করোনা ভাইরাস নিয়ে আপনার মনে অনেক ধন্দ রয়েছে? দেখুন তো, এখানে তার কিছু সুরাহা হয় কিনা।


করোনা ভাইরাস কি?

গঠনগতভাবে করোনা ভাইরাস একটা বিশাল আরএনএ (RNA) ভাইরাসের পরিবার। “করোনা” শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হলো মুকুট। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের তলায় এই পরিবারের ভাইরাসকে অনেকটা রাজার মাথার মুকুটের মতন দেখায়, সেই থেকে এই নামকরণ (ছবি ১ দেখুন)। অন্যসকল ভাইরাসের মতো এরাও জীবনধারণ ও বংশবৃদ্ধির জন্য কোন না কোন একটা প্রাণী বা উদ্ভিদ কোষের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে।

এই ভাইরাসের সবচেয়ে বাইরের অংশে থাকে গ্লাইকোপ্রোটিনের স্পাইক বা কাঁটা যেগুলোর সাহায্যে ভাইরাসটা জীবন্ত কোষে আটকে গিয়ে সংক্রামিত হয়। দ্বিতীয় উপাদানটা হলো রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ (RNA)। জীবন্ত কোষের ভিতরে প্রবেশ করে ভাইরাসটা  আরএনএ-র প্রতিলিপি তৈরি করে বংশ বিস্তার করে। আর তৃতীয় উপাদানটা হ’ল একটা লিপিড স্তর, এটা ভাইরাসের অন্যান্য অংশকে ধরে রাখে। করোনাভাইরাস-এর মারাত্মক প্রকোপ এবং এবং তাকে কিকরে ঠেকিয়ে রাখা যায়, সেটা বুঝতে হলে এই তিনটে অংশের কথাই আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

ছবি ১ –  করোনা ভাইরাস-এর গঠন (ছবির সূত্র)

যদিও করোনাভাইরাসের অনেক প্রজাতি আছে, তার মধ্যে মাত্র সাতটা প্রজাতি মানুষের দেহে রোগ সংক্রমণ করতে পারে [১]।  এদের মধ্যে চারটে সারা বছর ধরে অত্যন্ত সাধারণ হাঁচি-কাশি সর্দির উপসর্গ সৃষ্টি করে। এরা হল, 229E (আলফা করোনাভাইরাস)NL63 (আলফা করোনাভাইরাস)OC43 (বিটা করোনাভাইরাস)HKU1 (বিটা করোনাভাইরাস)

এছাড়া, মার্স কভ (MERS-CoV) – এটা একটা বিটা করোনাভাইরাস যা থেকে ২০১২ সালে মিড্ল্ ইস্ট রেস্পিরেটারি সিন্ড্রোম বা মার্স (Middle East Respiratory Syndrome, or MERS) ছড়িয়েছিল। সার্স কভ (SARS-CoV)– এটা একটা বিটা করোনাভাইরাস যা অতি তীব্র শ্বাস রোগ  বা সার্স (severe acute respiratory syndrome, or SARS) ছড়িয়েছিল। প্রথম ২০০২ সালে চীন দেশে এই রোগ দেখা গিয়েছিল।  মৃত্যুর হার প্রায় ১০০ রোগীপিছু ১০, তবুও এই রোগকে দ্রুত বাগে আনা গেছিলো কারণ মানুষ থেকে মানুষে তার সংক্রমণের হার ছিল কম। সব মিলিয়ে মোট ৮,০০০-এর কাছাকাছি রোগী এই রোগে আক্রান্ত হয় ও প্রায় ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়। গবেষণায় প্রমাণ হয় যে একধরনের গন্ধগোকুল প্রজাতির প্রাণীর থেকে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছিল।তৃতীয় আরেকটা টাইপ, সার্স কভ-২ (SARS-CoV-2) (severe acute respiratory syndrome coronavirus 2)-কেই নভেল করোনা ভাইরাস বলা হয়। এই সার্স কভ-২ মানুষের শরীরে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস ডিসিজ সংক্রামিত করে। এই ভাইরাসকে নভেল বা নতুন বলা হচ্ছে কারণ এই সংক্রামক ভাইরাসটা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। ভাইরাসটার আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি (2019-NCOV)। মানুষ থেকে মানুষে এর সংক্রমণের হার প্রচণ্ড বেশি। সারা পৃথিবীর প্রায় ১৬৬টা দেশ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO-র ১৮ই মার্চের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, – সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত ১,৯১,১২৭ জন (নতুন রোগী ১১,৫২৬), মৃত্যু হয়েছে ৭,৮০৭ জনের, সেরে উঠেছেন ৬৭,০০৩ জন [২]। ভারতে এখন (১৮ই মার্চ,২০২০) আক্রান্তের সংখ্যা ১৮০। মৃত্যু হয়েছে চারজনের। সেরে উঠেছেন উনিশজন [৩]।

ছবি ২ –  বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকারক করোনা ভাইরাস (ছবির সূত্র)

কোভিড-১৯ (COVID-19) কি?

