হোলগার কারস্টেনের কথা অনেকেই শোনেননি। এই জার্মান ভদ্রলোক ধর্মীয় ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন, তাঁর লেখা “জেসাস লিভড ইন ইন্ডিয়া” বা “দ্যা জেসাস কন্সপিরেসি” রীতিমত আলোড়ন ফেলে দিয়ে ছিলেন।তাঁর মতে ক্রুসবিদ্ধ হবার পরেও যিশু বেঁচে ছিলেন, প্রায় গুপ্ত চরের মত সকলের অগোচরে রোম সাম্রাজ্যের বাইরে পালিয়ে জান।ইয়ুজ আসফ এবং রোজা বাল দরগা এর কথা রীতিমত জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে।হোলগার সাহেব নিজে ধর্মতত্তের স্নাতক, ফলে তিনি উপকথা বা লোককথার পাশাপাশি ভাষা তত্বের সাহায্যে বাইবেলের বিভিন্ন অজানা তথ্য, তিনি দাবি করেছেন বাইবেলও আসলে বলতে চায়নি যিশুর মৃত্যুর কথা।

যেমন … ক্রসবিদ্ধ অবস্থাতেই “পিতা এদের ক্ষমা করো” বলে প্রাণত্যাগ করলেন যিশু, দুপুর ১২ টায় তাঁকে ক্রসবিদ্ধ করা হয়, বিকাল ৩ টের সময় মৃত্যু। তাঁর মৃত্যু কথা শুনে রোমান শাসক পন্টিয়াস পাইলেট অবাক হয়ে যান, “সে কি! এতো তাড়তাড়ি!” কিন্তু তাঁর দুই পাশে যে দুই জন ডাকাত কে ঝোলানো হয়ে ছিল তারা তখনো মারা যায়নি। তাড়া তাড়ি মরবার জন্য তাঁদের পা ভেঙ্গে দেওয়া হয়। যে রোমান সেনাধ্যক্ষ কে জিশু সত্যি মরেছে কিনা দেখতে বলা হয়, তিনি যিশুর বুকে বর্শা দিয়ে আঘাত করেন এবং দেখেন তিনি সত্যিই মৃত। আরামাথিয়া অঞ্চলের শিষ্য জোসেফ এবং নিকোডেমাস মরদেহ নামিয়ে মস্তকি (myrrh) আর অ্যালোভেরা … এই দুই ভেষজে তৈরি প্রায় একশো পাউন্ডের এক তৈলাক্ত মিশ্রণ তাঁর শরীরে লাগিয়ে দেন এবং তাঁকে তাঁর পারিবারিক কবরখানায় নিয়ে যান।

বাইবেল বর্ণিত ঘটনার দিকেই তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষিত করবার চেষ্টা করেন… যে তিনঘণ্টার ক্রুসবিদ্ধ হয়ে কেউ মারা যান না, দুই দস্যুও মরেনি। এমন কি পন্টিয়াস পাইলট ও বিস্মিত হয়ে জান।ক্রিস্টান ধর্ম গুরুরা যখন বলেন যে রাত্রে চাবুকে চাবুকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়া হয়ে ছিল জিশুকে, ফলে তিনি দুর্বল হয়েই ছিলেন, আর তাই গোটা রাস্তাও নিজের ক্রস্টাও বয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। হোলগার অবশ্য এতেই থামেননি, তিনি প্রাচীন রোমান আইন ঘেঁটে দেখান যে ক্রুসবিদ্ধ হবার আগের রাত্রে অপরাধীকে ৩৯ ঘা চাবুকের প্রহার নিয়ম ছিল। ঐ দস্যু দেরকেও মারা হয়ে ছিল, তারা মারা যায়নি এবং ঐ দুই জনের পা ভেঙ্গে দিয়ে যিশু কাছে এসে রোমান সেনাধ্যক্ষ হটাত দয়ালু হয়ে গেলেন কেনও, শুধু বর্শা দিয়ে একটু খোঁচা দিলেন শুধু, তাও পাশ থেকে।সে যদি মৃত্যু নিশ্চিত করতে চায় তবে আঘাত সামনে থেকেই করবে এবং মনস্তত্ব তাই বলে। তাছাড়া মস্তকি আর অ্যালভেরা মিশ্রিত তেল মাখিয়ে মৃতদেহ সৎকার করার কোনও ইহুদি প্রথা সে আমলে ছিলনা। বরং মিশর এবং গ্রিক সভ্যতার আমল থেকে এই মিশ্রণ একটি কাজেই ব্যবহ্রত হতো তা হল ক্ষতস্থানের দ্রুত আরোগ্যে।

