বিজ্ঞান, বিজ্ঞানী, পরিবর্তন এবং দশটি বছর
আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে বিজ্ঞানে দুটো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হয়েছিল। প্রথমটা পদার্থবিজ্ঞানে, দ্বিতীয়টা চিকিৎসাবিদ্যায়। ২০১২ সালের ৪ জুলাই জেনিভার কাছে সার্ন ল্যাবরেটরিতে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, হিগস বোসন কণা— যার জন্য অনেক বছর ধরে সাধ্যসাধনা করা হচ্ছিল— তা পাওয়া গিয়েছে। হিগস বোসন কী? তা হলে বলতে হয় ব্রহ্মাণ্ডের এক রহস্যের কথা। এই ব্রহ্মাণ্ডে কত জিনিস! গ্রহ তারা গ্যালাক্সি। আমাদের এই গ্রহ পৃথিবীতেই কত বস্তু! পাহাড়-পর্বত, নদীনালা, জীবজন্তু, মায় এই মানুষ। এ সব ঠিকঠাক আছে, বস্তুর ভর আছে বলে। ভর আছে বলে গ্রহ উপগ্রহ তারা গ্যালাক্সিগুলি আলোর কণা ফোটনের মতো দিগ্বিদিকে সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার বেগে ছুটে বেড়াচ্ছে না, সব যথাস্থানে আছে ঠিকঠাক। বস্তু গড়া কণা দিয়ে। এক-একটা কণার পাহাড়। বস্তুর ভর মানে কণাদের ভর। সেই কণাকে ভর কে জোগায়? হিগস বোসন কণা। হিগস বোসন অন্য কণাকে ভর না জোগালে এই ব্রহ্মাণ্ড হয়ে যেত লন্ডভন্ড। সে জন্য হিগস বোসন কণার সন্ধান এত জরুরি ছিল। যার জন্য এত সাধ্যসাধনা, তার খোঁজ পাওয়ার পরের বছরেই দেওয়া হয় নোবেল পুরস্কার।
দ্বিতীয় বড় আবিষ্কার জিন কাটাছেঁড়ার কৌশল ক্রিসপার/ক্যাস-নাইন। লোকমুখে চালু নাম ক্রিসপার। এ জন্যও দেওয়া হয়েছে নোবেল পুরস্কার। ২০২০ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জেনিফার অ্যান ডুডনা এবং ইমানুয়েল মেরি শারপেন্তিয়ের। ২০১২-য় ওঁরা দু’জনে আবিষ্কার করেন ক্রিসপার। বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ পুরস্কার পেতে আরও ৮ বছরের অপেক্ষা।
চেনা এবং জানা। এই দু’ভাবে ভাগ করা যায় বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলোকে। ২০১২ সালে যে দুটো বড় আবিষ্কার হয়েছিল, সে দুটোকেও ওই ভাবে ভাগ করা যায়। প্রথমে যে আবিষ্কারটার কথা বললাম, সেটা ওই চেনা পর্যায়ের। হিগস বোসন কণাকে চিনতে পারার ব্যাপার। আর দ্বিতীয়টা টেকনিক বা কৌশল জানার ব্যাপার। কোনটি বেশি জরুরি? বলা যাবে না। এই ব্রহ্মাণ্ডে বাস করতে গেলে তাকে যেমন চিনতে হয়, তেমনই নতুন কিছু শিখতে গেলে অনেক পুরনো জিনিস জানতে হয়। বিজ্ঞান মানে খোদার উপর খোদকারি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই খোদকারির নতুন নাম ক্রিসপার। এই দুই কারিগর যে জেনিফার এবং ইমানুয়েল, তা তো আগেই বলেছি।
জেনিফারের জন্ম ১৯৬৪ সালে। আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন শহরে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র বাবা মার্টিন কার্ক ডুডনা এক দিন মেয়ের বিছানার পাশে রেখে দিয়েছিলেন একটি বই— দ্য ডবল হেলিক্স। ডিঅক্সিরোইবো নিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ), প্রত্যেকটি প্রাণিকোষে যার উপস্থিতি, তার আকৃতি আবিষ্কারের উপাখ্যান। লেখক নোবেলজয়ী জেমস ডিউই ওয়াটসন। যে বইয়ের পাণ্ডুলিপি সারা রাত জেগে পড়ে আর এক নোবেল বিজয়ী রিচার্ড ফিলিপ ফাইনম্যান ওয়াটসনকে বলেছিলেন, লোকের সমালোচনায় কান দিয়ো না। গবেষণা এ রকমই হয়। এ রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা, দ্বেষ, হিংসা তাতে মিশে থাকে। বিজ্ঞানে আবিষ্কার পরিষ্কার পদ্ধতিতে আসে না।
