অঘোরী- প্রথম পর্ব
- অঘোরী- প্রথম পর্ব
- অঘোরী – দ্বিতীয় পর্ব
ঘটনাস্থল বারাণসীর কাছে । এক কুখ্যাত শ্মশান । এক অঘোরী, তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটিকে আবেগভরে চুম্বন করছে । সেই সম্পদটি আর কিছুই নয় । একটি খুলি । মানুষের । অঘোরীদের সাধনপথ তান্ত্রিক, কাপালিকদের মতোই । তাঁদের কাছে পৃথিবীর কোনও কিছুই অপবিত্র নয় । এই অঘোরীরা যে জীবনযাপন করে, সেটা হয়তো আমাদের কাছে খুব ‘অপবিত্র’ । কিন্তু সেটা তাঁরা করে থাকেন খুব সচেতনভাবেই । বস্তুজগতের কোনও কিছুর প্রতিই তাঁদের মায়া বা মোহ নেই । নিজেদের মলমূত্র তাঁরা যেমন খেতে পারেন, তেমনই পারেন শবদেহ থেকে মাংস খেয়ে নিতে । ভালো মন্দ-সব কিছুতেই তাঁরা ঈশ্বর দেখতে পান । অঘোরীরা আসলে শৈব । যাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেন কালী । কালীই শক্তির উত্স । হিন্দুদের কাছে মা কালী থেকে উত্সারিত এই শক্তি থেকেই বিশ্বের সব কিছুরই উত্পত্তি । আর শক্তির মধ্যে তো একযোগে মিলে থাকে ভালো আর মন্দ । মা কালী যেমন একাধারে সৃষ্টি এবং ধ্বংসের দেবী । এই শক্তিও তাই । একইসঙ্গে লালন আর বিনাশ, সদয় আর নির্মম । জীবন আর মৃত্যু-সবই তিনি ।
বিশ্বাস, রহস্যময় এই অঘোরী সন্তরা তাই অন্তরের শিবশক্তি জাগাতে কালীরই সাধনা করেন, তবে তাঁদের আরাধ্যা হলে শ্মশান কালী । এই কালীর বাম পা শিবের বুকে স্থাপিত । যেটা এক অর্থে মোক্ষলাভের বিকল্প পথের রূপক । এই বিকল্প পথ বড়ই কঠিন, অদ্ভূত, ভয়ঙ্কর, নির্মম কৃচ্ছসাধনের । কঠিন হলেও অঘোরীরা নির্বাণের জন্য এই পথটিই বেছে নিয়েছেন । প্রতিটি অঘোরীই তাঁর সাধনক্রিয়ার জন্য বেছে নেন গভীর রাত । অন্ধকার যখন চরাচর ঢেকে দেয়, প্রতিটি প্রাণী চলে যায় ঘুমের দেশে, তখন শুরু হয় তাঁদের সাধনা । এঁদের সাধনপীঠ হল শবদেহ । যার ওপর বসেই এঁদের ধ্যান শুরু হয় । সামনের জ্বলন্ত চিতা আর উড়তে থাকা ছাই প্রতিনিয়ত স্মরণ করিয়ে দেয় শেষ পর্যন্ত কোন গন্তব্যে পৌঁছতে চলেছে ।
কিন্তু শবদেহ ভক্ষণ বা মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গমের কি কোনও অর্থ আছে?
কোনও অঘোরীকে এই প্রশ্নটা করলে জবাব আসবে, জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিস্বাদের স্বাদ নেওয়া, প্রাণহীনতাকেই উপভোগ করা । বস্তুত, অঘোরীরা স্বাদের জন্য খাদ্য গ্রহণ করেন না, বা সুখের জন্য রতিক্রিয়া করেন না । আর সেই কারণেই যে-কোনও ধরনের খাবার, হতে পারে সেটা নিজের দেহের বা অন্য কারও বর্জ্য, তাঁরা ভক্ষণ করতে পারেন । এখানে খাবার উদ্দেশ্য একটাই, জীবনধারন । স্বাদ নেওয়া নয় ।
এই রহস্যময় অঘোরীদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অদম্য কৌতূহলের কারণে আমি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি । তবে, প্রকৃত অঘোরীর সঙ্গে দেখা করাটা মুখের কথা নয় । এঁরা জিপসির মতো এক শ্মশান থেকে অন্য শ্মশানে ঘুরে বেড়ান । সুতরাং তাঁদের কোনও পাকা ঠিকানা নেই । অঘোরীদের ক্রিয়াকর্মের জন্য অত্যন্ত গোপনীয়তা দরকার, তাই মানুষের আনাগোনা যেখানে খুবই কম, এমন কোনও শ্মশানে তাঁদের পাওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেশি ।