অবশেষে সেই শুভদিন এল। সকালে কড়াইশুঁটির কচুরি হল। সুনয়নী আলমারি খুলে একটা প্যাকেট বের করলেন। বললেন, পাঞ্জাবিটা দেখ তো কেমন । ৭৭ আর ৬৭ র বিবাহবার্ষিকী... কেমন হল??? জানতে হলে পড়ে ফেলুন স্বপ্নময়ের গল্পটি। মোবাইলে পড়ার জন্য স্ক্রল করুন নিচে...

গার্ড অফ অনার

ওদের বিয়ের দিনটা এমন দিনেই যে, ভুলে থাকা যায় না। ২৬ জানুয়ারি। ওই দিন সারা দেশে: পতাকা ওড়ে। ওরা ভাবতেই পারে ও সব বিবাহ কেতন। এবছর ৫০ পূর্তি। এটা সুবর্ণজয়ন্তী না হীরকজয়ন্তী নাকি প্লাটিনাম, সেটা ঠিক জানে না। নাম দিয়ে কী হবে? নামে কি আসে যায়? সেদিন সকালবেলায় চা। চায়ের সঙ্গে – অভ্যেস মতো রেডিয়ো। রেডিয়োতে সা-ব-ধান। আ… রাম • প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ। রামকুমার কানে হিয়ারিং এড, মানে ছিপিটা লাগিয়ে আরাম করে বসেছেন। রামকুমার বললেন বুঝলে না, দিল্লিও জেনে গেছে আমাদের ইয়ের পঞ্চাশ পুরল। তাই গার্ড অফ অনার দিচ্ছে। সুনয়নী বললেন, ইয়ে বলছ কেন? বিয়ে বলতে কী হয়? রামকুমার বললেন, লজ্জা করে।

সুনয়নী ঢ-অ-অং বলতে গেলেন। ‘ঢ’ শব্দটা কষিয়ে উচ্চারণ করতে গেলে জিভটাকে দাঁতের মাড়ির পিছনে জোরে চাপ দিতে হয়। সুনয়নী তাই করলেন, এবং চাপের ফলে উপরের দাঁতের পাটিটা বেরিয়ে এল, মোজায়েক মেঝেতে পড়ে গেল এবং ভেঙে গেল। রামকুমার বললেন, দুঃখ কোরো না। নতুন দাঁত গড়িয়ে দেব।
সুনয়নী বললেন, সে নয় গড়িয়ে দেবে। এমন বলছ যেন সোনার হার গড়িয়ে দেবে। কিন্তু বিকেলটা কী হবে? রামকুমার বললেন, কেন, বিকেল হবে, দুপুরের পরই তো বিকেল হবে। ন্যাকার মতো কতা বোলো নাকো। বিকেলে কি দাঁত ছাড়া বেরুব নাকি! এত প্ল্যান কলুম….

হ্যাঁ। ওরা প্ল্যান করেছিলেন। একদম পয়লা জানুয়ারি থেকে প্ল্যান করছিলেন ওরা। প্রথমে রামকুমার বলেছিলেন, পুরী যাবেন। সুনয়নী বললেন, তবে অন্য কাউকে বলো। গোরাচাঁদকে খবর দাও, আমাদের সঙ্গে চলুক। নইলে এত হ্যাপা কে সামলাবে? গোরাচাঁদ হল রামকুমারের খুড়তুতো ভাই। ব্যাচেলর। এখনও ইয়ং। ইয়ং মানে মাত্র বাষট্টি। মাত্র দু-বছর আগে রিটায়ার করেছে। রামকুমার এখন সাতাত্তর, সুননয়ী সাতষট্টি। ওদের দুই পুত্র সন্তান। একজন পুনে, অন্যজন আমেদাবাদ। ওদের ছেলেমেয়েরা ওখানেই পড়াশোনা করে। পোড়া বাংলায় ওরা আর আসবে না।

