ঘটনাস্থল বারাণসীর কাছে৷ এক কুখ্যাত শ্মশান৷ এক অঘোরী, তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটিকে আবেগভরে চুম্বন করছে। সেই সম্পদটি আর কিছুই নয়। একটি খুলি। রহস্যময় অঘোরী সন্যাসীদের নিয়ে পিনাকী সেন লিখেছেন। এটি প্রথম পর্ব। মোবাইলে পড়ার জন্য স্ক্রল করুন নিচে...

অঘোরী – দ্বিতীয় পর্ব

তবে, ওই যা বললাম, আগাম পরিকল্পনা করে কোনও অঘোরীর সঙ্গে দেখা করা যায় না, খুঁজে বেড়ালে হয়ত তেমন কারও সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে যেতে পারে । অনেক বন্ধুই আমার কাছে জানতে চান, দেখা হওয়ার পর অঘোরীরা ঠিক কী বলে থাকেন? তাঁরা সত্যিই দেহাবশেষ ভক্ষণ করেন কি না? বা রতিক্রিয়া করার জন্য তাঁরা ঠিক কী ধরণের শবদেহ পছন্দ করেন? কিন্তু অঘোরীরা এতই কম কথা বলেন (অনেক সময় আদৌ কথা বলেন না) যে সব কিছুর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয় । আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, অঘোরীরা কথাবার্তায় অত্যন্ত অনিচ্ছুক আর শান্ত স্বভাবের মানুষ । তাঁদের ক্রিয়াকর্ম সমস্তটাই হয় অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে, এবং তাঁরা সচেতনভাবে এই প্রসঙ্গে কথাবার্তা এড়িয়ে চলেন । আমি এমন কোনও অঘোরী খুঁজে পাইনি যিনি সাগ্রহে আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন । অঘোরীদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার বেশিরভাগটাই হল স্রেফ কিছুটা সময় তাঁদের সঙ্গে কাটানো আর ছবি তোলা । তবে তাঁরা যে ক্যামেরা জিনিসটা পছন্দ করেন, তা কখনওই নয় । কিন্তু, কেন জানি না, ছবি তুলতে বাধাও দেননি এঁদের কেউ ।

প্রকৃত অঘোরীর একটা বড় লক্ষণ হল তাঁর বাকসংযম । এঁরা প্রায় সব ক্ষেত্রেই নিরুত্তাপ থাকেন, আর এঁদের চাউনিতেও থাকে একটা শূন্যতা । তবে এর একটা কারণ হতে পারে এরা সবসময় নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকেন প্রচুর মদ্যপান এবং গঞ্জিকা সেবন করে । আমি বহুবার জানার চেষ্টা করেছি অঘোরীদের এই বিপুল পরিমাণ মদ্যপান আর সর্বক্ষণ গঞ্জিকা সেবনের কেন দরকার পড়ে? তবে উত্তর মেলেনি । ওঁদের ভক্তদের বক্তব্য, নেশার ঘোরে থাকলে হয়ত ধ্যানের সময় মনঃসংযোগ ভালো হয় । আর ‘ক্রিয়া’র সময় মনের ভিতর হয়তো ভয় জন্মাতে পারে, নেশা সম্ভবত সেটা দূরে রাখতেও সাহায্য করে ।

বেনারসেই গঙ্গার ধারে এক অঘোরীর আস্তানা দেখেছিলাম । গল্পটা বলি । আস্তানাটা তৈরি হয়েছিল মূলত কয়েকটা কাপড় দিয়ে, যে কাপড়গুলো শবদেহ ঢাকতে ব্যবহার করা হয় । আর সেই আস্তানার বাইরেই গঙ্গার পাড়ের কাছে ভাসছে এক গলিত শবদেহ । ভাসছে বললাম, কেননা দেহটি একটি ভেলায় ভাসানো । যে নৌকায় ছিলাম সেটির মাঝি আমায় বললেন, এই শবদেহটি সম্ভবত ওই অঘোরী সাধু ভক্ষণ করেননি, কেননা সেটি সাপে কাটা । তবে ভেলার পাশে একটি পাত্রে থকথকে, অনেকটা ডিমের কুসুমের মতো একটা পদার্থ রয়েছে । প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি, সেটি কী । পরে আলোচনা করে বুঝতে পারলাম, সেটি সম্ভবত এই শবদেহটিরই মস্তিষ্কের অংশ, হয়তো সেই অঘোরী সেটা ভক্ষণ করেছেন!

