বদলে যেতে পারে দিন রাতের হিসাব
বেড়ে গিয়েছে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি! ২৪ ঘণ্টার কম সময়েই পার হচ্ছে দিন। গত মাসের ২৯ জুন পৃথিবী দ্রুততম গতিতে নিজের দৈনিক পাক শেষ করেছে। ২৬ জুলাই ও একই ঘটনা ঘটেছে। ওই দিন ২৪ ঘণ্টার থেকে ১.৫০ মিলিসেকেন্ড কম সময়ে পৃথিবী একবার পাক খেয়েছে। পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় কৃত্রিম উপগ্রহ নির্ভর সব প্রযুক্তি মারাত্মক বিপাকে পড়তে চলছে। সবচেয়ে ভয় আন্তর্জাতিক বিমান পরিযান নিয়ে। কৃত্রিম উপগ্রহ ঠিক মতো কাজ না করলে বড়সড় দুর্ঘটনার মধ্যে পড়তে হতে পারে।
ছোটবেলা থেকে পৃথিবী নিয়ে পড়ে আসা সব চিন্তাভাবনা বদলের পথে। ভূগোল বইতে লেখা রয়েছে ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবী একবার নিজের অক্ষপথে এক পাক দেয়। ঘূর্ণনের গতি বেড়ে গেলে পৃথিবীর গতিপ্রকৃতি নিয়ে চলে আসা বহু ধারণা আমূল বদলের আশঙ্কাও থাকছে।
কেননা গত ২৯ জুন পৃথিবীর গতি এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তা ২৪ ঘণ্টার পূর্ণ সময়ের থেকে ১.৫৯ মিলিসেকেন্ড কম সময়ে নিজের দৈনিক ঘোরা শেষ করে। পার্থক্য মিলি সেকেন্ডের মতো তুচ্ছ হলেও গাণিতিক ওই কম সময় মহাজাগতিক অনেক গণনাকে ভুল দিকে নিয়ে যেতে পারে।
পৃথিবীর এই যে উলোটপুরাণ, তার দিকে এবছর নয়, বিজ্ঞানীরা নজর রাখছিল অনেক দিন ধরে। পারমাণবিক ঘড়ির মাধ্যমে ১৯৭৩ সাল থেকে পৃথিবীর ঘূর্ণনে কতটা সময় লাগছে তা পর্যবেক্ষণ করে আসছিলেন বিজ্ঞানীরা। ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল আর্থ রোটেশন অ্যান্ড রেফারেন্স সিস্টেম সার্ভিস’ বা ‘আইইআরএস’ নামক সংস্থা তদারকিতে চলছিল ওই কাজ। গত সাল থেকেই পৃথিবীর এই গতি বৃদ্ধির নজরে এসেছিল বিজ্ঞানীদের। তবু তাঁরা কোনও কথা না বলে শুধুই অনুসন্ধান চালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু যতই দিন গিয়েছে ততই ‘আইইআরএস* বিজ্ঞানীরা দেখছেন, দিনের দৈর্ঘ্য ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে।
২০২২’র ২৯ জুন পৃথিবী যে দ্রুততম
গতিতে নিজের দৈনিক পাক শেষ করে তখন প্রমাদ গোনেন তাঁরা। আর কাল বিলম্ব না করে বিষয়টি প্রকাশ করে দেন। তবে কেন পৃথিবীর দিনের আহ্নিক গতি বাড়ছে তার কারণ নিয়ে এখন দ্বিধাবিভক্ত বিজ্ঞানীকুল। পৃথিবীর গতি যেমন বাড়ছে, তা কোন কোন সময় কমতেও দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির জন্য ‘আইইআরএস’ বিজ্ঞানীরা মেরু প্রদেশের বরফের চাদর গলে যাওয়াকে প্রাথমিকভাবে দায়ী করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে বাড়ছে পৃথিবীর তাপমান। আর তাতেই দ্রুত গলছে পুরো মোটা বরফের চাদর। বিশ্বের অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মতে, শুধু বরফের চাদরের জন্য পৃথিবীর ঘূর্ণনের এমনতর বেগ বাড়তে পারে না। এর জন্য দায়ী পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা গলিত লাভা। পৃথিবীর অভ্যন্তরের গলিত পদার্থের ঘনত্বের কমা বাড়ার জেরেই পার্থক্য তৈরি হচ্ছে গতির। পৃথিবীর এই গতিবেগ বেড়ে যাওয়া আমাদের দৈনন্দিনের কাজে এখনই তেমন প্রভাব না ফেললেও ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীর গতিবেগ বৃদ্ধি হয়ত ভবিষ্যতে সমস্যা করতে পারে।
প্রযুক্তিগত দিক থেকেও এর পরিণাম হতে পারে গুরুতর। এর কারণ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে যেসব কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে ঘুরে চলেছে, সেগুলো যখন তখন বিগড়ে যেতে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর গতি আধ মিলি সেকেন্ড বদলে গেলে, নিরক্ষীয় অঞ্চলে উপগ্রহগুলির অবস্থান সরে যেতে পারে প্রায় ১০ ইঞ্চি।
ইন্টারনেট ব্যবস্থা থেকে জিপিএস প্রযুক্তি, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেকটাই নির্ভর করছে এই উপগ্রহের ওপরে। পৃথিবীর গতি বিগড়ে যাওয়ার জেরে মারাত্মক বিপদ ঘটতে পারে বিমান পরিচালনা, ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ থেকে ব্যাঙ্ক পরিষেবা পরিচালনে। মোবাইল ব্যবহারেও সমস্যা হতে পারে। মোবাইল টাওয়ার ঠিকমতো কাজ না করলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এখানেই শেষ নয়। পৃথিবীর গতিবেগ বাড়া কমাতে নতুন করে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানো নিয়েও মুশকিল হতে পারে। নির্দিষ্ট গতিবেগে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল পার করে হয়ত ওই কৃত্রিম উপগ্রহকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৌঁছে দেওয়া যাবে না।