একটি নালিশ
বিচারক যখন বিচার পাইবার জন্য বিচারালয়ের কড়া নাড়ান, বুঝিতে হয় বিষয় গুরুতর। সাম্প্রতিককালে কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারক অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সুপ্রীম কোর্টের নিকট নালিশ করিয়াছেন যে তাঁহার Single Bench এর রায়কে উক্ত হাইকোর্টেরই Division Bench প্রায়ই স্থগিত করিতেছে। এর ফলশ্রুতি হিসাবে তাঁহার বিচার করিবার সংবিধান প্রদত্ত অধিকার লংঘিত হইতেছে। তাঁহার “হাত” “বাঁধা” পড়িতেছে। নালিশে বিচারপতি গঙ্গো এও জানাইয়াছেন যে ঘটনার ক্রমবিন্যাশ একটি ‘সেটিং’ র্যাকেটের প্রতি দিকনির্দেশ করিতেছে। অর্থাৎ হাইকোর্টের কোনো একটি এজলাসের রায়কে স্থগিত করিবার জন্য ‘ব্যবস্থা’ করা সম্ভব এবং এই ভয়ংকর অসাংবিধানিক বেআইনী কান্ডটি কোনো ‘র্যাকেট’ উপযুক্ত আদানপ্রদানের দ্বারাই করিয়া থাকে।
মাননীয় বিচারকের নালিশের নির্যাশ হইল কড়ি ফেলিলে রায়রূপি তৈল সহজেই খরিদযোগ্য। এতক্ষনে ভ্রূকুটিবদ্ধ পাঠক নিশ্চয়ই হাসিতেছেন। বিচারকের নিকট ইহা নূতন হইলেও বিচারালয় সৃষ্টির আদি হইতেই যে সেটিং চলিয়া আসিতেছে তাহা পাঠকরুপি জনতা বিলক্ষণ জানেন। বস্তুত বিচারালয় যে একটি জটিল ঘুঘুর বাসা, ইহাতে সত্যের দেবী অপেক্ষা লক্ষীদেবীরই প্রতিপত্তি অধিক তাহা একটি পরীক্ষিত সত্য।
তবে এক্ষেত্রে বিচারপতি গঙ্গো-র ‘নালিশ’ একটি বিশেষ কারনে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ঘটনাচক্রে তাঁহার এজলাসে স্বশাসিত সংস্থা স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে হওয়া উচ্চ-প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মী নিয়োগে প্রবল দূর্নীতি সম্পর্কিত কিছু মামলা চলিতেছে। বিচারকালীন শ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের বিবিধ রায়ের ফলে প্রথমে ছোট মৎস্য খাদক বড় মৎস্য, বড় মৎস্য খাদক হাঙ্গর, হাঙ্গর খাদক তিমি, তিমি খাদক তিমিঙ্গিল, তিমিঙ্গিল খাদক তিমিঙ্গিলগিল, তস্য খাদক তিমিঙ্গিলগিলগিল – ক্রমান্বয়ে দুর্নীতির কারবারিরা একে একে চিহ্নিত হইতেছিল। বিচারপতি গঙ্গো দুর্নীতির ঘেঁটি ধরিয়া নাড়া দিতেছিলেন। বহুদিন ধরিয়া ভয়াবহ দূর্নীতির যে সন্দেহ স্ফুলিঙ্গাকারে বহুলক্ষ বি.এ., এম.এ. র চেতনায় ছিল তাহা বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়কালীন বিভিন্ন ব্যাখ্যায় স্মূর্ত হইয়া উঠিতেছিল। শতাধিক শিক্ষক শিক্ষাকর্মীর চাকুরী যে সৎপথে হয় নাই, তাহারা যে অর্থ বা প্রভাবপতিপত্তির শক্তিতে আরো লক্ষ লক্ষ যোগ্য প্রার্থীকে ঠকাইয়া চাকুরী করিতেছেন তাহা দিনের আলোর ন্যায় জনসমক্ষে আসিল। ছোটমৎস্য হইতে তিমিঙ্গিল ডিঙাইয়া বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বিচারের লম্বা হাত’ যখন বৃহত্তর তিমিঙ্গিলগিল দের অস্তিত্ব বিপন্ন করিতেছে ঠিক সেই ক্ষনে Division Bench এর হস্তক্ষেপ এবং বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়ে স্থগিতাদেশ । একবার নহে একাধিকবার। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নালিশে আরও একটি তথ্য প্রকাশ পাইয়াছে যে কোনো এক আইনব্যবসায়ী তাঁহাকে খরিদ করিতে আসিয়াছিল। কিন্তু শ্রী গঙ্গোপাধ্যায় মেরুদন্ডহীন নহেন। তাঁহাকে খরিদ করা যায় নাই। ইহার পরেই Division Bench এর Stay অর্ডার। একথা অনস্বীকার্য যে Division Bench-এর রায়দান বিচার পদ্ধতির অঙ্গ এবং রায়টিও কোন বিশেষ আইন মোতাবেকই দেওয়া হইয়াছে।
কিন্তু দর্শকের প্রশ্ন স্থগিতাদেশের উপরে নহে। দর্শক ভাবিতেছে Division Bench- এ স্থগিতাদেশের আবেদন করিল কে? ব্যাক্তি না ব্যবস্থা ? দূর্নীতির কুশীলবদের মুখোশ সরাইয়া প্রকৃত মুখচ্ছবি সমাজের সামনে আনিতে এত অনীহা কাহার? র্যাকেটের না প্রশাসকের ? উত্তর যাহাই হউক, নালিশটি গুরুতর।