ভিনগ্রহী…
তোবড়ানো বড় মাথাওয়ালা ইটি, না হলে হুডি-ওয়ালা জ্যাকেট পরা জাদু। ভিনগ্রহের প্রাণীর কথা বললে এরাই মাথায় ভিড় করে আসে। এখন অবশ্য শুধু সিনেমা নয়— হাড়গিলে গলা আর বড় বড় চোখ নিয়ে বিজ্ঞাপনেও তাদের অবাধ যাতায়াত। কিন্তু সবটাই কল্পনার পর্দায়। অবশ্য মাঝে মাঝেই পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে খোঁজ পাওয়া যায় উড়ন্ত চাকতির। সেই নিয়ে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের খেলায় মেতে ওঠে দু’পক্ষের মানুষ।
অন্য গ্রহের প্রাণীর প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরন্তন। কিন্তু সেই ভূতের গল্পের ঢঙে যদি জানতে পারেন, আপনার রোজকার দেখা পরিচিত কেউ আসলে ভিনগ্রহের প্রাণী তা হলে কি একটা ঠান্ডা শিরশিরানি নেমে যাবে না শিরদাঁড়া বেয়ে? নিশ্চিত করে বলা যাবে না, কিন্তু হলেও হতে পারে, আপনারই পরিচিত সে আসলে ভিনগ্রহের!
অবাক হলেন? তবে খুলেই বলি।
আপনার সেই পরিচিত প্রাণীটি অবশ্য মনুষ্যগোত্রীয় নন। তা ছাড়া তার সাথে সাক্ষাৎ পরিচয় করতে বাঙালিদের একটু কাঠখড় পোড়াতে হয় বইকী। আর সেই সাক্ষাতের সময় ঠান্ডা স্রোত শুধু শিরদাঁড়া নয় সারা গা দিয়েই নেমে যেতে বাধ্য। এমনিতে টিভি, বই, খবরের কাগজ আর ইন্টারনেটেই তার সাথে দেখা হয় আপনার। যারা দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি গেছেন তাদের সাথে এই ভিনগ্রহীর দেখা হয়েছে নিশ্চয়। প্রতি বছরে শুধু তাঁদের দেখতে ভালোই পর্যটকের ভিড় জমে। আশা করি, এবার বোঝা যাচ্ছে কার কথা বলছি। পক্ষী-গোত্রীয় হলেও কোট পড়া সাহেবের ঢঙে দু’পেয়ে পেঙ্গুইন সকলের কাছেই আলাদা ভালোবাসা আর সম্ভ্রমের দাবিদার। বলছি, এদের কথাই।
কিন্তু হঠাৎ এদের ভিনগ্রহী বলা হচ্ছে কেন?
প্রশ্নটা জেগেছিল লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের গবেষকদের মনেও। তাই নিজেদের পরীক্ষা থেকে পাওয়া ফলাফল বারবার আতসকাচের সামনে ফেলেছেন তাঁরা। এমন অসম্ভব একটা কথা সকলের প্রিয় পেঙ্গুইনদের সম্পর্কে বলার আগে অনেক বার ভাবতে হয়েছে তাঁদের। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় উঠে আসা তথ্যকে অস্বীকার করেন কী করে। তাই বলতেই হয়েছে, এই দু’পেয়ে পাখিদের দেহ থেকে পাওয়া ফসফিন পৃথিবীতে প্রায় পাওয়াই যায়না। একমাত্র মেলে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লক্ষ কিলোমিটার দূরে থাকা শুক্র গ্রহের বায়ুমণ্ডলে। সেখান থেকেই প্রশ্ন উঠে আসছে। তা হলে কি পেঙ্গুইনের আদি নিবাস আমাদের ভোরের আকাশে দেখা শুকতারাটায়? পৃথিবীর সাথে শুক্রের বায়ুমণ্ডলের সাদৃশ্য এই ধারণাকে জোরালো করেছে।
পৃথিবীর মধ্যে কিছু অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে থাকা অ-বায়ুজীবি ব্যাক্টিরিয়া এই প্রচণ্ড বিষাক্ত গ্যাস ফসফিন তৈরি করে। পুকুরের পাঁকে খুব সামান্য পরিমাণে এই গ্যাস পাওয়া যায়। কিন্তু এ পর্যন্ত জীবজগতের আর কোনও প্রাণীর দেহে এই যৌগ তৈরি হওয়ার খোঁজ মেলেনি। তবে পেঙ্গুইনের দেহের কী থেকে এই ফসফিনের খোঁজ পাওয়া গেল, সেটা জানার পর আপনি নাক সিঁটকাতে পারেন। ইম্পিরিয়াল কলেজের গবেষক ড. ডেভ ক্লিমেন্টস জানাচ্ছেন, আমরা গবেষণায় পাওয়া তথ্যকে অনেকবার নতুন করে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছি যে পেঙ্গুইনের গুয়ানো থেকে পাওয়া রাসায়নিকটি ফসফিনই। কিন্তু কী ভাবে তা তৈরি হচ্ছে, সেটা এখনও নির্ণয় করা যায়নি। এই গবেষণায় তাদের অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণ এই ফসফিন অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসা মাত্রই বিক্রিয়ায় বিনষ্ট হয়ে যায়। তাই এই নিয়ে আরও গবেষণার জন্য আরও অনেক পেঙ্গুইনের গুয়ানো ঘাঁটতে হবে গবেষকদের। সেই অনুসন্ধানে অনেক ধরনের আশার আলো দেখছেন তারা। অন্য গ্রহে থাকা প্রাণীদের প্রকৃতি নির্ধারণে নাকি এর পর থেকে কাজে লাগানো যাবে পেঙ্গুইনকে।
তবে শুধু এটুকুতেই শেষ নয় পেঙ্গুইনদের উৎস খুঁজতে এ বার মহাকাশেও খানাতল্লাশি চলবে এই বছরেরই ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ থেকে। গত বছরে শুক্র গ্রহের বায়ুমণ্ডলে এই ফসফিনের অস্তিত্ব জানার পর থেকেই পেঙ্গুইনের শুক্র-যোগ নিয়ে দুনিয়া তোলপাড়। এখন এই নিয়ে আরও বিশদ গবেষণার স্বার্থে নাসা, ইউরোপীয় ও কানাডার মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলি সম্মিলিতভাবে পাঠাচ্ছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। ফ্রান্সের এক মহাকাশকেন্দ্র থেকে আরিয়েন ৫ রকেটে চেপে এই টেলিস্কোপ পথচলা শুরু করবে মহাকাশে বিভিন্ন গ্রহে জীবনের সন্ধানে। তখনই আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে আমাদের প্রিয় পেঙ্গুইনদের কোনও আত্মীয়কুটুম্ব শুক্র গ্রহে বা অন্য কোথাও সংসার পেতেছে কি না। ততদিন অবধি পেঙ্গুইন পৃথিবীরই থাক।