মৃত্যু মুহূর্ত- পর্ব তিন
- মৃত্যু মুহূর্ত- পর্ব এক
- মৃত্যু মুহূর্ত- পর্ব দুই
- মৃত্যু মুহূর্ত- পর্ব তিন
- মৃত্যু মুহূর্ত- পর্ব চার
যতক্ষণ না অঙ্ক শেষ হচ্ছে
যাওয়ার বেলা ঘনিয়ে এলে কেউ রাগেন, কেউ হাসেন, কেউ বা অস্থির হয়েও ওঠেন। কিন্তু যদি একটি মানুষকে মানুষেরই দেওয়া মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কোনও শেষ কথা বলে যেতে হয়? কী হতে পারে সেই অন্তিম ভাষণ?
১২০০ বছর আগের কোনও এক সকালে এক রোমান সৈন্যর হাতে দু’দিকেই ধার দেওয়া চওড়া তরবারি। অথচ তার সামনেই কারাগারের মেঝেতে বসে তখনও এক বৃদ্ধ দুর্বোধ্য কী সব অঙ্ক কষে চলেছেন একমনে! মানুষটি পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ আর্কিমিডিস। সৈন্যটির মুখে বধ্যভূমিতে যাওয়ার আদেশ শুনেও মুখ না তুলেই বললেন— ‘‘না! যতক্ষণ এই অঙ্ক শেষ না হচ্ছে, যেতে পারব না আমি!’’
পরমুহূর্তেই পৃথিবীর সবচেয়ে দামি মাথাটিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল তাঁর অশক্ত দেহ থেকে—মানুষের চিরকালীন মুর্খতার প্রমাণ হিসাবে।
তবে জ্ঞানীর সহজাত পাগলামো ছাড়াও যে প্রাণদণ্ডকে একই ভাবে উপেক্ষা করা যায়, তা অবশ্য দেখিয়ে গেছেন আর্জেন্তিনীয় বংশোদ্ভূত কিউবার মহাবিপ্লবী চে গেভারা। ১৯৬৫-তে কিউবার বহু বছরের সামরিক সরকারের পতন ঘটিয়ে—ফের বছর দুয়েকের মধ্যেই চে বেরিয়ে পড়েন বলিভিয়ার সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা-যুদ্ধ চালাতে। ১৯৬৭-র ৮ অক্টোবর ১৮০০ বলিভিয়ান সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীর সঙ্গে অসম যুদ্ধে আহত অবস্থায় তিনি ধরা পড়ে যান।
পরদিন ৯ অক্টোবর বিকেলে লা হিগুয়েরা গ্রামের এক ভাঙাচোরা গ্রাম্য স্কুলঘরে বন্দি অবস্থায় ওঁকে হত্যা করা হয়। মোট ৯টি গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে চে যখন পৃথিবী ছেড়ে যান—তার ঠিক আগের মুহূর্তটিতেই মৃত্যু আসন্ন জেনেও তিনি তাঁর ঘাতক মারিও টেরান নামের ৩১ বছর বয়সি বলিভিয়ান সৈন্যটিকে তীব্র শ্লেষের গলায় বলে উঠেছিলেন— ‘‘জানি, মারতে এসেছ আমায়! কাপুরুষ কোথাকার! মারো! কিন্তু মনে রেখো, স্রেফ একজন মানুষকেই মারছ!’’
ইচ্ছাপত্র
জীবনে শেষ দাঁড়ি নামার আগে অক্ষম আঁকাবাঁকা রেখায় মনের কথা লিখেও যান কেউ কেউ।
গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টটলকেই এ ক্ষেত্রে অন্তিমেচ্ছা লিখনের পথিকৃৎ ভাবা হয়। কেননা খ্রিস্টজন্মের ৩২২ বছর আগেই ৬২ বছর বয়সি এই মানুষটি মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়েও লিখে গিয়েছিলেন তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্র।
যাতে তিনি তাঁর সমস্ত ক্রীতদাসকেই মুক্তি দিয়ে যান এবং জানিয়ে দেন, কী ভাবে কোথায় তাঁকে সমাহিত করতে হবে।
এই ইচ্ছাপত্র নিয়ে এক করুণ-মধুর কাহিনি রয়েছে আমেরিকায়।
আঠেরো শতকে মুষ্টিমেয় যে ক’জন মানুষের সাহস ও দৃঢ়তায় ভর দিয়ে ইংল্যান্ডের শাসন হটানো এবং আলাদা আলাদা কয়েকটি রাজ্যের বদলে মিলিত ভাবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব হয়, গুভেরনিয়ার মরিস ছিলেন তাঁদের অন্যতম। এমনকী আমেরিকার সংবিধানের মূল রচয়িতাও তিনিই।
তা, ১৮১৬-য় ৮৪ বছর বয়সে মরিস যখন মারা যান, তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রে লেখা ছিল—‘‘আমার সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেকাংশ পাবেন আমার ৬২ বছর বয়সি স্ত্রী অ্যানি। অবশ্য একটি শর্তেই তিনি পূর্ণ সম্পত্তি পেতে পারেন। যদি তিনি আবার কাউকে বিয়ে করেন।’’
আসলে প্রচলিত কর্তব্যের সীমা-ডিঙোনো অমন এক সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন শুধুই প্রিয়তমা স্ত্রীর একাকীত্ব দূর করতে চেয়ে।
যদিও ঘটনাক্রমে তাঁর ওই অন্তিমেচ্ছা পূর্ণ হয়নি। কেননা তাঁর কঠিনহৃদয় উকিল প্যাট্রিক হেনরি তৎকালীন আইনি ক্ষমতাবলে মরিসের সম্পত্তি হস্তান্তরের শর্তটিকে ‘সামান্য’ বদলে দেন এই মর্মে যে—একমাত্র পুনর্বিবাহ না-করলেই অ্যানি সমস্ত সম্পত্তি লাভ করবেন। নয়তো কানাকড়িও জুটবে না তাঁর বরাতে।
অন্য দিকে মৃত্যুর আলিঙ্গনকালে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার উজ্জ্বলতম উদাহরণ যদিও বিখ্যাত ফরাসি জীবাণুবিজ্ঞানী লুই পাস্তুর-এর কলমেই ধরা আছে। যাতে সুভদ্র ও পরম অনুরাগী পাস্তুর লিখেছিলেন—‘‘…দেশের আইন অর্ধাঙ্গিনীকে যা-যা দিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়, তার সবটুকুই দিয়ে গেলাম আমার প্রিয় স্ত্রী মেরি লরেঁত-কে। কেননা, আমার সন্তানেরা যেন তাদের মায়ের প্রতি কর্তব্যে অবহেলার কোনও সুযোগ না পায় কখনও। বরং তারা যেন আজীবন ওঁকে কোমল মমত্ব দিয়ে ঘিরে রাখে—যা ওঁর একান্ত পাওনা।’’