নতুন আবিষ্কৃত বা নভেল করোনা ভাইরাসের সংস্পর্শে মানুষের দেহে যে ছোঁয়াচে রোগ সৃষ্টি হয়, সেই রোগের নাম কোভিড-১৯ (COVID-19) বা করোনা ভাইরাস ডিসিজ (coronavirus disease)। ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসে চীনদেশের ইউহান প্রদেশে সর্বপ্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। ভাইরাস সংক্রমণ সব বয়েসের মানুষের মধ্যে হলেও যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং যারা বয়স্ক, তাদের এই রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি [৪]।

করোনাভাইরাস  কি তার গঠন বদলাতে পারে অর্থাৎ এর কি মিউটেশান (Mutation) হতে  পারে?

এই প্রশ্নটা জরুরি কারণ ভাইরাস-কে একটা অপরিবর্তনশীল বস্তু বলে ভাবলে চলবে না। যেকোনো আর.এন.এ (RNA) ভাইরাসের মতো সার্স কভ-২-ও খুব সহজেই তার গঠন বদলাতে পারে। অর্থাৎ, ভাইরাস যখন বংশ বিস্তার করে তখন যেমন খুশি নিজেদের জিনের সজ্জা বদলে ফেলতে পারে। এই জিনের পরিবর্তিত সজ্জা নিয়েই ভাইরাস এক মানব দেহ থেকে অন্য মানব দেহে সংক্রামিত হয়।

এখনও পর্যন্ত, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও প্রায় ১০০বার মিউটেশান লক্ষ্য করা গেছে। বার বার মিউটেশানের ফলে ভাইরাস খুব সহজেই নতুন নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কিন্তু এই মিউটেশানের প্রভাবে কোভিড-১৯ যুক্ত রোগীর উপসর্গে কি পরিবর্তন হচ্ছে তা এখনি বলা সম্ভব নয়। তাঁর জন্য প্রচুর নমুনা সংগ্রহ করে ভাইরাসের জিনোম সিকয়েন্সিং করে পরিবর্তন লক্ষ্য করতে হবে [৫]। 

কোভিড-১৯(COVID-19)-এর উপসর্গগুলি কি?

রোগের উপসর্গ মূলতঃ জ্বর, শুকনো কাশি, ক্লান্তি। এছাড়া সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যাথা, ডায়েরিয়া-ও হতে পারে।

সাধারণ ফ্লু বা সর্দিজ্বরের সঙ্গে এর অনেক মিল পাওয়া যায়। আক্রান্ত হবার পর প্রথম দিকে উপসর্গ খুবই কম থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কখনও কখনও এর পরিণামে নিউমোনিয়া ও শেষে মাল্টি অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে মৃত্যুও ঘটতে পারে (১৪%)। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির কোন উপসর্গই থাকে না বা তারা অসুস্থ বোধ করেন না।  প্রায় ৮০% আক্রান্ত মানুষই সেরকম কোন চিকিৎসা  ছাড়াই সেরে ওঠেন।

জ্বর হলে, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত নিকটস্থ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তিনি বিষয়টা  খতিয়ে দেখে প্রয়োজন বুঝলে পরীক্ষা করাতে বলবেন। প্রতি ছ’জন আক্রান্তের মধ্যে, একজনের শ্বাসকষ্টজনিত গুরুতর অবস্থা হতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, এবং যারা বয়স্ক ( বিশেষত যাদের উচ্চ-রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা বা ডায়াবেটিস রয়েছে) তাদের এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে [৬]।

COVID-19 আটকানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের বহু দেশ দৈনন্দিন জীবনযাপন ও চলাফেরার উপর আমূল নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে। কারণ হিসাবে কতগুলো কথা উঠে আসছে মিডিয়াতে, যেমন ‘এক্সপোনেন্সিয়াল’, ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’, ‘স্যোশাল আইসোলেশান’ – এত সাবধানতার কী প্রয়োজন আছে? এই শব্দগুলোরই বা মানে কী?

