কি হয় নেশা হলে? নেশাগ্রস্ত মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে এমন কি হয় যাতে একজন নেশাড়ু নেশা ছাড়া থাকতে পারে না? বহুদিন ধরে বিজ্ঞান এর উত্তর খুঁজেছে। দেখা যায় মদ, গাঁজা, হেরোইন, কোকেন, ডেনড্রাইট -এ যেমন মানুষের আসক্তি থাকে ঠিক একইভাবে পর্ণ সিনেমা, খাওয়া এমন কি হাল আমলের ফেসবুক টুইটার প্রীতি অথবা মোবাইলের সেলফি ক্রেজ-এও মানুষ একইভাবে আসক্ত হয়। ঠিক মাদকদ্রব্যর মতনই নির্দিষ্ট সময়ে এই জিনিসগুলো করতেই হয়, না হলে হেরোইন কোকেনের মতন উইথড্রয়াল সিম্পটম দেখা দেয়। তো, আসুন জেনে নেওয়া যাক নেশার সাতকাহন। এর সাথেই আপনাদের সাথে আলাপ করিয়ে দেব আমাদের রাজ আর অনির সাথে। রাজ আর অনি দুই বন্ধু। নিজেদের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে ওরা আপনাদের অনেক কিছু জানাবে।


রাজ: নাঃ মহাদেবও পারতেন না. বুঝলি অনি।

অনি: অ্যাঁ, সে কি নাস্তিক বাবার মুখে যে দেখি মহাদেবের নাম! বলি ব্যাপারটা কি? কি পারতেন না?

রাজ: সামলাতে।

অনি: দ্যাখ, ভড়ং ছাড়। ঝেড়ে কাশ দেখি। কি বলতে চাইছিস?

রাজ: আরে গাঁজা মানে নেশার কথা বলছি। মহাদেব গাঁজার নেশা করেন তো, যদি ছাড়তে চেষ্টা করতেন সামলাতে পারতেন না।

অনি: বলিস কি? তাঁরা কি সব নশ্বর মানুষ? দেবতারা সব পারেন। সৃষ্টি-রক্ষা-সংহার সব…

রাজ: ওরে থাম থাম হাঁপিয়ে যাবি রে। ওনার সাথে আমার আলাপ নেই কিন্তু যেসব নেশাড়ুদের সাথে আছে তাদের ঘেঁটে বুঝেছি নেশা ছাড়াটা খুব একটা সহজ কাজ নয়।

অনি: কেন নয়? ধূমপায়িরা বিড়িসিগারেট না খেলেই নেশা ছেড়ে যাবে …

রাজ: হ্যাঁ, তোর যেমন চৈতির বাড়ির সামনে দিয়ে সাত দিন না গেলেই প্রেমের নেশা কেটে যাবে আর কি!!!!

অনি: এ তুই কার সাথে কার তুলনা করছিস? গাঁজা হেরোইনের চরসের নেশার সাথে প্রেম? এতো চাঁদের সাথে ইয়ের তুলনা!?!

রাজ: হুম্, যথারীতি তোকে নিয়ে সেই কেঁচে গন্ডূষই করতে হবে।

অনি: আচ্ছা আচ্ছ্‌ সবজান্তা মশাই, ব্যাপারটা কি একটু খুলেই বল না হয়।

রাজ: হুম্ বেশ। তবে তার আগে জানা দরকার, আনন্দ কি, সেই বিষয়ে তোর কোন স্পষ্ট ধারনা আছে কিনা । মানে আনন্দ কেন হয়, শরীরের কোথায় কিভাবে তৈরি হয় আনন্দের অনুভূতি?

অনি: মানে তুই ব্রেনের কথা বলছিস তো? ব্রেনের ভেতরেই এসব কাণ্ডকারখানা হওয়ার কথা।

রাজ: একদম ঠিক। ব্রেনের ভেতরেই আছে এক ‘প্লেজার সার্কিট’। আর এই ‘প্লেজার সার্কিট’ ই তৈরি করে আনন্দ অনুভূতি। তবে আশ্চর্য্য ব্যাপার হল, ড্রাগস, মদ, ইত্যাদীতে যে অনুভূতি (আনন্দ!) ঠিক সেই একই অনুভূতি হয় প্রেমে পড়লে অথবা ভাল খাবার খেলে এমনকি তুই যখন মোবাইলে লুকিয়ে ইয়ে দেখিস তখনও। মানে আনন্দের অনুভূতি একই হবে, যদিও আনন্দের ট্রিগার মানে কারনগুলো আলাদা হতে পারে।

অনি: ….

রাজ: বাক্যি সরছে না দেখছি, এবার বুঝলি, প্রেমের নেশা আর ড্রাগের নেশার কোন পার্থক্য তোর আমার ব্রেন করেনা!!?আনন্দানুভূতি দুক্ষেত্রেই এক।

অনি: কিন্তু আনন্দানুভূতির জন্ম হয় কোথায়? কিভাবে হয়?