গোরাচাঁদের যাওয়ার কথা শুনে রামকুমার বলেছিলেন, কেন? আবার গোরাচাঁদ কেন? হানিমুনে কোনো থার্ড পার্সেন যায় নাকি? সুনয়নী তখনও বলেছিলেন ঢ-অ-অং। তখন অবশ্য জিভে ততটা জোর ছিল না। সুনয়নী বললেন, পুরী যাওয়া মানে বাস্কো-প্যাঁটরা পোটলা-পুটলি…। তুমি তো হার্টের অসুখের দোহাই দিয়ে কুটোটাও নাড়বে না। কে সামলাবে আটটার দুধ মুড়ি, পৌনে চারটেয় ফলের রস, সাড়ে পাঁচটায় ছানা, রাত্রে ইসবগুল ভেজানো….
–ও সবের কী দরকার? দুটো দিন নয় একটু অনিয়ম করব, কী আছে, সবরকম অনিয়ম। বেগুনি খাব, ফিশফ্রাই, কষা মর্টন, একটা ছোটো বোতলও …
—অ্যাঁ-কী বললে? আবার বোতল? বুঝিচি, পুরী যাওয়ার শখ উথলে উঠেছে কেন? আসলে সমুদ্রের ধারে বসে মেয়েদের স্নান। কান থেকে ছিপিটা খুলে ফেললেন রামকুমার। ওসব কথা কানে গেলে মরমে লাগে। মন খারাপ হয়।
সুনয়নীর মাইম দেখতে থাকেন রামকুমার। এতেও বেশ বোঝা যায়, প্রিয়া কী বলতে চাইছে।

রামকুমার এরপর একদিন বললেন, ২৬ জানুয়ারিটায় তাহলে এক কাজ করি। একটা গাড়ি ভাড়া নিই— সারাদিনের জন্য। গাড়িতে ওষুধ-টষুধ, বোতল-টোতল… মানে জলের, স্রেফ জলের বোতল, ছানা, ফল, সব নিয়ে…..
সুনয়নী বললেন, তা মন্দ হয় না। বেশ জয়রামবাটি – কামারপুকুর থেকে ঘুরে আসা যায়।
রামকুমার বললেন, ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি ‘সেলিব্রেট করতে কেউ জয়রামবাটি যায়? –কোথায় যায় তবে? রামকুমার বললেন, কেন ময়দান? ময়দানে হাওয়া খাব।
তারপর ফুচকা খাব। তারপর সায়েন্স সিটি যাব। ওখানে টয় ট্রেনে চড়ব। তারপর অ্যাকোয়াটিকা যাব। সুনয়নী বললেন, অ্যাকোয়াটিকা কী জিনিস? রামকুমার বললেন, ওখানে জলক্রীড়া হয়। টিভিতে দেখনি? ঢেউ ওঠে। জলে ঢেউ, মনে ঢেউ। আমি হাফপ্যান্ট পরে জলে নামব।
-আর আমি? আমি বসে বসে তোমার জলকেলি দেখব? সুনয়নী বলেন।
-ভূমিও জলক্রীড়া করবে। ব্রিড়াময়ী হবে। —শাড়ি পরে? ঢেউয়ে শায়া শাড়ি ঠিক থাকবে? -তাহলে শায়ার তলায় তুমি একটা প্যা-প্যা-প্যান্টি না থাক, আন্ডারওয়ার পরে নিও খন।
সুনয়নী নয়ন গোলাকৃতি করেন, মুখ থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করেন, আর রামকুমার কান থেকে ছিপি খুলে ফেলেন।

রামকুমার বললেন, কিছু ভাবলে ওই ২৬ জানুয়ারি নিয়ে? -কী আবার ভাবব? গতবার যা হয়েছিল তাই হবে। কড়াইশুঁটির কচুরি, আলুর দম, নাতি-নাতনিরা ফোন করলে ওদের সঙ্গে কথা, এবারও ফোন করবে। রামকুমার বললেন, গতবার আর কি হয়েছিল মনে নেই? সুনয়নী বললেন, কী হয়েছিল?
—রাত্রে? — মনে নেই আবার? কী লজ্জা, কী ঘেন্না..। ছিঃ, তোমার বাবা একটা নাম রেখেছিলেন বটে। একেবারে নামের সঙ্গে মিল।
আসলে গতবছর রামকুমার একটা ছোটো রামের শিশি কিনে এনেছিলেন। রাত্রে বাথরুমে ঢুকে ঢুকঢুক মারছিলেন। তারপর বামাল সমেত ধরা পড়লেন। রামকুমারবাবু সত্যিই একটু রামভক্ত, কিন্তু রাম নাম বিশেষ একটা হয়ে ওঠে না। অনেক হ্যাপা। রামকুমার এবার বললেন, তা হলে তোমার কথাই রইল। তুমি যা চাইছ তাই হবে। সকালে কড়াইশুটির কচুরি, বিকেলে নাতি নাতনিদের সঙ্গে কথা আর রাত্রে গত বছর যা হয়েছিল, ভাই ।
সুনয়নী আবার শুরু করলেন, রামকুমার ছিপি খুললেন।