অনেক সময় দেখেছি অঘোরী সাধুরা দল বেঁধে ঘোরেন । তবে দল বেঁধে ঘুরলেও তাঁরা কখনওই দল বেঁধে থাকেন না । এই সাধুদের একমাত্র অগ্রাধিকার একাকিত্ব আর নির্জনতা । শ্মশানঘাটগুলোয় ঘুরতে থাকা কুকুদের দল এঁদের একমাত্র সঙ্গী বলা যেতে পারে । অঘোরীরা খাদ্য এবং পানীয় গ্রহণ করেন মড়ার খুলিতে । নরকোটির উপরের অংশটিই খাদ্য আর পানীয়ের আধার হিসেবে কাজ করে!

মোক্ষলাভের পর কোনও অঘোরী সাধনার এই কঠিন পথ ত্যাগ করতেই পারেন । তবে ‘ক্রিয়া’ ছাড়লেও ত্যাগের পথ তিনি ছেড়ে দেন না । তিনি তখন গুরু হিসেবে অন্য অঘোরীদের পদপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন । মোক্ষ বা সিদ্ধিলাভ করেছেন, এমন এক অঘোরী সন্তের সঙ্গেও আমি দেখা করেছিলাম । তিনি ১৬ বছর সাধনার পর মোক্ষলাভ করেছিলেন । আর এই দীর্ঘ ১৬টা বছর তিনি কাটিয়েছিলেন গঙ্গাবক্ষে একটি নৌকার উপর । ১৬ বছরের মধ্যে তিনি একটিবারও নাকি নৌকার বাইরে যাননি । মোক্ষলাভের পথটি অবশ্য তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই । কেননা, সেটি আড়ালেই থাকে । তিনি শুধু আমায় বলেছিলেন কীভাবে তিনি দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে জীবনধারণ করেছিলেন । একটি আশ্রমে যখন আমি তাঁর দেখা পেয়েছিলাম, দেখে অবাকই হয়েছিলাম । তাঁর সাধারণ-সাফসুতরো চেহারা, পরিচ্ছন্ন পোশাক আমায় আশ্চর্য করে দিয়েছিল । একটু পরে বুঝলাম ফারাকটা চিন্তাভাবনা আর মানসিকতায় । সেই সাধু কথাবার্তায় একেবারেই অনাগ্রহী । আশ্রমে কোথায় একান্তে সময় কাটানো যাবে, সারাক্ষণ সেটারই সন্ধানে রয়েছেন । সেইসঙ্গে সর্বক্ষণ তিনি যেন নিজের চিন্তায় নিমজ্জিত । বুঝলাম, তিনি প্রকৃতই একজন অঘোরী ।

অঘোরীদের সঙ্গে মেশার পরও আমি এখনও কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর পাইনি । যেমন, কেন অঘোরীরা এমন একটা জীবন যাপন করেন? এই জীবন যাপনের লক্ষ্যটাই বা কী? বা, ঘুরিয়ে বলতে গেলে সিদ্ধিলাভের উপকারিতাটাই বা কী? কীভাবে এক অঘোরী বুঝতে পারেন তিনি মোক্ষলাভ করেছেন? অঘোরী বা তান্ত্রিকরা শক্তিরই সাধনা করে থাকেন । এই শক্তির স্বরূপটা কী? এই শক্তি কি অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে? না যাবতীয় সম্ভাবনাকে নয়ছয় করে দেয়? কে জানে । নিজের ইচ্ছেপূরণের জন্য কোনও-কোনও সাধক হয়তো নিজের অর্জিত শক্তির অপব্যবহার করতে পারেন । কিন্তু প্রকৃত অঘোরীর মন সব ভয়, কামনা, লালসা, ইচ্ছেকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে দিতে সক্ষম । এইরকম মানসিক অবস্থায় এক অঘোরী কালীরই অংশ হয়ে ওঠেন । মোক্ষলাভের পর সব কিছুই তাঁর কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় । থাকে শুধু ‘উপলব্ধি’ ।

Series Navigation<< অঘোরী- প্রথম পর্ব

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?

লেখক পরিচয় |

লেখক একজন শখের চিত্রগ্রাহক। তাঁর পছন্দের বিষয় জনজাতিদের ছবি তোলা, তথ্য সংগ্রহ করা ৷ মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।

Start typing and press Enter to search