ্যে ইনফরমেশন এর থ্রেট পসিবিলিটি কতটা সেটা হিসেব করে নির্দেশ পাঠিয়েছে, “জায়গাটা সুবিধের নয় হে, জলদি পার হও।” এবং আপনি অতি দ্রুত পার হওয়ার চেষ্টা করছেন। আপনি চিন্তিত হয়েছেন কিন্তু ভয় পাননি। কিন্তু খসখস আওয়াজটা? অডিটরি নার্ভ থ্যালামাসে ইফরমেশনটা দেওয়ার সাথে সাথেই থ্যালামাস সেটা হাই রোডে না পাঠিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে লো রোডে, কারন, এবারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভীষণ দ্রুত। লো রোড বরাবর সেই ইনফরমেশন অ্যামিগডালায় পৌছায়। অ্যামিগডালা এবারে সেটা পাঠায় ব্রেন স্টেমের প্যারাকুইডাকটাল গ্রে বলে একটি অংশে। প্যারাকুইডাকটাল গ্রে অংশে ইনফরমেশন পৌছানর সাথে সাথেই আপনি হয় থমকে যান না হলে ভীষণভাবে চমকে লাফিয়ে ওঠেন। একই সাথে অ্যামিগডালা ব্রেনের হাইপোথ্যালামাস নামের আর একটা জায়গাতেও ইনফরমেশন পাঠায়। হাইপোথ্যালামাস কন্ট্রোল করে আমাদের অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমকে।

হাইপোথ্যালামাসের নির্দেশে শরিরের বিশেষ পরিবর্তনগুলো এবার হতে শুরু করে। সঙ্কেত পৌছায় আপনার অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ডে। রক্তে মেশে অ্যাড্রেনালিন আর কর্টিসোল হরমোন। অ্যাড্রেনালিনের বিশেষ পরিচিতি আছে আপৎকালীন হরমোন হিসেবে। এদের প্রভাবে হার্টবিট বেড়ে যায়, চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, মাংশ পেশি শক্ত হয়ে ওঠে৷ এদিকে হার্ট বিট বেড়ে ওঠায় শরীরের কোষে কোষে বিপুল পরিমানে অক্সিজেনের সরবরাহ হতে থাকে। অতিরিক্ত কর্মতৎপরতার জন্য শরীর গরম হয় ওঠে।ঠাণ্ডা করার জন্য কপাল, হাতের তালু ঘেমে ওঠে। মানে এককথায় যাকে বলা হয় ফ্লাইট অর ফাইট সিচুয়েশন, তার জন্য শরির তৈরি হয়।
সহজ কথায় আপনি ভয় পান।

কিন্তু শরিরের লাভ কি? মানে ভয় পাওয়ার ফলে আপনার কি উপকার হ’ল?

হয়েছে, অবশ্যই লাভ হয়েছে। ভয় আমাদের জিনের একটা অংশ হয়েছে বহু লক্ষ বছরের অভিযোজনের ফলে। পৃথিবীতে আদিম মানুষের সারভাইভাল অন্য অনেক জন্তু জানোয়ারের থেকে অনেক কঠিণ ছিল। গায়ে গতরে শক্তির অভাবে, শক্তশালী নখ, দাঁত না থাকার ফলে বেঁচে থাকার জন্য ব্রেনের ওপরেই অনেক বেশি নির্ভরশীল হতে হয়েছিল আদিম মানুষকে। এই হাই রোড আর লো রোডের উৎপত্তিও এই সময়ে। চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতা ব্রেনের কর্টেক্স অংশের ওপর থাকলেও ভয়ের অনুভূতির বিষয়ে দায়িত্ব চলে গেছে অ্যামিগডালার কাছে। ভয়ের স্বাভাবিক রিয়্যাকশান অর্থাৎ – থমকে যাওয়া, শরীরকে পরিস্থিতি সম্পর্কে আরো গভীরভাবে ভাবতে সাহায্য করে। থ্রেট পারসেপশন বা বিপদের বিষয়ে আগাম সচেতন হওয়াটা বিপদের সামনে জয়লাভ করতে মানুষকে বাড়তি অক্সিজেন দেয়। ফ্লাইট অর ফাইট সিচুয়েশনের জন্য শরীরের হার্টবিট বাড়িয়ে বাড়তি অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে যাতে পালাতে অথবা লড়াই করতে শরীরের কোন কষ্ট না হয়।

তবে এখানে একটা জিনিস বলে রাখা ভাল, যে ইভোল্যুশানের অন্তিম লগ্নে পৌছে মানুষ কিন্তু সাধারনভাবে ফ্লাইট মানে পালানোটাকেই বেঁচে থাকার সবথেকে বড় স্ট্র্যাটেজি বলে মেনে নিয়েছে। সুতরাং এর পরে আপনি রাতের বেলায় হঠাৎ ফিসফিসানিতে যদি ভয় পান লজ্জা পাবেন না। বরং ‘যঃ পলায়তি সঃ জীবতি’ স্ট্র্যাটেজিটাই অবলম্বন করুন। লাখো বছরের অভিযোজন আপনাকে এটা করার শিক্ষাই দিয়েছে। সুতরাং …

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?