কলকাতার বুকে চিরকাল দোলের মাধুর্য্য ভিন্ন। সময়ের সাথে সাথে উৎসবের রূপের পরিবর্তন এসেছে অনেক। তবে কি পুরনো ঐতিহ্য ম্লান হয়েছে? চলুন দেখে নেই তবে কলকতার পথে দোলের বিবর্তনীয় অধ্যায়টা।

কলকাতা শহর তখনও মহানগরী হয়ে ওঠেনি। ব্রিটিশরাও সেভাবে আধিপত্য জমিয়ে উঠতে পারেনি এখানে। ১৬৯০ জব চার্নক এসে দেখেন কলকাতা এক পাতি গ্রাম মাত্র। সেখানের বাসিন্দাদের সাথে আলাপ জমাতেও চাইলেন তিনি। কিন্তু ফিরিঙ্গীদের সাথে গপ্প করবেই বা কে? প্রায় ৩২৫ বছর আগেকার কথা। এক বসন্তে গ্রাম ঘুরতে বেরিয়ে ফিরিঙ্গীদের কানে এল এক মিষ্টি গানের সুর। সুরের টানেই পৌঁছে গেলেন এক বিরাট দিঘির পাড়ে। সেখানে তখন গোবিন্দজী ও রাধিকার মূর্তি ঘিরে চলছে রঙ খেলা। তাদের পোশাক জুড়ে লাল আবির। পিচকারি দিয়ে রঙগোলা জল। দিঘির জলও হয়েছে আবিরে রাঙা। গোপিনীসাজে চলছে মহিলাদের নাচ। কিন্তু ফিরিঙ্গীরা ভেবে বসল এ বোধহয় প্রাচীন গ্রীসের মতো ‘কামোৎসব’। সেই লালসাতেই তারা ভেতরে ঢুকে মহিলাদের সাথে নাচতে শুরু করে। কিন্তু তারা ভাবতেই পারেনি মহিলা সাজে পুরুষরাই রয়েছে ওখানে। গ্রামবাসীরা তখন তাদের আচরণে রেগে গিয়ে চড় থাপ্পড় মেরে দূর করে সেখান থেকে।

ব্রিটিশ উপনিবেশে তৈরীর পর কলকাতার বাবুরা গণিকাদের সাথেই দোল উৎসবে আমোদ আহ্লাদ করতেন। আবার অনেকে তাদের শখের বাগানবাড়িতে বন্ধুবান্ধবদের সাথে রঙের খেলায় মেতে উঠতেন। কলকাতার ইতিহাসে আজও পাওয়া যায় সেকালের দোল উৎসবের বর্ণনা। পিচকারি ভরা রঙিন জল। আতর মাখা আবিরের ছড়াছড়ি। উচ্চবিত্ত নিম্নবিত্ত হিন্দু মুসলমান কিংবা খ্রীষ্টান এইদিন সব জাতি মিলেমিশে একাকার। রাজবাড়িতে বসত বাঈজী নাচের আসরও। পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়িতে বসত ধ্রুপদী গানের আসর। অঘোর চক্রবর্তী, পিয়ারা সাহেব কিংবা আহমেদ খান আসর জমাতেন। আর হ্যাঁ, দোল উৎসবে রাস্তাঘাটে ওই চটুলতার প্রমাণ কিন্তু সেযুগেও পাওয়া যায়। আশ্রাব্য গান কিংবা সং সেজে চলত নাচ গান।

ব্রিটিশরা এলেও অভিজাত ব্যবসায়ী ও শাসকদের হাত ধরেই থেকে যায় রঙ উৎসব। কোম্পানীর কাজ বন্ধ থাকত পাঁচদিন এই দোল উপলক্ষ্যে। জার্মানী থেকে আসত রঙ। সবুজ নীল গোলাপী নানা রঙের যোগান ছিল। সকালে পিচকারির খেলা আর রাতে আবির মাখামাখি। অভিজাতরা পিতলের পিচকারি নিয়ে আর গরিবরা টিন-বাঁশ-পিতলের পিচকারি নিয়ে নামত সেদিন। চলত নিধুবাবুর টপ্পা, যদুভট্টের গান, কবিগান, তরজা, কীর্তন। পরে পরে আবার নাটকও মঞ্চস্থ হতে শুরু করে। দুর্গা পূজার মতোই জাঁকজমক ছিল দোল উৎসবে। মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের নতুন সাজ, ফুলের অঙ্গসজ্জা, বিশেষ ভোগরাগের ব্যবস্থা ছিল। দেবতার পায়ে আবির ছোঁয়ানো হত। সাদা, গোলাপি বাতাসা, সাদা ও রঙিন মঠ। নানা পাখি, ফুল ইত্যাদির ছাঁচ তৈরি করে এই ‘মঠ’কে বিভিন্ন আকৃতি দেওয়া হতো। মুড়কি-কদমা-ছোলা ও চিনি দিয়েও তৈরি একরকমের মিষ্টি, ‘ফুটকড়াই’ নামেই জনপ্রিয়।

পরে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, শিশিরকুমার ঘোষ প্রমুখরা আয়োজন করতেন দোল উৎসবের। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে এই উৎসবকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যান যা আজও অনন্য হয়েই দাঁড়িয়ে বিশ্ব দরবারে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও বসন্ত উৎসব পালন হত সে যুগে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের বাড়িতে বিলিতি রঙের বাক্স নানা আকৃতির পিতলের পিচকিরি, পিতলের বালতি, আবির, গন্ধদ্রব্য, রঙিন মিষ্টি, কখনও বা বিলিতি প্রসাধন সামগ্রীও উপহার হিসেবে যেত।

আজকের বিবাদী বাগ অর্থাৎ অতীতের ডালহৌসি অঞ্চলে মহাকরণের সামনে যে বড় দিঘি, সেটি লালদিঘি। রং খেলা শেষ করে এই দিঘিতেই স্নান করতেন সব। পুরনো ছেঁড়া জামাকাপড় পরেই অনেকে রং খেলায় অংশ নিতেন। সেই জামাকাপড় ও গায়ের রঙে দিঘির জল লাল হয়ে উঠত। অনেকদিন পর্যন্ত জল রঙিন থাকত। দোলের দিন কলকাতার কৈবর্তপাড়া থেকে সং বের হতো। এঁদের সঙ্গেও থাকত রং ও আবির। রাস্তায় ছেলে-বুড়ো যাকে পেত তাকেই রং মাখাতো। শুধু সংই নয় সেকালে বউবাজার থেকে বাগবাজার দোলযাত্রার দিন নগর সংকীর্তনের দল বের হতো। বসন্তের এই রঙ উৎসব চিরকাল মহা সমারোহে পালিত হয়ে এসেছে মহানগরীর পথে। আজও সেই পুরোনো দিনের সুর তালেই মেতে ওঠে বাংলার মাঠ ঘাট দোলযাত্রায়।

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?