আফগানিস্তানের উত্তরপ্রান্তে আমু দরিয়া আর কোকচা নদীর সঙ্গমে, তাজিকিস্তান সীমান্তের কাছেই একটি গ্রাম- আই খানুম। ২৩০০ বছর পুরোনো এক ইন্দো-গ্রিক নগরীর ধ্বংসাবশেষ। আমু দরিয়া বেয়ে শ’খানেক কিলোমিটার নেমে গেলে তারমিজের বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ, কাছেই অনেকগুলো খনি। বাণিজ্যপথের উপর অবস্থিত না হলেও, আই খানুমের ভৌগোলিক অবস্থান ঈর্ষণীয়। সেই গ্রিক নগরীতে ছিল দুর্গ, ছিল টাঁকশাল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে শহরটা ছিল গ্রিক-ব্যাক্ট্রিয়ান রাজা আগাথোক্লেসের অধীনে। তাঁর অনেকগুলি মুদ্রা এখানে পাওয়া গেছে। তার মধ্যে আছে ছয়টি রৌপ্যমুদ্রা, এই মুদ্রাগুলিতে আছেন সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেব। মুখ্যপিঠে সঙ্কর্ষণ, তাঁর হাতে ডান হাতে গদা, বামহাতে লাঙল। গৌণপিঠে বাসুদেব, তাঁর ডানহাতে শঙ্খ, বামহাতে চক্র। আট স্পোকযুক্ত চাকা- অনেকটা বৌদ্ধদের ধর্মচক্রের মত, অথবা গ্রিক দেবী সাইবেল ও নাইকের সিংহচালিত রথের চাকার মত- এবং এই দেবী ও রথের একটি চিত্রণ ওই আই খানুমেই পাওয়া গেছে।

মুদ্রাগুলি ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। আগের পর্বে প্রায় সমসাময়িক বিভিন্ন শিলালিপিতে সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেবের নাম আমরা দেখেছি, তবে তাঁদের কোনো প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য সেখানে পাওয়া যায়নি। তাই এই মুদ্রাগুলিই সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেবের সবচেয়ে পুরোনো বা দ্বিতীয় প্রাচীনতম প্রাপ্ত প্রতিকৃতি। অন্যটি হল গোয়ালিয়রের নিকটবর্তী টিকলা গুহার দেয়ালচিত্র। তবে এই মুদ্রাগুলিতে তাঁদের নাম নেই। মুদ্রাগুলির মুখ্যপিঠে গ্রিক হরফে লেখা রাজার নাম- আগাথোক্লেস, আর লেখা “বাসিলেউস” অর্থাৎ রাজা। গৌণ পিঠেও রাজার নাম ব্রাহ্মী লিপিতে। মুদ্রায় সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেবের নাম লেখা নেই, তবে এদের হাতের আয়ুধগুলো থেকে স্পষ্ট এরা সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেব।

পরের নিদর্শনটির জন্য আমরা ফিরে যাব মধ্যভারতে, তবে এটিও গান্ধার অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত। পাঞ্জাবের তক্ষশিলার গ্রিক রাজা অ্যান্টিঅ্যালকিদাসের গ্রিক দূত ছিলেন হেলিওডোরাস। ১১৫ খৃষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ তিনি মধ্যপ্রদেশের বিদিশায় একটি গরুড়স্তম্ভ নির্মাণ করেন যেটি হেলিওডোরাস পিলার নামে পরিচিত।

হেলিওডোরাস পিলারের সামনের অংশ

পুরোনো মন্দিরের সামনে একটা ধ্বজাস্তম্ভ বা দীপস্তম্ভ বা গরুড়স্তম্ভ থাকে সাধারণত। এই স্তম্ভের সামনে একটা মন্দির ছিল বলে অনুমেয়, ইঁটের বা কাঠের মন্দির- তাই এর অবশেষ আর নেই। ভাগবত হেলিওডোরাস এটি নির্মাণ করান বাসুদেবকে নিবেদন করে। এতে ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা সংস্কৃত ঘেঁষা প্রাকৃতে বাসুদেবের বন্দনা করা হয়েছে। আমি বিষ্ণু বা কৃষ্ণ না বলে বাসুদেব বলছি কারণ এই নামটিই এই স্তম্ভে লিখিত আছে। বৈষ্ণব না বলে ভাগবত বলছি কারণ হেলিওডোরাস নিজেকে ভাগবত বলেছেন।

বুদ্ধেরও আট স্পোকযুক্ত চাকা, বাসুদেবেরও। বুদ্ধের পদ্ম পরে বিষ্ণুর হয়েছে যা আমরা পরের পর্বগুলোয় দেখব। তবে বুদ্ধের সিংহস্তম্ভ হত, বিষ্ণুর গরুড়স্তম্ভ। সিংহ ও গরুড়- দুইএর নিচেই উল্টোনো পদ্ম থাকত (ছবিতে পাবেন)। বুদ্ধের মতো না হলেও, বাসুদেবের জনপ্রিয়তা যে ব্যাক্ট্রিয়ার ইন্দো গ্ৰীক রাজ্যে ভালমতই ছিল তার প্রমাণ এই হেলিওডোরাস পিলার আর ঐ মুদ্রাগুলো।

আই খানুমের Agathocles-এর সংকর্ষণ বাসুদেব মুদ্রা

এই স্তম্ভের আশেপাশে রাখা শিলার মধ্যে, যেগুলো সম্ভবতঃ আশপাশের থেকে খুঁড়েই পাওয়া গেছে, আছে চাঁদ, সূর্য, অগ্নিস্তম্ভের দৃশ্য। ছবি দিলাম।

প্রাকৃত লেখটির কিয়দংশ তুলে ধরছি। রোমান হরফ থেকে লেখা, তাই ত্রুটি মার্জনা করবেন।

“দেবদেবস বাসুদেবস গরুড়ধ্বজ অয়ম
করিতো ইঅ হেলিওদোরেন ভাগবতেন
দিয়স পুত্রেন তক্ষশীলকেন
যোনদতেন অগতেন মহারাজস…”

এই খাম্বাটির স্থানীয় নাম খাম্বাবা। এই নামেই লোকে দীর্ঘদিন একে চিনত।

বিদিশায় আমাদের আবার ফিরতে হবে তবে কয়েক পর্ব পরে। বৈষ্ণব ধর্মের আলোচনায় বিদিশার প্রসঙ্গ বারবার আসে। প্রাচীনতম বড়মাপের হিন্দু তথা বৈষ্ণব মন্দিরশিল্পও এই বিদিশাতেই।

তথ্যসূত্র:

উইকি এবং হেলিওডোরাস পিলারের সামনের সাইনবোর্ড

Series Navigation<< বিষ্ণুর উৎস সন্ধানে- প্রথম পর্ববিষ্ণুর উৎস সন্ধানে- তৃতীয় পর্ব >>

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?