পরী- পর্ব ১
- পরী- পর্ব ১
- পরী- পর্ব ২
হাঁ হয়ে ভাবছিল প্রিয়নাথ। যা দেখল সেটা সত্যি তো? সত্যি সত্যি ওটা পাখিই ছিল তো? ডানা ছিল তা এক্কেবারে সত্যি, ডানা নাড়ছিল তো, শন্ শন্ আওয়াজটা বটগাছটার পাতাগুলোর ফিসফিসানির মধ্যেও বেশ কানে পৌছেছিল ওর। ওপরে তাকাতেই চোখ পড়েছিল পাখিটার দিকে। পাখিই তো? বুড়ো বটগাছটার একদম মাথার ওপরে, প্রায় ডুবো ডুবো দিনমনির শেষ আলোটুকুতে প্রিয়নাথের চোখে মস্ত পাখিটা ছায়ার মতন নেমে আসছিল। চিৎ হয়ে শুয়ে কান্ডটা দেখে হাঁ মুখ আর বন্ধ করতে পারছিল না প্রিয়নাথ। ভালো করে দেখার জন্য লাফিয়ে উঠেছিল সে। নাঃ, বুড়ো বটের মাথার ওপরের কচি পাতার সমারোহে আর কোন নড়াচড়া চোখে পড়েনি তার। আকাশের নরম অন্ধকার থেকে চুঁইয়ে পড়া শেষ আলোতে আর একবার নজর চালালো প্রিয়নাথ। কিচ্ছুটি নেই। এই ধূধূ মাঠের মধ্যে এই বুড়ো বটের থানে শুধু বুড়ো বট আর প্রিয়নাথ। পাখি নেই, আলো নেই, কোত্থাও আর কিচ্ছুটি নেই। পাখিটার কথা ভাবছিল প্রিয়নাথ। ডানা দুটো যেন কেমনতর ছিল। ডানা ভেদ করে গোধূলির নরম আলো ভরা আকাশটা দেখা যাচ্ছিল, ঠিক যেন কাঁচের ডানা। “ধূর স্বপ্ন হবে”, প্রবোধ দিল প্রিয়নাথ। একটু হাসিই পেল তার।
দশবছর বয়স থেকে রোজ বিকেল হলেই সে পা বাড়ায় থুড়ি সাইকেলের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে চলে আসে এই বুড়ো বটের থানে। বাপের সাইকেল। মরা বাপের। এই বুড়োবটের থানেই চোখ বুজেছিল অঘোরনাথ ঘোষ। অঘোরনাথের ফেরার কথা ছিল সেই সকালে। না আসাতে খুঁজতে বেরিয়েছিল গ্রামের লোক। অনেকরাতে খবর আসে বুড়োবটের থানে শুয়ে আছে অঘোরনাথ । ছুটেছিল প্রিয়নাথ গ্রামের সবার সাথে। হারিকেনের আলোয় দেখেছিল তার ফর্সা বাপটার সারা মুখ কালো। ঠোঁটের কষে ফেনা। অঘোরনাথের ডান পায়ের গোঁড়ালিতে দুটো ফুটো পাশাপাশি। অল্প রক্ত জমাট বাঁধা। যতীন গুনিন বলেছিল কালকেউটে। সাইকেলটা পাশেই দাঁড়িয়েছিল। পাহারাদারের মতন। বাঁশ এল, ঠান্ডা অঘোরনাথ লোকের কাঁধে চাপল । প্রিয়নাথ ধরল বাপের সাইকেল। সাইকেল ধরেই অবাক প্রিয়নাথ। আশ্বিনের হিমের পরশের মাঝে সে অনুভব করল সাইকেলের হ্যান্ডেল বেশ গরম। তার বাপের হাতের মতন। দুটো চোখে বান এসেছিল তার। হরিধ্বনি দেওয়া ছোট্ট মিছিলটার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়নাথ কাঁদছিল। যতীনগুনিন রতনজ্যাঠার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল,”মা তো গেছিল কবেই। বাপটাও গেল। দাদা, ছেলেটা একদম একা হয়ে গেল গো। ”
তা একাই হয়ে গিয়েছিল প্রিয়নাথ। কথাটথা বিশেষ বলত না, মিশত না সমবয়সীদের সাথে। ছোট থেকেই গায়ে গতরে খাটতে শিখে গিয়েছিল ছেলেটা। জনের কাজ করত গ্রামের সম্পন্ন চাষীদের জমিতে। রতন দত্ত বলেছিলেন, “আয় বাবা আমার কাছে এসে থাক ঘরের ছেলের মতন।” কে জানে কেন কখনও মন টানেনি প্রিয়নাথের। বাড়ি আছে, একটু ভাঙ্গা, কিন্তু যা হোক বড্ড প্রাণ আছে ছোট্ট ঘরটার। আর আছে সাইকেলটা। প্রিয়নাথ জানে, আছেন অঘোরনাথও।
গত দশ বছরে একদিনের তরেও ব্যতয় হয়নি নিয়মের। বিকেল হলেই সাইকেল, প্রিয়নাথ, বুড়ো বটের থান আর শান্তি।
কিন্তু আজ কিযে হ’ল ! অন্ধকারটা বেশ কশকশে হয়েছে এখন। ফেরার সময় হল প্রিয়নাথের। সিটে বসে প্রথম প্যাডেলটা মেরেই বিদ্যুচ্চমকের মতন চিন্তাটা এল, “পরী নয় তো ??!!”
দ্বিতীয় পর্ব