নমস্কার বন্ধুগণ,

আপনারা যখন এই খোলা চিঠিটি পড়বেন তখন ৫ তারিখ পেরিয়ে যাবে। চিঠির বিষয়বস্তু হয়তো একটু ক্লিশে হয়ে যাবে তবু দেওয়া থাকলো। পড়বেন অথবা সোজা ডিলিট।

আজ শিক্ষকদের দিবস। আমার কাছে নিজের ছাত্রজীবনের শিক্ষক দিবসের স্মৃতি খুব একটা স্পষ্ট নয়। সম্ভবত শিক্ষক দিবসের দিন স্কুলে বা কলেজে না যাওয়াটাই আমার দস্তুর ছিল। ছাত্র হিসেবে মাঝারি থেকে একটু নিচের দিকে ছিলাম। এমনকি দুষ্টুমিতেও তাই। ফলতঃ স্কুল অথবা কলেজের ‘নামে বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত’ ছেলেদের তালিকাতে কোনদিনই আমি ছিলাম না। হয়তো স্কুলে অথবা কলেজে আমার অনুপস্থিতিটা আমার শিক্ষকরা কখনো অনুভবই করেননি।

স্কুলে আমি ভুগতাম বিভিন্ন রকমের কমপ্লেক্সে। শিক্ষকদের ভয়টাই পেতাম, ভক্তি তেমন আসতো না। মনে হতো যেটা লিখছি সেটা ওনারা কাটবেনই। সত্যি বলতে কি, আমার পড়াশোনার জীবনে আমি এমন কোন শিক্ষককে পাইনি যিনি আমার ভুলটা না ধরে ঠিকটা ধরেছেন। কেউ আমাকে কখনো বলেননি যে প্রথমে জানতে হয়, জানা হলেই শেখা হয়। আমার শিক্ষকেরা স্কুলে প্রতিটি ক্লাসে শুধু শিখিয়েই গেছেন। আমি শুধু শিখতেই চেয়ে গেছি। এবং দিনের শেষে আমার শেখার ঝুলি শূণ্যই থেকে গেছে। ফিফথ অথবা সিক্সথ বেঞ্চে একেবারে কোনের দিকে বসে, মাস্টারমশাইদের শিকারি চোখ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতেই আমার স্কুলের দিনগুলো শেষ হয়ে গিয়েছিল।

কলেজের পরিস্থিতি ছিল আরো জটিল। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না আমার প্রিয় বিষয় কোনটা এবং আমি কি অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হব। দেখা গেল ইংরাজি বিষয়ের আমার নম্বরটা কিঞ্চিৎ বেশি আছে। সুতরাং ইংরাজি অনার্স নিয়ে কলেজের যাত্রা শুরু হল। এবং শুরুতেই ঝটকা খেলাম। প্রাইভেট টিউটর ঠিক করতে গিয়ে জানলাম একজন কলেজশিক্ষক-ই বাড়িতে প্রাইভেট টিউশন দেন। আশ্চর্য্য হয়ে দেখলাম, তার কাছে পড়ার জন্য অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হচ্ছে। দিলাম এবং বাদ পড়লাম। মানে প্রাইভেট টিউশনের অ্যাডমিশন টেস্টেই আমি বাতিল হলাম। স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম বাদ পড়লাম কেন। উত্তরে তিনি জানালেন যে আমার লেখাটি উপযুক্ত হয় নি। ব্যস্‌!!! বুঝলাম এখানে তিনি শুধু ‘উপযুক্ত লেখার’ লেখককেই পড়ান, অনুপযুক্তদের উপযুক্ত করে তোলা তার কম্ম নয়। শিক্ষকদের সম্পর্কে যে নেগেটিভ অনুভূতি আমার ছিল সেটা বাড়ল। কলেজ শেষের আগেই আমি জানতাম ‘কি পেশায় যেতে চাও’ রচনা লিখতে হলে একটি পেশার কথা কখনো লিখব না, সেটা হল শিক্ষকতার পেশা।

