দিনটা ছিল ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর, শুক্রবার। ঘড়িতে রাত সাড়ে ৯টা বেজেছে খানিকক্ষণ আগে। বিখ্যাত রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক আগাথা ক্রিস্টি তার আর্মচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বার্কশায়ারের বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে কন্যা রোজালিন্ডের ঘরে চলে এলেন তিনি। সাত বছরের মেয়েটা তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। মেয়ের কপালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে, শুভরাত্রি বলে ফের নিচে নেমে এলেন। এরপর বাইরে বেরিয়ে এলেন। নিজের প্রিয় গাড়ি মরিস কাউলিতে চড়ে, অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।

পরবর্তী ১১দিন আর তাঁকে দেখা যায়নি।

বিখ্যাত লেখিকার এই আকস্মিক অন্তর্ধানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত নড়েচড়ে বসল। অন্তত হাজারখানেক পুলিশ নিয়োজিত হলো তাকে খুঁজে বের করার মিশনে। এছাড়াও শত শত সাধারণ ভক্ত-অনুরাগীও ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামল প্রিয় লেখিকার হদিস বের করতে। এমনকি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো ব্যক্তিকে খোঁজার জন্য উড়োজাহাজও ব্যবহৃত হলো।

হোম সেক্রেটারি উইলিয়াম জয়নসন হিকস পুলিশবাহিনীর প্রতি আহবান জানালেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেন লেখিকাকে খুঁজে বের করা হয়। ব্রিটেনের অন্য দুই জনপ্রিয়তম অপরাধ বিষয়ক লেখক- শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এবং লর্ড পিটার উইমসি সিরিজের রচয়িতা ডরোথি সেয়ার্সকেও তলব করা হলো। একটাই আশা, এই দুই গুণী লেখক অপরাধ বিষয়ে তাদের অগাধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পেয়ে যাবেন আগাথা ক্রিস্টির সন্ধান।

আগাথা ক্রিস্টির গাড়িটি খুঁজে বের করতে পুলিশের খুব বেশি সময় লাগল না। গিল্ডফোর্ডের কাছে নিউল্যান্ডস কর্নারের একটি খাঁড়া ঢালে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেল সেটি। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া লেখিকার কোনো চিহ্নই পাওয়া গেল না সেটির ভেতর। এমনকি এমন কোনো আলামতও দেখা গেল না, যা থেকে ধরে নেয়া যাবে গাড়িটি কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল।

তদন্তকাজ ওদিকে পুরোদমে চলছে। একদিন কেটে গেল। এরপর দুদিন, তিনদিন… প্রতিটি দিন কাটতে লাগল, আর জনমনে চাঞ্চল্য বাড়তে লাগল। একেকজন একেক রকম সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে বের করতে লাগল। ওদিকে সংবাদপত্রের লোকেরাও বসে নেই। তারাও নিজেদের মতো করে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা লিখে কাগজ ভরাতে লাগল।

সব মিলিয়ে এটি যেন একটি যথাযথ রহস্য গল্প। আগাথা ক্রিস্টির নিজস্ব ঘরানার হুডানিট গল্পের সকল উপাদানই যেখানে বিদ্যমান।

যেখানে পরিত্যক্ত অবস্থায় গাড়িটি পাওয়া গেছে, তার অদূরেই রয়েছে সাইলেন্ট পুল নামের একটি প্রাকৃতিক ঝর্ণা। কিছুদিন আগেই সেখানে পাওয়া গিয়েছিল দুটি শিশুর লাশ। এ থেকে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না সাংবাদিকদের। যা হয়েছে তা হলো: ওই ঝর্ণার জলে ইচ্ছাকৃতভাবে ডুবে আত্মহত্যা করেছেন আগাথা ক্রিস্টি।

কিন্তু না। ঝর্ণার জলে বা আশেপাশে কোথাওই পাওয়া গেল না লেখিকার মৃতদেহ। তাছাড়া হুট করে আত্মহত্যা করার মতো কোনো জোরালো মোটিভও যে নেই। লেখিকা হিসেবে পেশাদার জীবনের সেরা সময় পার করছিলেন তিনি। ষষ্ঠ উপন্যাস ‘দ্য মার্ডার অব রজার অ্যাকরয়েড’ বইয়ের দোকানগুলোতে তখনো রমরমিয়ে চলছে। ব্রিটেনের প্রতিটি ঘরে আগাথা ক্রিস্টি একটি সুপরিচিত নাম।

