হেপি নিউইয়ার
নববর্ষের উৎসবের পরদিন সকালে একটি শিশু তার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “মা, প্রতিদিন কেন নিউইয়ার হয় না? প্রতিদিন আমরা কেন হ্যাপি নিউইয়ার করি না?”
আমাদের ‘হেপি নিউইয়ার’ বলার ভদ্রলোকটি কিন্তু ঐ শিশু নন। তিনি সফল এবং সুপ্রতিষ্ঠিত এক ব্যবসায়ী। যে বঙ্গজ উচ্চারণ দোষে তিনি দুষ্ট, সেই উচ্চারণ দোষে একদা আমার মধ্যেও ছিল, এখনও হয়ত আছে।
আমি সচেষ্ট ও সতর্ক হয়ে কিছুটা কাটিয়ে উঠেছি। কিন্তু সেই স্বদেশী বন্ধু এ নিয়ে মাথা ঘামাননি। তবে তাতে তাঁর কিছু আসে যায় না, তিনি এ সবের পরোয়া করেন না, বরং আমরাই মাঝেমধ্যে খটকায় পড়ি।
একেক সময় ধরাই কঠিন হয় তিনি ইংরেজিতে কী শব্দটা বলছেন। তার সঙ্গে আমার সবসময় যোগাযোগ থাকে না। তবু এখানে ওখানে কাজের বাড়িতে, উৎসবের মঞ্চে হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। আমরা একই স্কুলের দু-এক ক্লাস নিচে উপরে পড়েছি, জন্মেছিলাম একই মফঃস্বল শহরের একই পাড়ায়। ধনবান মানুষ হলেও তিনি আমার সম্বন্ধে কৌতূহল ও উৎসাহ দেখান সবসময়েই।
কয়েক মাস আগে একদিন দেখা। বললেন, “তোমার ফেটটা একটু বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে।” আমি-ধরতে পারিনি, ভাবলাম বোধহয় তিনি বলতে চাইছেন যে আমার ভাগ্য এখন প্রসন্ন। কিন্তু কিছু পরেই বুঝতে পারলাম যে তিনি বলতে চাইছেন, আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি। ফেট মানে ইংরেজি Fate নয়, ফ্যাট (Fat) অর্থাৎ মোটা।
অবশ্য এই প্রথম নয়। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের সুবাদে তিনি বহুলোকের স্বনিযুক্ত পরামর্শদাতা। একদিন এক বিয়েবাড়িতে আমি প্যান্ট-শার্ট পরে গিয়েছিলাম। ঐ ভদ্রলোক, নামটা বলেই ফেলি করুণাবাবু, তিনি বললেন, “তুমি পেন্ট পরে বিয়ে বাড়িতে আসো কেন? লেখক-মানুষ বিয়ে বাড়িতে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসবে, তোমাকে মানাবে।” আমাকে কিসে মানাবে আর কিসে মানাবে না, তা নিয়ে আমি তেমন মাথা ঘামাই না, তবে পেন্ট মানে যে প্যান্ট, এটা সেদিন হৃদয়ঙ্গম করতে আমার মিনিট দুই সময় লেগেছিল।
নববর্ষের সুবাদে এই করুণাদার প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরেকটা অনুরূপ অভিজ্ঞতার কথা বলে নিই। অনেকদিন আগে উচ্চারণ নিয়ে বোধ হয় একটা লেখা লিখেছিলাম। সেখানে এই প্রশ্নটা তুলেছিলাম। যে লোকটা ফ্যাটকে ফেট, ক্যাটকে কেট, স্ন্যাককে স্নেক বলে, সেটা কি তার জিহ্বার দোষ? য-ফলা আকার সে কেন ‘এ’ উচ্চারণ করে?
কিন্তু আমি অনুধাবন করে দেখেছি, যে ব্যক্তি ট্যাপ রেকর্ডার বলে সে-ই বলে টেপ ওয়াটার। আসলে সে ট্যাপ আর টেপ দুইই চমৎকার উচ্চারণ করতে পারে, শুধু যেখানে যেরকম করা উচিত সেখানে সে রকম করে না। এ তার শিক্ষার অভাব না অভ্যাসের দোষ, নাকি মানসিক বিশৃঙ্খলা?
