রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধ- পটভূমি
ইউক্রেন একটি সময়ে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে সেই রাশিয়া এখনকার রাশিয়ার মতন ‘ছোট’ ছিল না। তখন তার নাম ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন (USSR), ১৫টি রিপাবলিক নিয়ে তৈরি এক বিশাল দেশ। মিখাইল গোর্বাচেভের পেরেস্ত্রোইকা এবং গ্লাসনস্ত এর ফল হিসেবে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। রাশিয়া, ইউক্রেন সহ অন্যান্য সোভিয়েত রাজ্যগুলি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখনও বিশ্বজুড়ে ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ আবহাওয়া চলছে ৷ স্বাধীনতার পর থেকেই ইউক্রেন হয়ে উঠল রাশিয়া এবং ইউরোপ-আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত দড়ি টানাটানি খেলার কেন্দ্রবিন্দু।
প্রথমদিকে ইউক্রেন নিরপেক্ষতা বজায় রাখত। কিন্তু ১৯৯৪ সাল নাগাদ ইউক্রেন বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের সাথে মিলিতভাবে বেশ কিছু প্রজেক্ট করতে শুরু করে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দেশের প্রতি ইউক্রেনের এই নৈকট্য রাশিয়ার মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল। রাশিয়ার ভয় মূলত ছিল সীমা সুরক্ষার। এমনিতেই পোল্যান্ডে NATO এর মধ্যেই বেশ কিছু মাঝারি এবং দূরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র রাশিয়ার বেশ কিছু শহরকে নিশানা করে ডেপলয় করেছিল। তার ওপরে ঘরের একেবারে চৌকাঠের কাছে ইউক্রেনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং NATO-র প্রভাব বৃদ্ধি রাশিয়াকে আতঙ্কিত করে তুলছিল।
এর মধ্যেই ২০০৪ সালে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভিকটর ইয়ানুকোভিচ জয়লাভ করেন৷ মতাদর্শগতভাবে তিনি ছিলেন রাশিয়াপন্থী। কিন্তু তাঁর জয়লাভের পরে পরেই ২০০৪ এর ডিসেম্বর থেকে ২০০৫ এর জানুযারির মধ্যে ইউক্রেন জুড়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ব্যাপক রিগিং-এর অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ শুরু হয় ৷ এর নাম ছিল ‘অরেঞ্জ বিপ্লব’৷ ‘অরেঞ্জ বিপ্লব’ -এর পেছনে NATO সদস্যভুক্ত দেশগুলির প্রচ্ছন্ন মদত ছিল। অরেঞ্জ রিভোলিশনের ফলশ্রুতি হিসেবে ইউক্রেনের সুপ্রীম কোর্ট পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আদেশ দেয়। নতুন নির্বাচনে ন্যাটোপন্থী ভিকটর ইউশচেংকো জয়লাভ করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ইউশচেংকো মারা যান। তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে রাশিয়ার বিরুদ্ধে৷
২০১০ সালে ভিকটর ইয়ানুকোভিচ আবার রাষ্ট্রপতি হন। রাশিয়ার অঙ্গুলিহেলনে ২০১৩ সালে তিনি Ukraine – European Union Association Agreement বাতিল করে দেন। ২০১৪ সালে দেশ জুড়ে ইয়ানুকোভিচের বিরুদ্ধে আবার বিক্ষোভ শুরু হয়। ২০১৪র এই বিক্ষোভকে ইউরো মেইডেন বিক্ষোভ বলা হয়। ‘অরেঞ্জ বিপ্লবের’ মতন এই বিক্ষোভের পেছনেও পশ্চিম মানে NATO অন্তর্ভুক্ত আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের হাত ছিল। বিক্ষোভের ফলে প্রায় ১০০ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়। ইয়ানুকোভিচ দেশ ছেড়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
এই ঘটনার পরেই রাশিয়া চরম পদক্ষেপ নেয়। ২০১৪ তেই রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া প্রদেশ দখল করে নেয়। কৃষ্ণসাগরের পাড়বর্তি ক্রিমিয়া প্রদেশের স্ট্র্যাটেজিক গুরত্ব ছিল অপরিসীম। এর বদলা হিসেবে আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত দেশগুলি রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। শুধু ক্রিমিয়া দখল করেই রাশিয়া থেমে ছিল না৷ রাশিয়ার গা ঘেঁষে থাকা ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে আছে দুটি প্রদেশ। ডোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক। দুটি প্রদেশের বেশিরভাগ মানুষই এথনিক রাশিয়ান। তারা বহুদিন ধরেই ইউক্রেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা চাইছিল ৷ ২০১৪ সালেই তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনে রাশিয়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদ্ৎ দিতে শুরু করে। ২০১৪ সাল থেকে চলা এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে প্রায় ১৪০০০ মানুষ প্রাণ হারিযেছেন।
ভিকটর ইয়ানুকোভিচের পরে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি হলেন পশ্চিমপন্থী পেত্রো পোরোসেংকো । ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি রাশিয়া এবং ডনবাস অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে বেলারুশের রাজধানী মিনস্ক – এ যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিতে ডোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক প্রদেশকে বেশি করে স্বায়ত্ত্বশাসন দেওয়ার কথা থাকলেও ইউক্রেন চুক্তি সম্পূর্ণভাবে মেনে চলেনি। এর ফলে মিনস্ক চুক্তি ব্যর্থ হয়। এর পরের বছর ২০১৫ সালে মিনস্ক শহরেই আবার একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে ডনবাস অঞ্চল থেকে বিদেশী সৈন্য সরানো এবং প্রকৃত স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদানের মত বিষয় থাকলেও কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় কোন পক্ষই সেগুলি পালন করছে না। মিনস্ক-১ চুক্তির মতনই মিনস্ক- ২ চুক্তিও ব্যর্থ হয়। রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং পশ্চিম সমর্থিত ইউক্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ চলতেই থাকে।
২০১৯ এর এপ্রিল মাসে ভোলোদিমির জেলেনস্কি ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। প্রাক্তন কমেডিয়ান এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি মিনস্ক২ এর চুক্তির বিষয়গুলি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। জেলেনস্কি ঘোষণা করেন যে ইউক্রেন NATO তে যোগদান করবে। ২০২০ র জুন মাস নাগাদ NATO ইউক্রেনকে Enhanced Opportunities Partner হিসেবে ঘোষনা করে। ইউক্রেন রাশিয়া সর্ম্পকের কফিনে এটিই ছিল শেষ পেরেক ৷ ২০২০ সালের শেষ ভাগ থেকেই রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্ত বরাবর সৈন্য সজ্জা বাড়িয়ে দেয়। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন NATOকে ইউক্রেন বিষয়ে নাক গলাতে কারণ করেন। এবং শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী ইউক্রেনের ডনেৎস্ক এবং লুহানস্কের বিচ্ছিন্নতাকামীদের সাহায্য করার নামে ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমন করে।
আর যুদ্ধ শুরু হয়।