তখন অনেকেই নতুন আরেকটি সম্ভাবনার কথা নিয়েও হাজির হলো। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, গোটা ঘটনাটি নিছকই একটি পাবলিসিটি স্টান্ট। আগাথা ক্রিস্টি ইচ্ছাকৃতভাবে গা ঢাকা দিয়েছেন, যাতে করে তার পরবর্তী বইটি ইতিপূর্বের সকল রেকর্ড ভাঙতে পারে। তবে কেউ কেউ আরো ভয়াবহ একটি আশঙ্কার কথাও বলতে লাগল। বাতাসে গুজব ছড়িয়ে পড়ল, স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন আগাথা ক্রিস্টি। কেননা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পাইলট হিসেবে কাজ করা তার স্বামীর যে চরিত্রের দোষ আছে। এমনকি শোনা যায়, তিনি নাকি একজন রক্ষিতাও রেখেছেন!

স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের আবার গুপ্তবিদ্যায় খুবই আগ্রহ। তিনি রহস্যের সমাধানে অতিপ্রাকৃত শক্তির সাহায্য নেয়ার চেষ্টা শুরু করলেন। আগাথা ক্রিস্টির ব্যবহৃত একজোড়া পুরনো গ্লাভস নিয়ে তিনি হাজির হলেন স্বনামধন্য এক মিডিয়ামের কাছে। আশা করতে লাগলেন, ওই মিডিয়াম বুঝি জানাতে পারবেন কোথায় আছেন লেখিকা। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হলেন।

ডরোথি সেয়ার্স অবশ্য বাস্তববাদী মানুষ। রহস্যের সমাধানে তিনি গাড়িটি যেখানে পাওয়া গেছে, সেই স্থান পর্যবেক্ষণ করলেন। তন্ন তন্ন করে চারপাশ খুঁজলেন, যদি একটা কোনো মূল্যবান সূত্র পাওয়া যায়। কিন্তু সে আশাতেও গুড়েবালি।

খোঁজাখুঁজি যখন দ্বিতীয় সপ্তাহে উপনীত হয়েছে, ততদিনে গোটা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে আগাথা ক্রিস্টির রহস্যময় অন্তর্ধানের খবর। নিউ ইয়র্ক টাইমস তো প্রথম পাতাতেই, সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করল এ সংক্রান্ত সংবাদ।

১৪ ডিসেম্বর, নিখোঁজ হওয়ার পুরো ১১ দিন পর, অবশেষে খোঁজ মিলল আগাথা ক্রিস্টির। তাকে নিরাপদে, সুস্থ শরীরেই পাওয়া গেল হ্যারোগেটের এক হোটেলে। কিন্তু এতে করে রহস্যের জট ছাড়াল তো না-ই, বরং তা যেন আরো গিট্টু পাকিয়ে গেল। কারণ লেখিকা নিজেও যে মনে করতে পারছেন না, কী হয়েছিল তার, কেনই বা এতদিন নিজ বাড়ি থেকে এত দূরে অবস্থান করছিলেন তিনি।

তাই সব সূত্র একত্র করে একটি যুক্তসঙ্গত ফলাফলে পৌঁছানোর দায়ভার বর্তাল পুলিশের উপর। তারা বিভিন্ন সমীকরণ মিলিয়ে এই সিদ্ধান্তে এল যে, নিজ বাড়ি ছেড়ে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা করেছিলেন আগাথা ক্রিস্টি। মাঝপথে তার গাড়ি একটি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়, এবং খাদে পড়ে যায়। তখন তিনি একটি ট্রেন ধরে হ্যারোগেটে চলে যান। সেখানে গিয়ে ওঠেন সোয়ান হাইড্রো নামক হোটেলে, যেটি এখন ওল্ড সোয়ান হোটেল নামে পরিচিত। তখন তার কাছে বলতে গেলে প্রায় কোনো জিনিসপত্রই ছিল না। আরো অদ্ভুত বিষয় হলো, হোটেলে ওঠার সময় তিনি থেরেসা নিল নামটি ব্যবহার করেছিলেন, যেটি কি না তার স্বামীর রক্ষিতার সম্ভাব্য নাম!