কিন্তু সেই শিক্ষকতার পেশাতেই আমাকে আসতে হল। তার পেছনে চাকরির অপ্রতুলতা, শিক্ষিত লোকেদের Inclination to security and peace এবং সর্বোপরি নিজস্ব কিছু ব্যর্থতাকেই আমি দায়ী করব। ২০০১ সালে শিক্ষকতার পেশায় প্রবেশ করে পায়ে পায়ে ২০ বছর চাকরি করে ফেললাম। আমার স্কুল কলেজের শিক্ষকদের শিক্ষকতার প্রতি যে তীব্র বিবমিষা নিয়ে আমি এই চাকরিতে এসেছিলাম, এই এত বছর পরেও তা অটুট আছে। ২০ বছরে বহুবার দেখেছি আমার পেশার মানুষজন কিভাবে অবলীলায় কচি মনটিকে ভেঙ্গে দিচ্ছে, কিভাবে ছাত্রছাত্রীদের ইনকুইজিটিভ মনটিকে শাসনের জালে বেঁধে তাকে রোবট করে তুলছে। কিন্তু এরই সাথে এটিও দেখেছি ছাত্রের বানানো একটি অতি সাধারণ জিনিস শিক্ষক মশাই সামান্য অর্থের বিনিময়ে কিনছেন শুধুমাত্র ছাত্রটিকে আরো ভালো কিছু বানাতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য, অথবা ঝাঁঝালো রোদ্দুরের মধ্যে ছাত্রদের সাথে শিক্ষকমশাই কোদাল চালাচ্ছেন ভালো কিছু গাছ লাগানোর জন্য, অথবা কবাডি ম্যাচে একটি শ্রেণী হেরে যাওয়াতে ছাত্রীদের সাথে কেঁদে ভাসাচ্ছেন শিক্ষিকা। বিবমিষা-র এক উলটো দৃশ্য এটি। দাঁড়িয়ে দেখতে হয়। মন ভালো হয়। শ্রদ্ধা জাগে।

আপনারা ভাবতে পারেন যে আমি পেশায় শিক্ষক হলাম কি করে আর এতগুলো বছর টিকে গেলাম কিভাবে। পেশায় শিক্ষক হলাম কি করে এই প্রশ্নের উত্তরটি বেশ সহজ। চাকরির পরিক্ষা দিয়ে। এছাড়া এ পেশায় আসা আমার পক্ষে কোনদিনও সম্ভব হোত না। আনইম্প্রেসিভনেস, অসুন্দরতা এবং নার্ভাসনেস বহুবারই আমাকে নানান অসুবিধায় ফেলেছে। এবং খুব কম বয়সেই এই তিনটি ব্যাধির সাথে আমি ঘর করতে শিখে গেছিলাম। লিখিত পরিক্ষার শেষে পারসোনালিটি টেস্টে সম্ভবতঃ অনেকগুলি ব্রাইট ক্যান্ডিডেটকে দেখে দেখে ক্লান্ত বোর্ড মেম্বাররা আমাকে পার করে দেন (এছাড়া একাদিক্রমে তিনটি প্রশ্নের ভুল উত্তর দেওয়া আমাকে সিলেক্ট করার পিছনে অন্য কারন… অবশ্য আমার মিলিটারি অফিসার সুলভ আদব কায়দাও তাদের আকৃষ্ট করতে পারে)। চাকরি জীবনের প্রথম কয়েক বছরে আমার অভিজ্ঞতা ছিল ডাঙায় তোলা মাছের মতন। কিভাবে কি পড়াব মাথায় আসত না। প্রত্যন্ত জায়গার স্কুল হওয়ায় ছাত্ররা বেশ কম ‘ব্রাইট’ ছিল। আমার পড়ানো তাদের মাথার ওপর দিয়েই বেড়িয়ে যেত। খুব কম সময়ের মধ্যেই আমি ছাত্রদের কাছে বিভীষিকা হয়ে উঠেছিলাম। আমার ক্লাসগুলো থাকত নিঃশব্দ, একেবারে গোরস্থানের নৈঃশব্দ। স্কুলে আমার পরিচিতি হয়ে গেল রাগি এবং ‘ডিসিপ্লিনড’ শিক্ষক হিসেবে। ছাত্রছাত্রীদের কোন গন্ডগোল হলেই আমার ডাক পড়ত। এক হাঁকেতেই স্কুলচত্বর শান্ত!! সবাই বেশ খুশি। আমার ইগোও হয়ে উঠেছিল হিলিয়াম বেলুন। সবই ঠিক, শুধু ওই গোরস্থানের নৈঃশব্দটাই খচখচ করত। আমিই জানতাম এই আপাত নৈঃশব্দের পেছনে রয়েছে আমার না শেখাতে পারার, আমার approachএর অক্ষমতা। ভাল লাগত না। এই সময়তেই একটা ঘটনা ঘটল যা আমার জীবনে একটা মস্ত পরিবর্তন নিয়ে এল।

আমি বিএড কোর্সে ইনসার্ভিস ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলাম। সেই কলেজের TIC তখন শক্তিপদ পাত্র। প্রথম ক্লাস নিলেন তিনি এবং আমি প্রেমে পড়লাম। আরে না মশাইরা, স্যারের প্রেমে নয়, তাঁর ক্লাসের প্রেমে পড়লাম। কি যে যাদু ছিল তাঁর কথায়, এক ঘন্টার ক্লাসে কখন আড়াই ঘন্টা কেটে যেত বুঝতে পারতাম না। সেই প্রথম বুঝেছিলাম এমন শিক্ষকও আছেন যাদের ক্লাস না করতে পারলে রাগ হতে পারে, যাদের ক্লাস করার জন্য চার ঘন্টার বাদুড় ঝোলা বাসযাত্রাও করা যায়। পুরো বিএড কোর্সের শেষে একটি জিনিসই জানতে পেরেছিলাম, শিক্ষক নয় আগে ছাত্র হতে হবে। এটাই বোধহয় এই পেশায় ‘আমি টিকে গেলাম কিভাবে’ প্রশ্নটির উত্তর।