জেনিফার তাঁর আত্মজৈবনিক বই আ ক্র্যাক ইন ক্রিয়েশন: দ্য নিউ পাওয়ার টু কন্ট্রোল ইভলিউশন-এ লিখেছেন, ওয়াটসনের লেখা বই পড়ে গোয়েন্দা উপন্যাসের স্বাদ পান। গবেষণা তো গোয়েন্দাকাহিনিই। জেনিফার ঠিক করেন তাঁর জীবনের লক্ষ্য— বিজ্ঞানীই হব।
পারিপার্শ্বিক রচনা করে মানুষের ভাগ্য। ছেলেপিলে স্কুল থেকে ফিরলে আমরা জিজ্ঞাসা করি, টিফিনটা খেয়েছে কি না। নয়তো, যে ছেলেটা এক ঘুষি দিয়েছিল, তাকে দু’ঘুষি দিয়েছিস কি না। আর, নোবেলবিজয়ী ইশাডর ব্যাবি-র মা কী জিজ্ঞাসা করতেন? “মাই সন, ডিড ইউ আস্ক এনি ইন্টেলিজেন্ট কোয়েশ্চেন ইন ইয়োর ক্লাস টুডে?” ফাইনম্যানের ছোটবেলায় বাবা তাঁকে দেখাতেন পাখি। দেখিয়ে বলতেন, ইংরেজিতে পাখিটার নাম হল এই। ইটালিয়ান ভাষায় পাখিটাকে অমুক বলে। জার্মান ভাষায় অমুক বলে। তার পর জিজ্ঞেস করতেন, পাখিটাকে চিনলে? বালক ফাইনম্যান উত্তর দিতেন, হ্যাঁ। কিচ্ছু চেনোনি, উত্তর দিতেন বাবা। বলতেন, নামের তালিকায় কিছু জানা যায় না। পাখিটাকে চেনা যায় ও কী করে, তা জানলে। পাখিটা কি গান গায়? পাখিটা কি নিজের বাসা নিজে বানায়? এসো, আমরা এ বার দেখি পাখিটা কী করে? আত্মজীবনীতে ফাইনম্যান লিখেছিলেন, পরে বড় হয়ে জেনেছি, বাবার বলা পাখিটার নামের তালিকা ভুল ছিল। তবু বাবা ওটা বলতেন, চেনা কাকে বলে, সেটা বোঝানোর জন্য। এই কাহিনি বলে রিচার্ড ফাইনম্যান: আ লাইফ ইন সায়েন্স বইতে লেখকযুগল জন গ্রিবিন এবং মেরি গ্রিবিন-এর সিদ্ধান্ত, আমরা চাইলে নোবেলবিজয়ী না হতে পারি, তবে নোবেলবিজয়ীর মা কিংবা বাবা হতে পারি!
গবেষণার মজা এই যে, মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। কোনও কিছুই পূর্বপরিকল্পনা মতো এগোয় না। ইমানুয়েলের জন্ম ১৯৬৮ সালে। উত্তর ফ্রান্সে জুভিসি-সু-অর্গ নামে একটা জায়গায়। পাস্তুর ইনস্টিটিউট থেকে ডক্টরেট। পায়ের তলায় সর্ষে। এর মধ্যেই পাঁচটি দেশে, সাতটি শহরে, দশটি প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করেছেন তিনি। বিজ্ঞানী হয়েছেন ইমানুয়েল অভাবনীয়ের নেশায়। নতুন খুঁজেও তিনি মনে করেন, এ ব্যাপারে শেষ কথা বলেছিলেন স্বদেশি বিখ্যাত বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর— “চান্স ফেভারস দ্য প্রিপেয়ার্ড মাইন্ড”— দুর্ঘটনা তখনই আবিষ্কারে পর্যবসিত হয়, যখন আবিষ্কর্তা তার জন্য প্রস্তুত থাকেন। প্রস্তুতি বড় ব্যাপার। গবেষণায় সাফল্যের বড় কথা।
জেনিফারের সঙ্গে ইমানুয়েলের দেখা হল কী ভাবে? ২০১১। পোর্টো রিকো দ্বীপের রাজধানী সান জয়ান শহরে আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি-র কনফারেন্স। বার্কলিতে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া-র অধ্যাপিকা জেনিফারের সঙ্গে দেখা ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনা-র অধ্যাপিকা ইমানুয়েলের। দু’জনেই গবেষণা করেন স্ট্রেপটোকক্কাস পাইয়োজিন ব্যাকটিরিয়া নিয়ে। এ বড় সাংঘাতিক ব্যাকটিরিয়া। ফি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষকে আক্রমণ করে এই জীবাণু। টনসিলাইটিসের মতো মামুলি রোগই নয়, প্রাণঘাতী রোগও হতে পারে ওই ব্যাকটিরিয়ার জন্য। মাংস ক্ষয়ে যায়। ও রোগ থেকে ব্যাকটিরিয়ার নাম ‘মাংস-খেকো’।
