মৃত্যু এক চরম সত্য। কি হয় মৃত্যু মুহূর্তে? কোন সত্যের সম্মুখীন হন মৃত্যুপথযাত্রী? মোবাইলে পড়ার জন্য স্ক্রল করুন নিচে...

মৃত্যু মুহূর্ত- পর্ব এক

মৃত্যু এক চরম সত্য। কি হয় মৃত্যু মুহূর্তে? কোন সত্যের সম্মুখীন হন মৃত্যুপথযাত্রী? আসুন দেখে নেওয়া যাক ইতিহাস বিখ্যাত কিছু মানুষের মৃত্যু মুহূর্তের বিচিত্র চিত্র। কেউ শেষ মুহূর্তে রয়েছেন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়, কেউ চিরসত্য এর সন্ধান দিচ্ছেন শিষ্যদের, কেউ সন্ধান করছেন আলোর- এ এক অদ্ভুত রহস্য!!!! চারটি পর্বে অবন বসু বিখ্যাত কিছু মানুষের মৃত্যু মুহূর্তের বর্ণনা দিচ্ছেন।

জীবনতরী ডুবছে

সময়টা আশ্বিনের মাঝামাঝি।
দার্জিলিং-এ বেড়াতে গিয়েছেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী লেডি অবলা, আর ভগিনী নিবেদিতা, ওঁদের পারিবারিক বন্ধু। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন ভগিনী। বিজ্ঞানী ও তাঁর স্ত্রী দিনরাত এক করে যাবতীয় সেবাযত্ন করে চললেন তাঁদের ভারত-অন্তপ্রাণ বান্ধবীটির। কিন্তু অদৃষ্টের কী পরিহাস! কাকভোর। মেঘে ঢাকা আকাশ। শেষ ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে হঠাৎ স্পষ্ট উচ্চারণ করলেন তিনি, ‘‘আমার জীবনতরী ডুবছে, কিন্তু সূর্যের উদয় দেখবই।’’ আশ্চর্য! মেঘ কেটে যখন নতুন রোদের ছ’টায় ঝিকিয়ে উঠল আশপাশ, তখন তৃপ্ত প্রশান্ত মুখে চলে গেলেন মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল। তিনি তখন মাত্র ৪৩।

আর একজন বিখ্যাত মানুষের জীবনের শেষতম উচ্চারণের সঙ্গেও ‘সূর্য’ জড়িয়ে আছে। তবে তাতে সূর্য না-ওঠার পূর্বঘোষণা। ফরাসি এই পণ্ডিত মানুষটির নাম মিখায়েল নস্ত্রাদামুস। যাঁর মূল খ্যাতি ছড়িয়েছিল পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মহাদেশেরই সহস্র বছরের নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনার আগাম ভবিষ্যদ্বাণী সম্বলিত ১০ খণ্ডের ‘লে প্রফেতিস’ তথা ‘দ্য প্রফেসিস’ গ্রন্থের জন্য। গাউট এবং ইডিমা রোগে আক্রান্ত হয়ে ৬৩ বছর বয়সে দেহাবসানের ঠিক আগের দিন, তিনি ওঁর ব্যক্তিগত সচিব জঁ দ্যু শাভিগনি-কে ডেকে বলেন, ‘‘কাল সকালের সূর্য উঠবে যখন, আমাকে আর পাবে না।’’ ওঁর এই শেষ কথাটি অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। ১৫৬৬-র ২ জুলাই ওঁকে নিথর অবস্থায় ভূমিশয্যায় পাওয়া যায়। সূর্য উঠতে তখনও বেশ কিছুক্ষণ বাকি।

অন্তিম উচ্চারণ

একান্ত প্রিয় ও অনুগত এক বালক-সেবক ‘বরদা’-কে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখে তার প্রতি মমতায় মা রোগশয্যা থেকেই তাকে একটি সান্ত্বনাবাক্য শোনান—‘শরৎ রইল, ভয় কী!’ রাত দেড়টায় মহাসমাধিতে নিমগ্ন হওয়ার আগে এই ছিল শ্রীমায়ের অন্তিম উচ্চারণ।

আড়াই হাজার বছর খুব কম কথা নয়। কিন্তু কমবেশি ঠিক ততটাই পিছিয়ে যেতে হবে এক মহামানবের মহাপ্রয়াণকালে পৌঁছতে হলে।
তথাগত তখন ইহলীলা সংবরণের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। বয়স আশি বছর। বহু জায়গা ঘুরে, বিল্বগ্রাম হয়ে বৈশালী ছেড়ে কুশীনগরে এলেন। অসহ্য দেহযন্ত্রণা শুরু হল। অথচ মুখে সেই চিরপ্রসন্ন হাসিটি। অতি কষ্টে হিরণ্যবতী নদী পার হয়ে সঙ্গী শিষ্য আনন্দকে একটি শালবৃক্ষতলে তাঁর শেষ শয্যা প্রস্তুত করতে বললেন। এও মনে করিয়ে দিলেন, আশি বছর আগের এক বৈশাখী পূর্ণিমায় লুম্বিনী উদ্যানের এক শালবৃক্ষের নীচে তিনি যেমন পৃথিবীতে এসেছিলেন—ঠিক তেমন আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমার দিনেই এই বৃক্ষতল থেকেই পৃথিবী ছেড়ে যাবেন।
খবর পেয়ে অসংখ্য ভিক্ষু তাঁর চার পাশে এসে জড়ো হলেন। তাঁদের দিকে চেয়ে পূর্ণ আত্মজয়ী মানুষটি তাঁর জীবনের শেষতম বাণীটি উচ্চারণ করলেন: ‘‘বয়ধম্ম সংখার অপ্পমাদেন সম্পদেথ।’’ যার কাছাকাছি বাংলা তর্জমা দাঁড়াবে, ‘‘পঞ্চভূতে গড়া সবই নশ্বর। তাই আত্মমুক্তির জন্যই সচেষ্ট থেকো।’’ কথা ফুরোনোর নিমেষ-মধ্যেই দুর্লভ একমুখ তৃপ্তির হাসি নিয়ে চলে গেলেন সংসারত্যাগী রাজপুত্রটি!

মরে গিয়েই জানতে হয়

প্রায় ছ’-দশক জুড়ে ৫০-টিরও বেশি মাস্টারপিস চলচ্চিত্র নির্মাণের চিহ্ন ফেলে রেখে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্রকার আলফ্রেড হিচকক যখন তাঁর আমেরিকার বাড়ির রোগশয্যায় শুয়ে—২৯ এপ্রিল ১৯৮০ তারিখে শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে অসহায় ভাবে বলে উঠেছিলেন, ‘‘শেষটা সবারই এত অজানা! তাই মরে গিয়েই জানতে হয়, মৃত্যুর পর কী ঘটে।’’

আলোগুলো জ্বালিয়ে দাও

মৃত্যু মানে যে ভয়-ধরানো অন্ধকার, সে কথাই শোনা যায় কালজয়ী আমেরিকান ছোট গল্পকার ‘ও হেনরি’ তথা উইলিয়াম সিডনি পোর্টারের গলায়। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে দেহাবসানের ঠিক আগের মুহূর্তে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দিকে ফিরে উনি চেঁচিয়ে ওঠেন—‘‘চার্লি! আলোগুলো সব জ্বেলে দাও! অন্ধকারে ঘরে ফিরতে খুব ভয় করবে আমার!’’

Series Navigationমৃত্যু মুহূর্ত- পর্ব দুই >>

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?

লেখক পরিচয় |

Start typing and press Enter to search