ক্রুসে পেরেক-বিদ্ধ এক মানুষ তিন ঘণ্টা থাকলেও বাঁচা যে সম্ভব, তা প্রমান করতে তিনি রোম সাম্রাজ্যের প্রথম যুগের ইহুদি ঐতিহাসিক ফ্লাভিয়াস জোসেফ এর একটি বর্ণনা তিনি উদ্ধৃত করেন… এক বার এক বিজয় অভিযান থেকে ফেরার সময় তিনি দেখেন তাঁর তিন পুরানো বন্ধুকে ক্রুসে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে, তিনি সম্রাটের কাছে তাঁদের প্রাণ ভিক্ষা করেন। রাজার অনুমতি পেয়ে তাঁদের নাবিয়ে এনে শুশ্রূষা করেন, তাঁদের মধ্যে দুই জন মারা গেলেও, এক বন্ধু বেঁচে যান।

তার মানে ক্রুসবিদ্ধ হওয়া মানেই মৃত্যু নয়।

তা ছাড়া পুরানো দিনের ইতিহাস থেকে হোলগার জানাচ্ছেন ঐ হটাত দয়ালু সৈনিক হলেন লঙ্গিনাস পরে তিনি কাপাডোকিয়া অঞ্চলের বিশপ হয়ে ছিলেন।তার মানে যিশুর প্রতি দয়া তার হটাত আসেনি।

আর যিশুর শেষ সঙ্গী জোসেফ এবং নিকোডেমাস ইহুদিদের যে সংগঠন যিশুকে ক্রুসবিদ্ধ করবার জন্য উঠে পরে লেগেছিল এরা সেই সংগঠনের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। আবার তাঁরা লুকিয়ে যিশুর শিষ্যত্ব ও গ্রহণ করে ছিলেন। আর তাই হোলগার বলেন ঐ দুই জন সাত-তাড়াতাড়ি যিশু কে নামিয়ে তাঁকে বাঁচাবার পরিকল্পনা করেছিলেন, এবং সঙ্গে নিয়ে ছিলেন ঐ রোমান সেনানী লঙ্গিনাস কে, আর তাই ঐ দয়া।

আর বাইবেলের সেই পুনরুত্থান? তিনদিন পরে তিনি মৃত্যুর থেকে জেগে উঠলেন,দেখা দিলেন অনুগামী দের? মেরি ম্যাগদালেন যখন কবর খানায় গিয়ে দেখেন মৃতদেহ সেখানে নেই, তিনি ছুটতে ছুটতে পিটার ও জনকে গিয়ে বলেন “ওরা প্রভুকে নিয়ে গিয়েছে। জানি না কোথায়।” হোলগারের বক্তব্য জোসেফ এবং নিকোডেমাস আগের রাত্রেই মেরি ম্যাগদালেন ও পিটার কে জানিয়ে ছিলেন তাঁদের পরিকল্পনার কথা। মেরি ম্যাগদালেন পরিকল্পনা মাফিক সকালে কবরখানায় যান, আর সেই কারণেই ঐরকম উক্তি।

আর মৃত্যু থেকে ক্রিস্টের পুনরুত্থান বা রেজারেকশান? প্রাচীন আর্মেনীয় ভাষায় যাতে কথা বলতেন যিশু, “চিজা” বলে যে শব্দটি বাইবেলে ব্যবহৃত হয়েছে তার প্রকৃত অর্থ রোগ হতে সেরে ওঠা, যদিও বাইবেলের অনুবাদে বার বার ঐ কথাটির অনুবাদে রেজারেকশান/ পুনরুত্থান বলা হয়েছে।

Series Navigation<< ইয়ুজ আসফের সমাধি এবং রহস্য ১

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?