পঞ্চাশ বছর, অর্ধ শতাব্দী... কেমন উপলদ্ধি হয় একজন পঞ্চাশে পৌছানো আম আদমির? এ লেখা যেন লেখকের আত্মোপলদ্ধির গন্ডী ছাড়িয়ে আমার আপনার আত্মকথা হয়ে উঠেছে। মোবাইলে পড়ার জন্য স্ক্রল করুন নিচে...

ধন্যবাদ বন্ধুরা

প্রিয় বন্ধুরা,

আপনারা অনেকেই সোচ্চারে অথবা নিরুচ্চারে আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা। এমন একটি দিনের ঘটনার জন্য শুভেচ্ছা যার পেছনে আমার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন ভূমিকাই ছিল না। এমন একটি দিনের জন্য শুভেচ্ছা পেতে একটু কুণ্ঠিত লাগে। কিন্তু এই ব্যস্ত দুনিয়ায় কেউ একজন এই অনামী এবং বেকুব মানুষটির জন্মদিন মনে রেখেছেন এবং নিজের অত্যন্ত মূল্যবান মুহূর্ত খরচ করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন – ভালোও লাগে বইকি!! আপনারা প্রত্যেকেই আমাকে আনন্দের ছোট ছোট সোনালী টুকরো উপহার দিয়েছেন।

অর্ধশতাব্দী পার করে ফেললাম, এই অনুভূতিটি বড্ড অদ্ভুত। অনেকে বলেন আমাদের স্বপ্ন আমাদের অতীত ভ্রমণের মাধ্যম। প্রায়ই আমার স্বপ্নে ছোট্ট একটা নরম নদী কাকচক্ষু জল আর রংবেরং-এর নুড়িপাথর ভরা নদীতল নিয়ে বসে থাকে। তার দু পাড় ভরা সবুজ ঘাস আর ছোট্ট হলুদ ফুল-এ৷ দুটো ছোট্ট পা সেই জলে ডুবে থাকে। হাঁটু পর্যন্ত গোটানো ফুল প্যান্ট ভিজে থাকে হাঁটুর কাছে। ঈষদুষ্ণ জল বয়ে যায় তিরতির করে। অসম্ভব সুন্দর আয়েশে চোখ বুঁজে আসে৷ বড্ড আরাম লাগে। কে জানে ওই ছোট্ট পা দুটো আমার কিনা, কোনো বিস্মৃত অতীতে শিশু আমি হয়ত পা ডুবিয়ে বসে ছিলাম জলে, এই জন্মে অথবা জন্মান্তরে। গত অর্ধশতাব্দীতে এ আমার সেরা অনুভৃতি।

অর্ধশতাব্দীতে হতাশাগ্রস্ত হয়েছি বার বার। খেলাধুলাতে তেমন দড় ছিলাম না। মারধোরের ক্ষেত্রে মার খাওয়াটাই দস্তুর ছিল। শরিরের সক্ষমতম অঙ্গ ছিল পা। বহুবার এর ব্যবহারে মারের হাত থেকে বেঁচেছি – পালিয়ে। বহু বহুদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গাল পেড়েছি মারকুটেদের। পাশবালিশ আমার মারের ঘায়ে হয়েছে ফুটিফাটা। যোগ্য জবাব না দিতে পারার হতাশাটা থেকেই গেছে। ফেরানো হল না কতকিছু। সেই ছেলেটির ঘুষি, ওই স্যারের ছুরির মতন অপমান, সেই পুলিশটার চড় অথবা কলেজের সেই মেয়েটার তীর্যক দৃষ্টি … ভাবতে গেলে লিস্টি বেশ লম্বা।

বন্ধুরা, এই অর্ধশতাব্দীর অধিকাংশ সময় জুড়ে আমি শুধু চেষ্টা করে গেছি নিখুঁত হতে। আমার শতচ্ছিন্ন জামাটাকে সারিয়ে তুলতে। উল্টে হাজার একটা তাপ্পি মারতে গিয়ে বেআব্রু ‘জোকারের জোব্বা’ হয়ে উঠেছে সেটি। সেই শতচ্ছিন্ন বিধ্বস্ত আমিটিকে তুলে নেওয়া বড় সহজ কাজ মোটেও ছিল না। কিন্তু আজ এই পঞ্চাশ নম্বর ধাপটিতে দাঁড়িয়ে আমার বলতে বাধা নেই আমার সেই জোকারের জোব্বাটির বিশ্রী তাপ্পিগুলোকে একে একে খুলে একসুতোয় আবার নতুন করে বুনেছেন দুই মহিলা। একজন আমার মা এবং অপরজন আমার মেয়ের মা, আমার স্ত্রী। নাড়ীছেঁড়া হওয়াতে প্রথমজনের কাছে আমি অনেকটাই ছিলাম পূর্বঘোষিত ভবিতব্য। কিন্তু আমার স্ত্রীর ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল স্ব-আরোপিত ভবিতব্য, ফলতঃ অনেক বেশি কঠিণ। খুব দায়িত্ববান, জেদী এবং বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি আমি কোনদিনই ছিলাম না। বিবাহিত জীবনের বেশিরভাগ সময়েই তাঁকে দুঃখই দিয়ে এসেছি। কিন্তু তিনি আমাকে কখনও ত্যাগ করেননি, সংসারে জোগালী খেটেও পরম মমতায় আমাকে হৃদাশ্রয়টি দান করেছেন। তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার স্বপ্নের সেই নদীটিতে পা ডুবিয়ে আমি বসতে চাই শুধু তাঁর সাথে এই জন্মে এবং জন্মান্তরেও।

নির্গুণ হওয়ার হীনমন্যতায় আমি দীর্ঘদিন ভুগেছি। আমার চর্তুপাশের অগণিত গুনী মানুষদের ভীড়ে নিজেকে অপাংক্তেয় মনে হয়েছে। কিন্তু অর্ধশতাব্দী শেষে এখন আমি নিশ্চিত যে গুনীদের কদরের জন্যও এক আধজন নির্গুণদেরও এ পৃথিবীর বড্ড প্রয়োজন। নির্গুণরাও এ পৃথিবীর জল – হাওয়া – দুঃখ – আনন্দের মতনই স্বাভবিক। আপনাদের ধন্যবাদ বন্ধুরা, আপনারা এমন একজন মানুষের জন্য দুনিয়ার সবথেকে দামী জিনিসটির কিছুটা খরচা করে ফেললেন। শুধু ভালবেসে।

সবাইকে অনেক ভালোবাসা।

রাজেশ সেন

২১/১১/২০২২

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?

লেখক পরিচয় |

Start typing and press Enter to search