সুতরাং পৃথিবী স্তব্ধ হইল। আগুন জ্বলিল। আমিষ এবং নিরামিষ অস্ত্রশস্ত্র বাহির হইল। মুহূর্তে আতঙ্ক গ্রাস করিল জনসাধারণকে। দুনিয়া দেখিল অবরোধ হইতেছে। কয়েকশত মনুষ্য স্তব্ধ করিয়া দিল জনজীবনকে। সভ্য দেশে অবরোধ একটি বে-আইনী কান্ড কিন্তু কিমাশ্চর্য্যম, এই অবরোধ উঠাইবার জন্য কোন আইনরক্ষকের দর্শন মিলিল না। অতএব, অবরোধে হাঁসফাঁস করিতে থাকা শিশুটির পিতা, অবরোধে আটকাইয়া থাকা মূমুর্ষূ রোগিটির পরিজন, গৃহে ফিরিতে ব্যস্ত হাজার হাজার মনুষ্য একটি প্রশ্নই করিতে থাকিলেন – “কেন? কেন এই দূর্ভোগ?”

কেন এই দূর্ভোগ? শোনা যাইতেছে এই অবরোধের কারন হইল এক দূর্বলমতি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ইসলাম ধর্মের প্রাণপুরুষ হজরত মহম্মদের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কিছু মন্তব্য এবং তজ্জন্য প্রতিবাদ। অর্থাৎ এই প্রতিবাদটি ধার্মিক। কিন্তু ইহা কেমন প্রতিবাদ, যে প্রতিবাদে আমার দ্বারা কারুর ক্ষতি সাধন হইতেছে? প্রতিবাদ করিতে গিয়া আমি তো আর একটি প্রতিবাদের কারন হইতেছি। তবে কি প্রতিবাদ নহে, দূর্ভোগ সৃষ্টিই হইল এই ‘প্রতিবাদের’ মূল উদ্দেশ্য?

অবশ্য বর্তমানে দূর্ভোগ সৃষ্টিই নজর কাড়িবার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা বলিয়া স্বীকৃত। অপরকে যত বেশি কষ্ট দেওয়া যাইবে তত খবরের শিরোনামে আসা যাইবে, তত দ্রুত সমাজ নির্দেশকদের চক্ষের মণি হইয়া ওঠা যাইবে। এ বিষয়ে বর্তমান যুব সম্প্রদায় বিশেষ দক্ষতা লাভ করিয়াছে। রাজনীতি হইতে পাড়ার দাদাগিরি হইতে সিন্ডিকেট রাজ যুব সম্প্রদায়ের গতি সর্বত্র। দেখা গেল ধর্মও তাহাদের আওতায় আসিল। ইংরাজিতে একটি কথা আছে – Fodder for the cannon, অর্থাৎ কামানের গোলা যাহা নিজে বিনষ্ট হইয়া অন্যকে বিনষ্ট করিবে। বর্তমান যুব সম্প্রদায়ের গরিষ্ঠ অংশের এই ‘কামানের গোলা’ হইয়া উঠিবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাইতেছে। তাহারা হয়ত দেখিতেছে না যে কামানের গোলাকে খাতিরযত্ন করা হয় শুধুমাত্র উহার আত্মাহুতির মাধ্যমে ধ্বংস সাধনের ক্ষমতার জন্যই। যাহাই হউক, যুব বাহিনী বাহির হইল। সামরিক শৃঙ্খলায় রাজ্যের বিভিন্ন সড়ক দখল হইতে লাগিল। স্থানে স্থানে গৃহে এবং ব্যবসাস্থলে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, বলপ্রয়োগ অর্থাৎ ‘প্রতিবাদ’ চলিতে লাগিল।

আগেই বলিয়াছি ‘প্রতিবাদটি’ ধার্মিক। যুক্তির বিচারে প্রতিবাদকারীটিও ধার্মিক হইবেন ইহাই অনুমেয়। ধার্মিক, অর্থাৎ ধর্মকে ধারন করিতেছেন যিনি। কিন্তু পাঠক, ওই ‘ধার্মিক’টিকে চিনিয়া রাখুন যিনি লৌহকিল যুক্ত বংশদন্ডটিকে উত্তোলন করিয়া সরকারি বাসের বয়স্ক চালকটিকে ‘চ’, ‘ব’ ,’শ’ তুলিয়া গালি এবং হুমকি দিতেছে, অথবা বিকৃত অঙ্গভঙ্গি সহ অন্য ধর্ম সম্পর্কে চরম অবমাননাকর মন্তব্য করিতেছে। কত সহজেই উহারা ‘অপরাধ না করা সত্ত্বেও যাহারা মুমিন পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তাহারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে’ (আহযাব ৩৩/৫৮) আয়াৎটিকে ভুলিয়া যাইতেছে। যে হাজার হাজার মনুষ্য, যাহাদের ভিতরে মুমিন পুরুষ এবং নারীরা রহিয়াছেন, এবং বিনা পাপে এই নরক যন্ত্রনা ভোগ করিতেছেন তাহার পাপের দায় কি ওই বকধার্মিক প্রতিবাদকারীটির ওপরেই বর্তাইবে না?

জিহ্বার ক্ষমতা ভীষণ। হিন্দীতে একটি কহবৎ আছে – “ইয়ে যো জুবান হ্যায় ইসমে হাড্ডি নেহি হোতা হ্যায়, মগর ইয়ে হাড্ডি তোড় ভি সকতা হ্যায় – জোড় ভি সকতা হ্যায়।” বক্তব্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। উচ্চারিত শব্দ, সম্পর্ক জুড়িতে পারে আবার ভাঙ্গিতেও পারে। যিনি বলিতেছেন জিহ্বাটি তাহার। সুতরাং জিহ্বার ধারের উপর নিয়ন্ত্রণের দায়টিও একান্তভাবেই তাহার। তাৎক্ষণিক বক্তব্যটি বিবেকের ছাঁকনিতে ছাঁকিয়া বাহির হইবে, ইহাই বিবেকবান, বুদ্ধিমান, শিক্ষিত মনুষ্যের বৈশিষ্ট্য। ইহার অন্যথায় ইহাই প্রকাশিত হয় যে, বক্তার উদ্দেশ্য ভাঙ্গা। আর জাত বা ধর্ম সম্পর্কিত বিবেকহীন-বোধরহিত বক্তব্য হইলে তাহা দেশের একতা ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রমূলক। ইহা অসাংবিধানিক এবং অপরাধমুলক-ও হইতে পারে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের স্মরনে রাখিতে হইবে সামনের নির্বাচনটিই শুধু নহে, অথবা একটি টেলিভিশন বিতর্ক জিতিবার উদগ্র বাসনাই নহে- দেশের মঙ্গলই তাহাদের নিকট সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কারন দেশ থাকিলেই তাহারা থাকিবেন, না থাকিলে নেতাগিরি ফলাইবেন কোথায়?? সুতরাং জিহ্বার ধারটি সামলাইয়া চলুন।

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?