অবশেষে সেই শুভদিন এল। সকালে কড়াইশুঁটির কচুরি হল। সুনয়নী আলমারি খুলে একটা প্যাকেট বের করলেন। বললেন, পাঞ্জাবিটা দেখ তো কেমন ।
রামকুমারও খাটের তলা থেকে একটা প্যাকেট বের করলেন। বললেন, কাল বাজার থেকে ফেরার সময় নিয়ে এসে লুকিয়ে রেখেছিলুম। শাড়িটা দেখ তো পছন্দ হয় কিনা।
সবই ঠিক ছিল। শুধু একটাই অঘটন দাঁতটা ভেঙে যাওয়া। দুপুরে ঠিক হল একটু বেড়ানো হবে। কোথাও না হলে গঙ্গার ঘাট। সুনয়নীর পছন্দ দক্ষিণেশ্বর, রামকুমারের আউটরাম ঘাট। শেষকালে সুনয়নী আউটরামেই রাজি হলেন। তবে রাই কিশোরীর মতো ভ্রূ-ভঙ্গি করে বললেন, তোমার নজার কেবল রামের দিকে। মিনতি সকালে আসে, টুকটাক রান্না করে, ঘর পরিষ্কার
করে। আবার সন্ধের দিকেও একবার আসে। মিনতিকে সুনয়নী বললেন, তিনটে নাগাদ একবার আসিস। সন্ধের দিকে আর আসার দরকার নেই। সুনয়নী ভাল নিলেন সন্ধেবেলার ওষুধ নিলেন, মাফলার নিলেন, চাদর নিলেন, মাংকি ক্যাপও। ছোটো টিফিন কৌটোতে ক-টা নলেন গুড়ের সন্দেশ, দুটো কমলালেবু। খুব গোছগাছ। মিনি হানিমুন।

মিনতিকে বললেন, একটু ডাক্তারের কাছে যাব, ট্যাক্সি ডেকে দে। বেড়াতে যাওয়ার কথা মিনতিকেও বলতে পারলেন না ওরা। লজ্জা করল। আউটরাম ঘাট। কতদিন পরে এলেন। ওরা শেষ এসেছিলেন এক যুগ আগে। নাতনির বয়স তখন তিন। এখন সব কত পালটে গেছে। পালটে গেছে জমানা। ছেলেমেয়েরা ঘন হয়ে বসে আছে, যা খুশি করছে। রামকুমার একটা ফাঁকা চেয়ার বা ফাঁকা গাছতলা খুঁজছেন। সুনয়নী বেশি হাঁটতে পারছেন না। হাঁটু ব্যথা। একটা কংক্রিটের চেয়ারে বসলেন। পশ্চিমে সূর্য লালচে হয়েছে। জলের দিকে ঝুঁকেছে। ও আকাশ সোনা সোনা। জলে ঝিকিমিকি। ঝিকিমিকি জল নদী টলোমল। ঝিকিমিকি জলে নৌকো। নাইয়া রে…। জলে তরঙ্গ। জলতরঙ্গ বাজে রে এই ঝিকমিক ঝিকমিক নদীর জলে ঢেউ খেলিয়া যায় রে… ঢেউ খেলিয়া যায়…। হাওয়া বয়। সুনয়নী মাফলার বার করেন, রামকুমারের গলায় পেঁচিয়ে দেন। গাছের পাখি শিস দিয়ে ওঠে। কিন্তু রামকুমার শুনতে পান না। কারণ উনি হিয়ারিং এডটা আনতে ভুলে গেছেন। জাহাজ ভোঁ দিল। পাখিরা কিচমিচ করছে, গাছের শুকনোপাতা ঝরে পড়ছে একটা দুটো, কাঁপতে কাপতে নীচে নামছে। সুনয়নীর নয়নে মুগ্ধতা। সুনয়নী রামকুমারের হাত ধরেন। থ্যাংকিউ বলতে চান। সুনয়নী জানেন, আস্তে আস্তে বললে রামকুমার শুনতে পাবেন না। আর থ্যাংকিউ শব্দটা এমন যে চিৎকার করেও বলা যায় না। গঙ্গার ঢাল বেয়ে সন্ধ্যা নামে। ছেলে ছোকরারা সাতাত্তর আর সাতষটিকে আড়চোখে দেখে। কেউ কেউ বাজে মন্তব্য করে। সুনয়নীর মনে হয়, একেই তো টোন কাটা বলে। বলুক গে। সুনয়নী রামকুমারের আর একটু গা ঘেঁষে বসেন। সুনয়নীর গায়ে চাদর। চাদরটা দিয়ে মুখের অনেকটাই আড়াল করেছেন। আজ দাঁত নেই কিনা।

একটা বাদামওয়ালা এল। রামকুমার হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। দু-ঠোঙা চিনে বাদাম চাইলেন। সুনয়নী বললেন, একটা। দাঁত নেই। মুকাভিনয়ে বুঝিয়ে দিলেন রামকুমারকে। রামকুমার বললেন, তুমি তাহলে ঝালনুন খাও। সুনয়নী তাই করতে লাগলেন। ধনেপাতা বাটা মাখা অল্প অল্প ঝালনুন আঙুলের ডগা থেকে জিভে চালান করতে লাগলেন। তারপর এল আলুকাবলি। সুনয়নী বললেন, নাতনিরা খুব ভালোবাসে। রামকুমার শুনতে পেলেন না, তাই বললেন, হ্যাঁ, ঝাল বেশি করেই দিও।
দুজনের হাতে দুটো আলুকাবলির পাতা। দুজনেই ঝালে হু- হা করছেন। সুনয়নী বোতল থেকে জল বের করেন। লাইনের উপর দিয়ে একটা সার্কুলার ট্রেন চলে যায়। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে দুটো ছেলে হাত নাড়ায়। কাকে কে জানে? রামকুমারও হাত নাড়ান। পাঁচটার ওষুধ দিতে ভুলে গেছেন সুনয়নী। এখন মনে হল। ওষুধ খাইয়ে দিলেন। একটা লোক গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে, আজি এই স্বর্ণালী সন্ধ্যায় একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু। বেসুরো। পাগলই হবে। সুনয়নীর দুঃখ হল। গানটা শুনতে পেলেন না রামকুমার। ছিপিটা আনতে ভুলে গেছেন সুনয়নী, এ নিয়ে একবারের জন্যও কিচ্ছুটি বললেন না রামকুমার।
এবার উঠতে হবে। ছেলে ছোকরারা জায়গা পাচ্ছে না । রামকুমারের মনে হল, ওরা ওদের হকের জায়গা আটকে রেখেছেন। রামকুমার বললেন, এবার উঠব।

সুনয়নীর আর একটু থাকতে ইচ্ছে করছিল। আলনা থেকে উনুন থেকে জানালা থেকে বাইরে। সুনয়নী রামকুমারকে বলতে চাইলেন, খুব খুব ভালো লেগেছে। বলার জন্য রামকুমারের কানের উপরের মাফলারটা সরালেন। তারপর কাঁধ ধরলেন, কানের কাছে মুখ নিয়ে গেলেন। সুনয়নী বলবেন- এমন সময় তীব্র শিসের শব্দ। পাখির নয়, মানুষের।

কিছুটা শুনতে পেলেন হয়তো রামকুমার। অদৃশ্য সিটিওলাকে বললেন, থ্যাংকিউ। সুনয়নীকে বললেন, বলো এটাই আজকের আসল গার্ড অফ অনার।

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?

জন্ম ১৯৫২। উত্তর কলকাতায় । কর্মজীবনের শুরু বাইশ বছর বয়সে দেশলাইয়ের সেলসম্যান হিসেবে । নানা জীবিকা বদলের পর আকাশবাণীতে দীর্ঘকাল, শেষ তিন বছর ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে যুক্ত ছিলেন। গত সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে লেখালেখি শুরু।

Start typing and press Enter to search