এক হেরো মানুষের গপ্পো
লোকটার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে নাৎসি কমান্ডার চেঁচিয়ে উঠলেন, “বল, তুই কে?” লোকটা নিরবে মাথা নিচু করে তার পকেট থেকে পাসপোর্ট আর কিছু কাগজপত্র বের করলেন। সেগুলো দেখে কমান্ডার অবাক হলেন—এই কঙ্কালসার লোকটা অলিম্পিয়ান? ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিকে ম্যারাথনে দৌড়িয়েছিল এই লোকটা! আর ওই ছবিটা? হিটলার স্বয়ং এর সঙ্গে করমর্দন করেছেন! সে সৌভাগ্যতো কমান্ডারেরও হয়নি!
“ছেড়ে দাও এনাকে,” কমান্ডার হেঁকে বললেন!
১৯৪৩ সাল, গ্রীস তখন নাৎসিদের কব্জায়। এক নাৎসি অফিসারের উপর হামলা চালিয়েছিল একদল গ্রামের লোক, কিন্তু কেউ স্বীকার করলো না কে সেই হামলায় ছিল। দোষী কে খুঁজে না পেয়ে গ্রামের প্রতিটি পুরুষকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে নাৎসিরা। সে গণহত্যা থেকে বেঁচে গেলেন কেবল এই একজন।
তবে এরপর লোকটি অদ্ভুত অপরাধবোধে ভুগতে থাকলেন। তার বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে উঠল। মাঝে মাঝে মনে হতো, কেন তিনি অলিম্পিকের কাগজ দেখিয়েছিলেন। তিনি তো ম্যারাথন জেতেননি, একাদশ স্থান পেয়েছিলেন। গ্রীসের সংবাদপত্রগুলো তাকে “বিশ্ব হেরো” বলে ব্যঙ্গ করেছিল। দেশের নাম ডোবানো এই অপদার্থের মরে যাওয়াই উচিত ছিল।
প্রায় দু বছর গুমরে থাকার পর লোকটি সিদ্ধান্ত নিলেন যে ভাগ্য যদি তাকে বাঁচিয়ে রাখে, তবে তাকে দেশের জন্য কিছু করতে হবে। বিশ্বযুদ্ধ শেষে গ্রীসে তখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলছিল। মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছিল, বিশেষ করে শিশুরা। লোকটি চোয়াল শক্ত করে উঠে দাঁড়ালেন। তার মনে হল, মরার আগে তাকে প্রমাণ করতেই হবে যে তিনি সত্যিকারের ম্যারাথনার, ফেইডিপ্পিডেসের উত্তরসূরি। ফেইডিপ্পিডেসও তো গ্রীসের জয়লাভের খবর পৌঁছে দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
ভালো করে খেতে না পাওয়া, ভীষণ গরিব এই মানুষটা চিঠি লিখলেন ১৯৩৬-এর ম্যারাথনের তার এক প্রতিযোগী ও বন্ধু মার্কিন ম্যারাথনার জন কেলিকে। তিনি জানালেন, তিনি ১৯৪৬ সালের আমেরিকার বস্টন ম্যারাথনে দৌড়াতে চান। স্ত্রী ভয়ে শিউরে উঠলেন! এই শারীরিক অবস্থায় ম্যারাথনে দৌড়ানো আর আত্মহত্যা করা একই কথা! কিন্তু কোনো কথা না শুনে লোকটি ঘটি-বাটি বেচে তার ১৪ বছরের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকার জাহাজ ধরলেন।
ম্যারাথনের দেশ থেকে একজন ম্যারাথনার বস্টন ম্যারাথনে দৌড়াবেন, এ খবরে আমেরিকাতে হৈচৈ পড়ে গেলো। কিন্তু দৌড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় জুতোও তার ছিল না—সেটাও কিনে দিলেন বন্ধু জন কেলি। তবে ডাক্তাররা তাকে আনফিট ঘোষণা করলেন। বন্ধুর সাহায্যে ডাক্তারদের অনুরোধ করে তিনি বস্টন ম্যারাথনে দৌড়ানোর অনুমতি পেলেন। দৌড় শুরুর আগে তার ছেলের পকেটে একটি কাগজ গুঁজে দিলেন, যেখানে লেখা ছিল গ্রীক বীরদের শপথ মন্ত্র— “Hy eimai seimerá na kerdiso, i na petháno san íroas.” মানে “হয় আমি আজ জিতবো, নয়তো বীরের মতো মৃত্যু বরণ করব”!
বস্টন ম্যারাথনে তিনি ভালোই শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ এক মাইল বাকি থাকতে দেখা গেলো তার বন্ধু জন কেলি তাকে অনেকটা পিছনে ফেলে দিয়েছেন। তখন দর্শকদের মধ্যে থাকা এক গ্রীক চেঁচিয়ে উঠলেন, “রান, রান ফর গ্রীস, ফর আওয়ার চিলড্রেন”। জন কেলি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সে চিৎকার শোনার পর তার মনে হয়েছিল একটি পাখি যেন ডানা মেলেছিল—লোকটি ঝড়ের গতিতে দৌড়ে গিয়ে ফিনিশিং লাইন ছুঁলো, যেন মানুষ নয়, ম্যারাথনের জনক ফেইডিপ্পিডেস স্বয়ং!
এ ধরনের অলৌকিক ম্যারাথন জয় আমেরিকার কাগজগুলোর প্রথম পাতায় স্থান পেলো। তাকে নিয়ে হৈহৈ পড়ে গেলো। একটি সাক্ষাৎকারের জন্য মোটা টাকা দিতে রাজি কাগজগুলো। কিন্তু সেই দরিদ্র লোকটি প্রেস কনফারেন্সে হাত জোড় করে বললেন, “আমার কিছুই চাই না, আপনারা গ্রীসকে বাঁচান!”
মার্কিন কংগ্রেসের কাছেও গ্রীসকে বাঁচানোর আবেদন করলেন এবং অভূতপূর্ব সাড়া পেলেন। তিনটি জাহাজভর্তি খাদ্য, ওষুধপত্র, আর তিন লক্ষ মার্কিন ডলার গ্রীসে পাঠিয়ে দেশে ফেরার বিমানে চড়লেন তিনি। এথেন্স এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পর এক লক্ষ মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছিল। রাস্তায় নামা আরও দশ লক্ষ মানুষের কাঁধে চড়েই বাড়ি ফিরলেন এই অনাহারক্লিষ্ট গরীব ম্যারাথনার। তার সম্মানে পার্থেননে আবার আলো জ্বালানো হলো—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম বার!
দুর্ভিক্ষ পীড়িত গ্রীস আবার ঘুরে দাঁড়ালো এক “বিশ্ব-হেরো” ম্যারাথনারের হাত ধরে! ৭৭ নম্বর জার্সি পরে বস্টন ম্যারাথনে দৌড়েছিলেন, ৭৭ বছর বয়সেই মারা যান এই ম্যারাথনার! বস্টন ম্যারাথনের প্রথম মাইল চিহ্নিত করা হয় তার একটি মূর্তি বসিয়ে, নাম—”স্পিরিট অফ ম্যারাথন”! ফেইডিপ্পিডেসের মতোই এই মানুষটি ম্যারাথনের ইতিহাসে অমর হয়ে গেছেন, কখনো অলিম্পিক না জিতেই! এই “বিশ্ব-হেরো” ম্যারাথনারের নাম—স্টালিওস কেরিয়াকেডিস (Stylianos Kyriakides)!
ম্যারাথনের জনক ফেইডিপ্পিডেসঃ ফেইডিপ্পিডেস ছিলেন প্রাচীন গ্রীসের এক দূত, যিনি ম্যারাথন যুদ্ধের পর গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়ে ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ম্যারাথন থেকে এথেন্স পর্যন্ত দৌড়ে গিয়েছিলেন। তিনি এথেন্সের জনগণকে পারস্য বাহিনীর বিরুদ্ধে গ্রীসের বিজয়ের সংবাদ দিতে এসেছিলেন। কথিত আছে, তিনি এথেন্সে পৌঁছে “আমরা জিতেছি” বলার পর পরই অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ফেইডিপ্পিডেসের এই দৌড় থেকেই আধুনিক ম্যারাথন দৌড়ের ধারণা এসেছে।