কোভিড-১৯(COVID-19) একটা ছোঁয়াচে রোগ। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু শরীরে ভাইরাস ঢোকা মানেই এমন নয় যে COVID-19 রোগের উপসর্গ সঙ্গে সঙ্গে ফুটতে আরম্ভ করবে। কারোর ক্ষেত্রে দিন দুয়েকের মধ্যেই উপসর্গ দেখা দেয়, কারোর ক্ষেত্রে আবার সপ্তাহ দুয়েক! এই সময়কে বিজ্ঞানের ভাষায় ইনকিউবেশান পিরিয়ড (Incubation period) বলে। এখনো পর্যন্ত দেখা গেছে নভেল করোনাভাইরাসের ইনকিউবেশান পিরিয়ড গড়ে পাঁচদিনের মত। অর্থাৎ, এই ইনকিউবেশান পিরয়ডের মধ্যে সংক্রামিত কেউ না জেনেই আরও অনেককে সংক্রামিত করতে পারে।

কেন সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া জরুরি?

আগেই বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের গঠন লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে প্রধানত তিনটে উপাদানে গঠিত এই  নভেল করোনাভাইরাস। সবচেয়ে বাইরের অংশে থাকে গ্লাইকোপ্রোটিনের কাঁটা যেগুলোর সাহায্যে ভাইরাসটা জীবন্ত কোষে আটকে গিয়ে সংক্রামিত হয়। দ্বিতীয় উপাদানটা হ’ল রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ (RNA)। যখন কোনও জীবন্ত কোষের ভিতরে  ভাইরাসটি ঢোকে, তখন সে বংশ বিস্তার করে আরএনএ-র  প্রতিলিপি তৈরির মাধ্যম। আর তৃতীয় উপাদানটা হ’ল একটা লিপিড স্তর, এটা  ভাইরাসের অন্যান্য অংশ-কে ধরে রাখে। এই লিপিড স্তরটাকে  ভাঙ্গতে পারলে ভাইরাসটাকে মারা সম্ভব।

ছবি ৫ – সাবানের অণুর একটা মাথা, একটা লেজ (ছবির সূত্র)

সাবানের আণবিক গঠন দেখলে বোঝা যায় যে, এদের একটা মাথা এবং একটা লেজ আছে।

সাধারণত মাথাটা হাইড্রোফিলিক (hydrophilic), অর্থাৎ মাথাটার জলের অণুগুলোর প্রতি আকর্ষণ প্রবল। লেজটা আবার হাইড্রোফোবিক (hydrophobic), অর্থাৎ লেজটা জলকে একেবারেই পছন্দ করে না। এবার সাবান আর জল দিয়ে হাত ধুলে ভাইরাসের  লিপিড স্তরের প্রতি জলে গোলা সাবানের অণুর লেজের আকর্ষণ প্রবল হয়। অন্য দিকে  জলের অণু আবার সাবানের অণুর মাথাকে আকর্ষণ করে। এই টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে ভাইরাসের লিপিড স্তরটা ভেঙে যায়, ফলে ভাইরাসটা  নিষ্ক্রিয় হয়ে মারা যায়।

ছবি ৬ –  সাবান কিভাবে ভাইরাস-কে বিনষ্ট করে (ছবির সূত্রঃ ডিপার্টমেন্ট অফ সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি,গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া-র  ফেসবুক পেজ)।

কেন হ্যান্ড সানিটাইজারের থেকে সাবান বেশি কার্যকরী?

স্যানিটাইজারের মূল উপাদান হল অ্যালকোহল। অ্যালকোহল-ও করোনভাইরাস-এর লিপিড স্তরটা ভেঙে ফেলতে সক্ষম। কিন্তু সাবানের মতো ভাইরাসের লিপিড স্তরের সঙ্গে অ্যালকোহলের দ্রুত বন্ধন গঠন হয় না, যার ফলে স্যানিটাইজার ব্যবহার করলে ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হতে সময় লাগে।  তাই  হ্যান্ড স্যানিটাইজারের থেকে সাবান ভাইরাস নষ্ট করতে বেশি কার্যকরী। সাবান ও জল  ব্যবহারের সুযোগ না থাকলে তখন হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিকল্প হতে পারে।

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?