১৯২০’র দশকের সেই সময়টায় আভিজাত্যের শীর্ষস্থানে অবস্থান করছিল হ্যারোগেট। আর সেখানে অবস্থানকালে আগাথা ক্রিস্টিও এমন কিছুই করেননি, যাতে করে তাকে সেখানে বেমানান মনে হয়। তিনি নিয়মিতই বল ডান্স এবং পাম কোর্টে অংশ নিচ্ছিলেন। কেউই তাকে দেখে চিনতে পারছিল না যে তিনিই সেই হারিয়ে যাওয়া বিখ্যাত লেখিকা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হোটেলের ব্যাঞ্জো বাদকদের মধ্যে একজন, বব ট্যাপিন, চিনে ফেলেন তাকে। সাথে সাথে পুলিশকে এ বিষয়ে অবহিত করেন তিনি। পুলিশ আবার এ তথ্য জানিয়ে দেয় আগাথা ক্রিস্টির স্বামী কলোনেল ক্রিস্টিকে।

খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান কলোনেল ক্রিস্টি। কিন্তু আগাথা ক্রিস্টির যেন কোনো ইচ্ছাই ছিল না বাড়ি ফিরে যাওয়ার। পোশাক পরিবর্তনের ছুতোয় নিজের ঘরে গিয়ে অনেকটা সময়ক্ষেপণ করেন তিনি। আর সেই সময়টা হোটেলের লাউঞ্জে অপেক্ষা করেন কলোনেল ক্রিস্টি।

পরবর্তীতে স্বামীর সাথে বাড়ি ফিরে যান আগাথা ক্রিস্টি, এবং আবার মনোনিবেশ করেন লেখালেখিতে। কিন্তু ১৯২৬ সালের ৩ থেকে ১৪ ডিসেম্বর, এই ১১ দিন ঠিক কী হয়েছিল, সে ব্যাপারে কখনোই মুখ খোলেননি তিনি।

তার স্বামীর মতে, গাড়ি দুর্ঘটনার ফলে তার স্মৃতি থেকে ওই ১১ দিনের কথা পুরোপুরি মুছে গিয়েছিল। কিন্তু আগাথা ক্রিস্টির জীবনী লেখক অ্যান্ড্রু নরম্যানের বিশ্বাস, তিনি সম্ভবত ওই ১১ দিন কোনো একটি সাইকোজেনিক ট্রান্স বা মানসিক সম্মোহনে ভুগছিলেন, যা বড় ধরনের কোনো মানসিক আঘাত বা বিষণ্নতার কারণে হয়ে থাকতে পারে।

নরম্যান আরো মনে করেন, মনে মনে আগাথা ক্রিস্টির একটি থেরেসা নিল নামক একটি নতুন ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলা, পত্রিকায় নিজের ছবি দেখেও চিনতে না পারা প্রভৃতি ছিল মূলত অ্যামনেশিয়া বা স্মৃতিবিলোপের লক্ষণ।

নরম্যান বলেন,

আমার বিশ্বাস তিনি (আগাথা ক্রিস্টি) ওই সময় আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন। তার মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। পরবর্তীতে আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘আনফিনিশড পোর্ট্রেট’-এ সিলিয়া চরিত্রটির মাধ্যমে তিনি নিজের সেই সময়কার মানসিক অবস্থার বর্ণনা দেন।

অন্তর্ধান ও ফিরে আসার নাটকীয়তার কিছুদিন পরই অবশ্য আগাথা ক্রিস্টি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে তিনি আর স্বামীর পরকীয়া মেনে নেননি। ১৯২৮ সালে তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেন তিনি, এবং ১৯৩০ সালে বিয়ে করেন বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার ম্যাক্স ম্যালোয়ানকে।

আগাথা ক্রিস্টির সকল গল্প বা উপন্যাসের শেষাংশে এসেই গোটা রহস্য আমাদের চোখের সামনে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। কিন্তু তার নিজের জীবনেরই এই রহস্যজনক অধ্যায়টি এতটাই গোলমেলে ও জটিল যে, হয়তো এমনকি এরকুল পোয়ারো বা মিস মারপলের পক্ষেও সম্ভব নয় এর সমাধান খুঁজে বের করা। …

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?