করুণাদার ব্যাপারটাই ধরা যাক। করুণাদা আগে পার্টনারশিপে ব্যবসা করতেন।
যথারীতি বাঙালির আর দশটা যুগ্ম বা যৌথ উদ্যোগের মতো একদিন পার্টনারের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য দেখা দিল।
করুণাদার পার্টনারের নাম ছিল শ্যামবাবু। শ্যামবাবুও আমাদের দেশের লোক, তাঁকেও আমি জন্মাবধি চিনি। ফলে করুণাদা এবং শ্যামবাবুর ব্যবসায়িক কলহে আমাকে কিঞ্চিৎ মধ্যস্থতা করতে হয়।
সেই কলহের পরিণতি কী হয়েছিল সেটা এ কাহিনীর বিষয় নয়। সে আলোচনা এখানে করব না। তবে যে কারণে এ প্রসঙ্গের উত্থাপন করেছি সেটা বলি।
কী একটা হিসেবে গোলমাল হয়েছিল। করুণাদার ধারণা হয়েছিল যে শ্যামবাবু বোধ হয় কিছু একটা কারচুপি করেছেন। শ্যামবাবুর হয়ত কিছু দোষ ছিল, তিনি গুম হয়ে মাথা নিচু করে বসে করুণাদার গালাগাল হজম করছিলেন। করুণাদা বারবার একটা কথা বলেছিলেন, “ছিঃ ছি! আপনার ওপর আমি এত বিশ্বাস করেছিলাম, এক্ত আস্থা রেখেছিলাম। ছিঃ! ছিঃ! শ্যাম, শ্যাম, শেমবাবু।”
এই শেষোক্ত শব্দত্রয় নিয়েই আমাদের সমস্যা, ‘শ্যাম, শ্যাম, শেমবাবু।’ প্রথম শ্যাম, শ্যাম হল শেম, শেম (Shame, Shame) আর শেষের শেমবাবু হল শ্যামবাবু। মোট কথা করুণাদা যখন বলছেন, ‘শ্যাম, শ্যাম, শেমবাবু’, তখন তাঁর বলার কথা হল, ‘শেম, শেম, শ্যামবাবু।’
এই কটূক্তি শ্যামবাবুকে কতটা লজ্জিত করেছিল তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, কিন্তু আমার যে প্রশ্নটা তখন ছিল এবং এখনও আছে, করুণাদা পরিষ্কারভাবে শেম আর শ্যাম দুই যদি উচ্চারণ করতে পারেন তবে শ্যামকে শেম আর শেমকে শ্যাম বলেন কেন?
জানি আমার এ সমস্যার সমাধান কোনোদিন কেউ করতে পারবে না। সুতরাং শুভনববর্ষে করুণাদার ‘হেপি নিউইয়ার’-এ প্রত্যাবর্তন করি।
করুণাদা ব্যক্তিটি ভুল বা অমার্জিত উচ্চারণ করতে পারেন, কিন্তু তিনি নির্বোধ বা অশিক্ষিত নন, তাছাড়া তিনি বিত্তবান। বিত্তবানের সর্বদাই সাতখুন মাপ।
নববর্ষের দিন-সাতেক আগে করুণাদা আমাকে ডাকলেন। দেখি হাতে বিরাট এক লিস্ট, তাতে শহরের যত নামজাদা জ্ঞানীগুণী লোকের তালিকা। কবি, লেখক, আমলা, চিত্রতারকা এমনকি অধ্যাপক, উপাচার্য পর্যন্ত।
আমি বললাম, “কী ব্যাপার?” করুণাদা বললেন, “নববর্ষে বাড়িতে একটা পার্টি দিচ্ছি, ভাবলাম তোমাকে একবার নামের লিস্টটা যাচাই করিয়ে নিই।” আমি সাধ্য ও বুদ্ধিমতো দু-একটা নাম তালিকায় যোগ-বিয়োগ করলাম। তারপর পুরোনো শুভানুধ্যায়ীর যা করা উচিত, একটু ভেবেচিন্তে করুণাদাকে বললাম, “দাদা, একটা কথা।” করুণাদা বললেন, “কী কথা?” আমি বিনীতভাবে বললাম, “আপনি ইংরেজিটা পার্টির রাতে একটু কম বললেন।”
নববর্ষের দিন গিয়ে দেখি একে একে বিশিষ্ট অভ্যাগতেরা আসছেন আর করুণাদা তাঁদের ‘হেপি নিউইয়ার’ বলে অভ্যর্থনা করছেন। আমি করুণাদাকে বললাম, “দাদা, হেপি নয়, হ্যাপি বলুন। লোকে কী ভাববে?” করুণাদা হেসে বললেন, “দ্যাখো তারাপদ, আমার ইংলিশ কেউ মাইন্ড করবে না, যদি আমার স্কচ ভালো হয়।”