বিশ্বাস করুন বন্ধুগন, বিএড এর পর ১৭ বছর কেটে গেছে, আমি আজও শিক্ষক হতে পারিনি। কিন্তু ছাত্র, অবশ্যই হয়ে উঠছি। প্রতিটি দিন যখন ক্লাসে যাই আমি ছাত্র, আরও ভাল ছাত্র হতে থাকি। কচিগুলো কখনও আমার কথা বোঝে কখনও বোঝেনা। কিন্তু ওরা আমাকে শেখায় কিভাবে ওদের অসংখ্য ভুলের মধ্যে থেকে ঠিক-টাকে খুঁজে নিতে হবে, কিভাবে ক্লাস এইটে ওঠা ABCD না লিখতে পারা মেয়েটির ইগোকে হার্ট না করে মূলস্রোতে আনতে হবে।

আমাদের সিস্টেম রোবোট পছন্দ করে। চাই প্রশ্নহীন আনুগত্য। সুতরাং তাদের প্রশ্ন করতে দিও না। কঠিন সিলেবাসের জালে বন্দী করে ফেল। শিক্ষক চাইলেও ইংরাজি ক্লাসে ভূগোলের উদাহরণ টানতে পারবেন না। সেটা হবে সময় নষ্ট। সবকিছুই লিনিয়ার। লাইন ভাঙ্গার উপায় নেই। এটা যদি মুদ্রার একপিঠ হয়, অন্য পিঠে অবশ্যই একটি সিস্টেমে থাকার বাধ্যবাধকতা আছে। জেনারাল একটি সিলেবাস ছাড়া পড়ানো, সবাইকে পড়ানো অসম্ভব – এই সত্যিটাও আছে। আসলে ক্লাসরুমে ছাত্রছাত্রীদের ‘স্ট্যান্ডার্ডের’ একটি বিশাল ফারাক আমাদের স্কুল এডুকেশানকে বেশ জটিল করে রেখেছে। কারন মূলত আর্থ-সামাজিক। তবে সে বিষয়ে কথা বলা আমার মত অকিঞ্চিৎকর ব্যক্তির উচিৎ নয়। এ বিষয়ে নোবেল প্রাপ্তরা রয়েছেন। পাত্রস্যারকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, “স্যার, যেভাবে বলছেন পড়াতে, তা শুনতে ভালই লাগছে। কিন্তু প্র্যাকটিকালি আমার ক্লাসে এ পদ্বতির ইমপ্লিমেন্টেশন করব কিভাবে? ওরা যে ABCD ঠিক করে লিখতে পারে না”। স্যারের উত্তরটা এখনও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে। স্যার বলেছিলেন, “সারাদিনে তোমার বকে যাওয়া শব্দজাল থেকে যদি অন্তত তিনটি শব্দও তোমার ছেলেমেয়েরা মনে নিয়ে বাড়ি যেতে পারে তবে তোমার পড়ানো সার্থক। তুমি বুঝবে তোমার ক্লাসরুম একঘেয়ে হয়নি, তুমি তাকে জানাতে পেরেছ। তুমি বুঝবে তুমি তাকে ইন্সপায়ার করতে পেরেছ।”
আজও এইভাবেই ক্লাসে যাই। শেখাতে নয়, জানাতে।

আমার একজন বন্ধু আছে, সে একজন হেডমাস্টার। আবার একই সাথে সে একজন কারাটেকা, বডি বিল্ডার, কবি, সুরকার, অভিনেতা, ফিলানথ্রোপিস্ট, রেজিস্টার্ড রক্তদাতা এবং ছাত্র (ফিল্ম ডিরেকশান-এর)। কথাটা খেয়াল রাখবেন বন্ধুগন, ‘একইসাথে’। কোনটার জন্য কোনটা কম করে নয়। সবকিছুকেই সে একসাথেই নিখুঁতভাবে চালাচ্ছে। কিভাবে করছে এতকিছু? তার কথায়- “ব্যাপারটার শেষ দেখে ছাড়তে হবে…”। সে আমার কাছে এক আশ্চর্য্য মানুষ। তার কাছেও আমি এক গোপন ছাত্র। সে আমার এক গোপন শিক্ষক।

সংস্কৃতে একটি শব্দবন্ধ আছে, ‘কোহহম্‌’ (कोऽहम्‌)। এর অর্থ আমি কে। শিক্ষক? না, আমি ছাত্র। শিখছি প্রতিদিন।

তাই আজ যারা আমাকে শিক্ষক ভেবে প্রণাম করল বা হাতে ধরাল স্মারক, অথবা যারা আমাকে শিক্ষক ভাবেন তাদেরকে এই সত্যিটাই জানানোর প্রয়োজন অনুভব করছি।

রাজেশ সেন
কল্যানী
৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২২

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?