কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন: ইন্টারনেট প্রযুক্তির যুগান্তকারী অগ্রগতি
১৯৫০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা ডিএনএ’র গঠন আবিষ্কার করার পর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণাগারে এমন প্রযুক্তির সন্ধান চলছিল, যা তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। কয়েক দশক পর, আমেরিকার Northwestern University র প্রযুক্তিবিদরা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন – তারা হাতে কলমে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন সাধারণ ইন্টারনেট বহন করতে পারে এমন অপটিক কেবলের মাধ্যমেও সম্ভব।
এই গবেষণার প্রধান ছিলেন অধ্যাপক প্রেম কুমার, যিনি Northwestern University-র McCormick School of Engineering-এর ইলেকট্রিক্যাল এবং কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সদস্য। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কোয়ান্টাম যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন এবং ফোটোনিক কমিউনিকেশন অ্যান্ড কম্পিউটিং সেন্টারের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন: এটা কি?
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন বলতে বোঝায় – এমন একটি পদ্বতি যার মাধ্যমে একটি ফোটনের অবস্থা বা তথ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত করা যাবে , কিন্তু ফোটনটি নিজে ফিজিক্যালি কোথাও যাবে না। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে কোয়ান্টাম তথ্য (Quantum Information) একই ইন্টারনেট তথ্য সাধারণ অপটিক্যাল কেবলে্র মধ্যে দিয়ে পাঠানো সম্ভব হয়েছে, যা দিয়ে প্রতিদিন আমাদের সাধারণ ইন্টারনেট ডেটা চলাচল করে।
একসময় বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য সম্পূর্ণ আলাদা কেবল এবং পরিকাঠামো প্রয়োজন হবে। কিন্তু প্রেম কুমার এবং তার দল এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে দেখিয়েছেন, কোয়ান্টাম সিগন্যাল এবং সাধারণ ইন্টারনেট ট্রাফিক, একই কেবলের মধ্যে সহাবস্থান করতে পারে।
সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ কি ছিল?
কোয়ান্টাম ফোটন অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং দুর্বল। সাধারণ ইন্টারনেট কেবলে কোটি কোটি সাধারণ ফোটন প্রবাহিত হয়, যা সাধারণত আমাদের ইন্টারনেট ডেটা বহন করে। এদের মধ্যে কোয়ান্টাম ফোটন হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল।
অধ্যাপক কুমারের দল এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে ফাইবার অপটিক কেবলের বিভিন্ন অংশ বিশ্লেষণ করেন। তারা দেখেন, ইন্টারনেট কেবলের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য রয়েছে, যেখানে ডেটার চাপ তুলনামূলক কম। এই “শূন্যতা” বা কম ব্যস্ত অংশটি খুঁজে পেয়ে তারা সেখানে কোয়ান্টাম ফোটন প্রবাহিত করেন।
“এটা অনেকটা ব্যস্ত শহরের রাস্তার ফাঁকা লেন খুঁজে বের করে সেখানে বাইসাইকেল চালানোর মতো,” বলেন প্রেম কুমার।
গবেষণার ফলাফল
প্রথমে গবেষকরা পরীক্ষাগারে এই পদ্ধতি পরীক্ষা করেন এবং সফল হন। এরপর তারা সরাসরি একটি অ্যাক্টিভ ফাইবার অপটিক কেবলের মাধ্যমে কোয়ান্টাম ফোটনের তথ্য প্রবাহিত করেন এবং দেখতে পান, কোয়ান্টাম ফোটন কোনো ক্ষতি ছাড়াই গন্তব্যে পৌঁছেছে।
“এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত,” বলেন অধ্যাপক কুমার। “আমরা দেখিয়েছি, কোয়ান্টাম এবং সাধারণ নেটওয়ার্ক একই ফাইবার অপটিক কেবলে সহাবস্থান করতে পারে। ভবিষ্যতে নতুন অবকাঠামো গড়ার দরকার নাও হতে পারে।”
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই সাফল্য কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের ভবিষ্যৎকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তথ্য আদান-প্রদান আরও নিরাপদ ও দ্রুত হবে, কারণ কোয়ান্টাম যোগাযোগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো – হস্তক্ষেপ বা চুরি করার কোনো চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিকভাবে ধরা পড়ে।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই প্রযুক্তি একদিন আর্থিক লেনদেন, প্রতিরক্ষা এবং গুরুত্বপূর্ণ ডেটা ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব ঘটাবে। এটি বিভিন্ন শহর এবং দেশকে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত করতে পারে।
“এটি শুধুই সূচনা। ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং ক্লাসিকাল নেটওয়ার্ক একসঙ্গে কাজ করবে,” বলেন অধ্যাপক কুমার।
উপসংহার
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর অগ্রগতি, যা ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। উত্তর-পশ্চিম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাফল্য ভবিষ্যতে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে, যেখানে কোয়ান্টাম এবং সাধারণ ডেটা একই সঙ্গে একই কেবলে প্রবাহিত হবে।
সম্ভবত, কয়েক বছর পর আমরা এমন এক জগতে প্রবেশ করব যেখানে কোয়ান্টাম ইন্টারনেট আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠবে।