গত ৩ মে থেকেই উত্তপ্ত মণিপুর। মেইতেই ও জনজাতি সংঘর্ষের বলি অন্তত ৬০ জন। কেন এই সংঘাত? এর পটভূমিই বা কী? জানার জন্য পড়ুন। মোবাইলে পড়ার জন্য স্ক্রল করুন নিচে...

অশান্ত মনিপুর – ৩

জাতিগত হিংসার ভয়াবহতা মনিপুরে আবার ফিরে এলো। ৩রা মে অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ মনিপুর ইম্ফলে একটি মিছিল করে এবং তারপরেই ইম্ফল পূর্ব, ইম্ফল পশ্চিম সহ, কাকচিং, থাউবাল, কাংপোকপি, টেংনুপাল, জিরিবাম, চুড়াচাঁদপুরের মতন জেলা থেকে হিংসার খবর আসতে থাকে। সরকারি মতে এখনো পর্যন্ত প্রায় ৬০ জন মারা গেছেন আহত হয়েছেন ২০০র বেশি মানুষ। বেসরকারি মতে সংখ্যাটা বহুগুণ বেশি। মায়ানমারের সীমানাবর্তী হওয়ায় মনিপুরের এই অশান্তি সারা ভারতবর্ষের নিরাপত্তার এবং অখন্ডতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।


ট্রাইবাল স্টুডেন্টদের এই মিছিল মূলত ছিল ১৪ এপ্রিল মনিপুর হাইকোর্টের একটি আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ১৪ই এপ্রিল মনিপুর হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায়কে রাজ্যের সিডিউল ট্রাইব লিস্টে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করার জন্য আদেশ দেয়। যদিও পরে সুপ্রিম কোর্ট মনিপুর হাইকোর্টের এই রায়টিকে বিরত করে। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উপত্যকাবাসী মেইতেই সম্প্রদায়ের সাথে রাজ্যের পার্বত্য এলাকার অধিবাসী নাগা এবং কুকিদের বহু পুরনো গোষ্ঠী বিবাদকে উসকে দিয়েছে।

অশান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল মেইতেই সম্প্রদায় ভুক্ত মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং এর সাথে রাজ্যের কুকি সম্প্রদায়ভুক্ত এম এল এ এবং মন্ত্রীদের বিবাদের মধ্যে দিয়ে। গত মাসে প্রায় এক ডজন বিজেপি এমএলএ, যাদের অধিকাংশই কুকি, দিল্লিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে অনুরোধ করে এসেছিলেন। অর্থাৎ মেইতেই এবং কুকিদের মধ্যে অশান্তির চোরা স্রোত বইছিলই।

ভৌগোলিকভাবে মনিপুরকে ইম্ফল উপত্যকা এবং পার্বত্য এলাকা দু ভাগে ভাগ করা যায়। মনিপুরের সাতটি বিধানসভা ক্ষেত্রের ৪০টি ঘনবসতিপূর্ণ ইম্ফল উপত্যকার ছটি জেলাতে রয়েছে। বাকি কুড়িটি বিধানসভা ক্ষেত্র দশটি জেলায় ছড়ানো আছে। উপত্যকার এলাকাটি সমগ্র মনিপুরের ভৌগোলিক ক্ষেত্রে্র মাত্র ১১ পার্সেন্ট কিন্তু মনিপুরের মোট জনসংখ্যার ৫৭% এই এলাকাতেই বাস করেন। এই এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হলো মেইতেই। মেইতেই-রা বেশিরভাগই হিন্দু। মেইতেই রা অধিকাংশই সিডিউল কাস্ট এবং ওবিসি শ্রেণীভুক্ত। মনিপুরের অষ্টআশি শতাংশ ভৌগোলিক এলাকা পার্বত্য জেলা গুলির মধ্যে পড়ে। কিন্তু এই পার্বত্য এলাকাতে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪৩ শতাংশ বাস করে। দক্ষিণ-পশ্চিমে কুকি এবং পার্বত্য এলাকার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে বাস করে নাগারা। কুকি এবং নাগাদের বেশিরভাগই খ্রিস্টান। কুকী এবং নাগারা সিডিউল ট্রাইব শ্রেণীভুক্ত।

ট্রাইবাল সম্প্রদায় অধিকাংশ সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দাদাগিরি এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে এক একচোখোমির অভিযোগ তোলে। অন্যদিকে মেইতেই রা অন্যান্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাদের এক ঘরে করে রাখার অভিযোগ করে। ১৯৫১ সালের সেন্সাস অনুসারে মেইতেইদের জনসংখ্যা যেখানে ছিল ৫৯%, ২০১১ সালের সেন্সাসে সেটি কমে হয়েছে ৪৪%। জনসংখ্যার হার কমার পেছনে মেইতেইরা আঙুল তোলে কুকি এবং নাগা সহ অন্যান্য ট্রাইবাল সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির দিকে। এছাড়াও মনিপুরের অধিবাসী হওয়া সত্বেও মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চলে জমি কিনতে না পারার বিষয়ও মেইতেইরা বিক্ষুব্ধ।

এ সমস্যার সমাধানের জন্যই মেইতেই ট্রাইব ইউনিয়ন মনিপুর হাইকোর্টে মেয়াদের সিডিউল ট্রাইব হিসেবে বিবেচনা করার জন্য আর্জি করে। তাদের যুক্তি ছিল ১৯৪৯ সালে প্রিন্সলি স্টেট অফ মনিপুর যখন ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়ার সাথে সংযুক্ত হয়েছিল তার আগে মেইতেইরা ট্রাইবাল হিসেবেই গণ্য হতো এবং এখন ট্রাইবাল হিসেবে তাদের পরিচিতি ফিরিয়ে দিলে তারা তাদের সম্প্রদায়ের ভাষা শিল্প সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে পারবে।

কিন্তু বিভিন্ন ট্রাইবাল গোষ্ঠীদের সন্দেহ যে মেইতেইরা এভাবে সমস্ত রাজ্যের উপরে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে চাইছে। তারা মনে করছে যে মেতেইদের সিডিউল ট্রাইব হিসেবে পরিচিতি আসলে পার্বত্য এলাকার দরজা খোলার রাস্তা। ঠিক এই কারণের জন্যই বীরেন সিং সরকারের পার্বত্য এলাকার জঙ্গল থেকে বেআইনি দখলদারিদের হটানোর উদ্যোগটি বর্তমানের মেইতেই কুকি সংঘর্ষের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ তারিখে চোরাচাঁদপুরের কে সংজাং গ্রামের ট্রাইবাল বাসিন্দাদের গ্রাম থেকে হটিয়ে দেওয়া হয়। একই সাথে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পোস্ত গাছ নষ্ট করে দেওয়া হয়। এই ঘটনাটি ট্রাইবাল সমাজের কাছে কফিনের উপর শেষ পেরেক পোঁতার মত কাজ করে। এর আগে গত বছরের নভেম্বর মাসে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট একটি নোটিশ দিয়ে চূড়াচাঁদপুর-এর ডিস্ট্রিক্ট এর পার্বত্য এলাকার ৩৮ টি গ্রামকে ডিরিকগনাইজ করে। অর্থাৎ ওই গ্রামগুলির বাসিন্দাদের গ্রাম খালি করে চলে যেতে হবে। সরকারি যুক্তি ছিল যে ওই গ্রামগুলি চূড়াচাঁদপুর-খৌপাম সংরক্ষিত বন এলাকার মধ্যে পড়ে। মুখ্যমন্ত্রী বক্তব্য রাখেন, “মনিপুরের উনিশ শতাংশ এলাকা সংরক্ষিত জঙ্গল এবং আমরা ওই সংরক্ষিত জঙ্গলগুলি থেকে সমস্ত বেআইনি দখলদারদের উচ্ছেদ করব।” সরকারি বক্তব্যে এটাও বলা হলো যে পার্বত্য অঞ্চলের যেসব জায়গাতে এইসব বেআইনি দখলদাররা যে পোস্ত চাষ অথবা চোরা চালানোর রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছে সেটাও বন্ধ করা হবে।

কুকি নেতারা অভিযোগ করেন যে আইনানুগ বাসিন্দাদেরও এইসব গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে একই সাথে প্রচুর চার্চ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তার ওপরে যে নোটিশের বলে এইসব হচ্ছে অভিযান চলছিল সেই নোটিশও সংবিধানের ৩৭১-সি ধারা অনুসারে বেআইনি।

এর বদলা হিসেবে বিভিন্ন মেইতেই সংগঠনের তরফ থেকে বলা হয় যে বাংলাদেশ নেপাল মায়ানমার থেকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীরা কুকি-চীন-জোমি-মিজো সম্প্রদায়ের সাথে মিশে মনিপুর ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন করছে। যেখানে উপত্যকা এলাকার জনসংখ্যার বৃদ্ধি হার ২০১১ এর সেন্সাস অনুসারে ১৬% সেখানে পার্বত্য এলাকায় তা ৪০%। বিশেষ করে মায়ানমারের অনুপ্রবেশকারীদের জন্য পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চল আজ প্রস্থ চাষের মুক্তভূমি হয়ে উঠেছে।

দাবানলের পটভূমি তৈরিই ছিল, প্রয়োজন ছিল শুধু জ্বলন্ত একটি দেশলাই কাঠির। ১০ই মার্চ কাংপোকপাই শহরে সদ্য গঠিত ইন্ডিজেনাস ট্রাইবাল লিডার্স ফোরাম (আইটিএলএফ) উচ্ছেদের বিরুদ্ধে র‍্যালির আয়োজন করে। ঠিক তার পরের দিন সরকার তিনটি ট্রাইবাল জঙ্গি সংগঠনের থেকে সাসপেনশন অফ অপারেশনস চুক্তি প্রত্যাহার করে। সরকারের যুক্তি ছিল সে এই সংগঠনগুলি মায়ানমারের অনুপ্রবেশকারীদের পোস্ত চাষে উৎসাহ দিচ্ছে। আঠাশে এপ্রিল ইম্ফল থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে চূড়াচাঁদপুরে একটি জিমে একদল হিংস্র জনতা আক্রমণ করে। ঠিক তার পরের দিন মুখ্যমন্ত্রীর ওই জিমটি উদ্বোধন করার কথা ছিল। এরপরেই সংঘর্ষ আরও ছড়িয়ে পড়ে। ৩রা মে যা দাবানলের আকার নেয়।

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?

লেখক পরিচয় |

Start typing and press Enter to search