দু’জনে লাঞ্চ করতে ঢুকলেন এক কাফেটারিয়ায়। সেই লাঞ্চ বদলে দিল জেনিফারের জীবন। তিনি প্রথম শুনলেন জিন থেরাপির এক নতুন কৌশল। ক্লাস্টারড রেগুলারলি ইনটারস্পেসড শর্ট পালিনড্রোমিক রিপিট-অ্যাসোসিয়েটেড (নামের ইংরেজি আদ্যক্ষরে ক্রিসপার-ক্যাস) কৌশল। ২০১২ সালে ওই পদ্ধতিতে জিন থেরাপির কৌশল নিয়ে পেপার ছাপলেন জেনিফার, ইমানুয়েল এবং তাঁদের সহযোগীরা। সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত সেই পেপারের শিরোনাম ‘আ প্রোগ্রামেবল ডুয়াল-আরএনএ-গাইডেড ডিএনএ এনডোনিউক্লিয়েজ ইন অ্যাডাপটিভ ব্যাকটিরিয়াল ইমিউনিটি’।
না, ২০১২ সালের ৫ জুলাই পৃথিবীর সমস্ত সংবাদপত্রে যেমন হিগস বোসন খুঁজে পাওয়ার খবরটা ছাপা হয়েছিল, তেমন করে ‘খবর’ হল না এই জিন থেরাপির নতুন কৌশল। কারণ? ওই হেডলাইন। বিজ্ঞানের কচকচিতে ঠাসা। ক’দিন আগে জেনিফার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আগে জানলে ওই হেডলাইনটা বদলে দিতাম।
প্রাণিদেহের প্রতিটি কোষে উপস্থিত ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড বা ডিএনএ। এর গঠন আবিষ্কার নিয়েই ওয়াটসনের বই দ্য ডবল হেলিক্স। প্যাঁচানো মইয়ের মতো আকার। এর অংশবিশেষে গোলমাল মানেই অসুখ-বিসুখ। গোলমাল দূর করতে জিন থেরাপি। ক্যাসাইন এনজ়াইমের মধ্যে চুবিয়ে ডিএনএ-র গোলমাল সারানো। এটাই ক্রিসপার কৌশল— এ ব্যাপারে লেটেস্ট। ২০২০ সালে ওই কৌশলকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে অ্যাওয়ার্ড কমিটি বলেছে, এ কৌশল ‘যুগান্তকারী’। রোগ চেনা শুধু নয়, উপশমের পথও বাতলাচ্ছে ক্রিসপার। ক্যানসার গবেষকরা নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছেন। এক বিজ্ঞানী বলেছেন, “জিন সংশোধন আসছে নয়। এসে গিয়েছে।”
আগেই বলেছি, খোদার উপর খোদকারি। ফল কোন দিকে যাবে, বলা মুশকিল। ১১৭ বছর আগে আলবার্ট আইনস্টাইন আবিষ্কার করেছিলেন যে, পদার্থ আর শক্তি একই মুদ্রার এ পিঠ-ও পিঠ। ওই জ্ঞান সম্বল করে অ্যাটম বোমা বা বিদ্যুৎ দুই-ই বানানো যায়। হিরোশিমা আর নাগাসাকির মানুষ বুঝেছে অ্যাটম বোমার ক্ষয়ক্ষতি। আর, এখন মুম্বই শহরের মানুষ পাচ্ছে বিদ্যুৎ।
ক্রিসপার টেকনোলজিও তেমনই। ২০১৮ সালে চিনা বিজ্ঞানী হি চিয়ানখুই তিনটে ভ্রূণের মধ্যে জিন থেরাপি করে এমন সংশোধন করেন যে, শিশু ভূমিষ্ঠ হলে তাদের কখনও এডস হবে না। সে শিশুরা এখন কেমন আছে, তা কেউ জানে না। ২০১৯ সালে সে বিজ্ঞানীকে নীতিবহির্ভূত কাজের জন্য জেলে পাঠানো হয়।
বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ?
মূল প্রবন্ধটি আনন্দবাজার পত্রিকাতে পূর্বপ্রকাশিত। শিরোনাম এবং সামান্য কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে পড়ার সুবিধার্থে