রাজ: তার আগে তোকে নিউরোট্রান্সমিটারের বিষয়ে কিছু বলে নি। নিউরোট্রান্সমিটার হল এক বিশেষ ধরনের প্রোটিন যারা নিউরোনের ভেতরে ইমপালসকে এক নিউরোন থেকে আর এক নিউরোনে পরিবহন করে। এককথায় বলতে পারিস নিউরোট্রান্সমিটার হল শরিরের বিভিন্ন অনুভূতির পরিবহনের কমিউনিকেশন সিস্টেম। আনন্দের অনুভূতির জন্ম এইরকমই এক নিউরোট্রান্সমিটারে। এই বিশেষ নিউরোট্রান্সমিটারের নাম ডোপামাইন। ব্রেনের সেরিব্রাল করটেক্স এর নীচে থাকা নিউক্লিয়াস অ্যাকুমবেনসের নিউরোনগুচ্ছের মধ্যে ডোপামাইনের পরিমান বৃদ্ধির ফলে আনন্দের জন্ম হয়।

অনি: ও সেজন্যই কি ড্রাগ নেওয়াকে আমেরিকায় ডোপ নেওয়া বলে? ডোপামাইন থেকে ডোপ??

রাজ: ভালই বললি তো, হতেই পারে!

অনি: প্লেজার তো হল, কিন্তু নেশার সময় হয়টা কি?

রাজ: দ্যাখ, আমাদের ব্রেন স্বাভাবিকভাবেই প্লেজার পেতে চায়। কি কি কারনে প্লেজারের অনুভূতির সৃষ্টি হয়, সে সময়ের পরিবেশ কেমন ছিল এমন কি কতটা আনন্দ অনুভূতি তৈরি হয়েছিল তার একটা পুংখানুপুংখ রেকর্ড ব্রেন রেখে দেয়। এবং সেই আনন্দের অনুভূতি আবার পাওয়ার জন্য শরির কে মুখিয়ে থাকতে বলে।

অনি: ব্রেনের ভেতরে ডোপামাইনের খেলাটা কিভাবে হয়, সেটা একটু বল।

রাজ: বিশেষ পরিস্থিতি মানে আনন্দদায়ক পরিবেশ তৈরি হওয়ার সাথে সাথে নিউক্লিয়াস অ্যাকুমবেনস এর নিউরোনগুলোতে ডোপামাইনের পরিমান বাড়তে থাকে। এরপরে তা নিউরোন থেকে বেরিয়ে আন্তঃনিউরোনিয় বা সাইন্যাপটিক গ্যাপ পেরিয়ে পাশ্ববর্তি নিউরোনে প্রবেশ করে এবং একটি ইমপালসের জন্ম হয়। ডোপামাইনের সমস্ত অনু পরের নিউরোনে প্রবেশ করতে পারে না। ফ্রি অনু আবার তার পেরেন্ট নিউরোনে ফিরে যায়। সাইন্যাপটিক গ্যাপে ডোপামাইনের পরিমান কমে গেলে আনন্দানুভূতি কমে যায়। আর এখানটাতেই ড্রাগের মতন জিনিসগুলো তাদের খেলা দেখাতে পারে।

অনি: কেমন খেলা?

রাজ: মনে রাখতে হবে, সাইন্যাপটিক গ্যাপে ডোপামাইনের উপস্থিতি যত বেশিক্ষণ স্থায়ি হবে আনন্দ তত বেশিক্ষণ ধরে উপভোগ করা যাবে। সুতরাং একস্ট্রা ডোপামাইন যেটা পাশ্ববর্তি নিউরোনে প্রবেশ করতে পারেনি সেটাকে তার পেরেন্ট নিউরোনে আবার ঢুকতে বাধা দিলেই সাইন্যাপটিক গ্যাপে ডোপামাইনের পরিমান বেশি থাকবে, আনন্দ (ecstassy) দীর্ঘায়িত হবে। নিকোটিন, কোকেন, হেরোইনের মতন দ্রব্যগুলো ডোপামাইনের ফিরে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়। ফলে আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়।

অনি: কিন্তু অ্যাডিকশনটা হচ্ছে কিভাবে?

রাজ: ওই যে বললাম, নর্মালি ব্রেন সর্বদাই চেষ্টা করে এমন কাজ করতে যাতে প্লেজার সার্কিট অ্যাক্টিভেটেড হয়। স্বাভাবিকভাবে প্লেজার সার্কিট অ্যাক্টিভেট করতে নিউক্লিয়াস অ্যাকুমবেনসে যে পরিমান ডোপামাইন তৈরী হয়, ড্রাগ তার ১০থেকে ২০ গুন বেশি ডোপামাইন তৈরী করতে পারে। এই ডোপামাইন জেনারেশান ইন্সট্যান্ট হয় বলে ব্রেনকে সময় এবং অভিজ্ঞতার ওপরে নির্ভর করতে হয়না। ডোপামাইন এই সময়ে আরো একটি নিউরোট্রান্সমিটারের সাথে ইনটারঅ্যাক্ট করে। এর ফলে রিওয়ার্ড সার্কিটের পাশাপাশি মেমোরি এবং লার্নিং সার্কিট অ্যাক্টিভেটেড হয়। সহজে আনন্দ বা একস্ট্যাসি হওয়ার রাস্তা জানা হয়ে যায় বলে ব্রেন এই অস্বাভাবিক আনন্দ বারবার পেতে চায়। অ্যাডিকশান হয়। কিন্তু এর ভেতরে আবার বাধ সাধে টলারেন্স।

অনি: টলারেন্স?? মানে সহ্যশক্তি!? কিভাবে বাধ সাধে?

রাজ: যাক বাবুর ইন্টারেস্ট বাড়ছে, ভাল ভাল! দ্যাখ, বহু বছরের অভিযোজন আর অভিজ্ঞতা ব্রেনকে পরিবেশের সাথে দ্রুত খাপ খাওয়াতে শিখিয়েছে৷ দীর্ঘদিন ধরে সহজ পথে আনন্দ পাওয়ার জন্য ড্রাগ ইত্যাদীর ব্যবহারের ফলে নিউরোনের ভেতরে বাইরে ডোপামাইনের রমরমা, ব্রেনের সিকিউরিটি সিস্টেমকে অ্যাক্টিভেট করে দেয়। ফলে নিউক্লিয়াস অ্যাকুমবেনসের নিউরোনগুলো ডোপামাইন তৈরি কম করে দেয় অথবা নিউরোনে ডোপামাইন রিসেপ্টর এর পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ফলে যে পরিমাণ ড্রাগ নিলে দুদিন আগে যে পরিমাণ আনন্দ হ’ত এখন আর তা হয় না। ডোপামাইন উৎপাদন কমে গেছে যে! সুতরাং ড্রাগের পরিমাণ বাড়াতে হয় ডোপামাইন উৎপাদন বাড়ানোর জন্য।

অনি: তাহলে তুই বলছিস ড্রাগ , পর্ণ মানে এইসব জিনিসের কল্যানে ডোপামাইন উৎপাদন হবেই আর তার সাথে আনন্দ…

রাজ: ঠিক তাই। ডোপামাইন আনন্দের অনুভূতি দেবে। আনন্দ- লার্নিং- মেমোরি সার্কিটের ত্র‍্যহস্পর্শে আনন্দ চেঞ্জ হয়ে অ্যাডিকশন হবে৷ একইসাথে ড্রাগ অথবা সেক্স, আনন্দের উৎস যাই হোক না কেন সেটা পরিমানে বাড়বে। অনন্ত তৃষ্ণা আর মিটবেনা।

অনি: আর উইথড্রয়াল সিম্পটম?

রাজ: উইথড্রয়াল সিম্পটম ব্রেনের আর এক রহস্য। অ্যাদ্দিন পর্যন্ত তৃষ্ণা মেটার ব্যাপারটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু নিয়ত তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে ব্রেন নিজের অজ্ঞাতেই নেশার বস্তুটির অধীন হয়ে গেছে। যদি একজন অ্যাডিক্ট নেশা ছাড়ার চেষ্টা করে, তাহলে তার ব্রেনই বাধা দেয়। নির্দিষ্ট সময়েআনন্দ পাওয়াতে অভ্যস্ত ব্রেন নেশার বস্তুটি না পেলেই শরীর কে বিদ্রোহী করে তোলার নির্দেশ দেয়।

অনি: বাপরে এত কিছু? নেশা কি তাহলে ছাড়া যায় না?

রাজ: যায়, যদি মনের জোর আর একটু মেন্টাল সাপোর্ট পাওয়া যায়। প্ল্যানটা হল যে কোন ভাবে আনন্দের সোর্সটাকে চেঞ্জ করতে হবে। ডোপামাইন বেরোক, আনন্দ হোক কিন্তু মস্তিষ্ক কোন একটি বিশেষ কারনে আনন্দ পাওয়াতে অভ্যস্ত না হয়ে উঠুক। সবথেকে ভাল হয় যদি ডোপামাইনের নিঃসরনকে কন্ট্রোল করা যায়, If brain is taught to find a new trigger to dopamine overdose। ড্রাগের নেশা ছাড়ানোর ওষুধগুলো এভাবেই কাজ করে। নিউরোন থেকে ডোপামাইন বেরোনোর পর উত্তেজনার প্রশমন ঘটে যখন ডোপামাইন সাইন্যাপটিক গ্যাপ থেকে আবার পেরেন্ট নিউরোনে ফিরে যেতে পারে। হেরোইন, মেথামফেটামাইনের মতন ড্রাগ ডোপামাইনের ফিরে যাওয়ার জায়গাটিকে ব্লক করে দেয়। নেশা ছাড়ানোর দাওয়াই সেই বদ্ধ জায়গাটি কে আবার মুক্ত করে ডোপামাইনের ফিরে আসার পথ করে দেয় এবং উত্তেজনার প্রশমণ হয়।

অনি: তোর দৌলতে নেশার দুনিয়ার বেশ একটা ঝোড়ো ট্যুর হয়ে গেল। ধন্যবাদ …

রাজ: শুকনো ধন্যবাদের নিকুচি করেছে। ‘ডি বাপি’তে চল বিরিয়ানি সাঁটাই।

অনি: তাই চল, একটু ডোপামাইনের খেলা দেখে আসি।

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?