আধুনিক হিন্দু দেবমণ্ডলীতে সবচেয়ে পুরোনো পাথুরে প্রমাণ অর্থাৎ পাথরে খোদাই করা নাম আছে যার তিনি হলেন বাসুদেব। বর্তমানে তাঁকে আমরা কৃষ্ণ নামেই বেশি অভিহিত করি। আধুনিক হিন্দু ধর্মের প্রধান সাহিত্যগুলি (মহাভারত, গীতা এবং রামায়ণ) যেহেতু কৃষ্ণ ও বিষ্ণুকে ঘিরেই এবং লোকসাহিত্যেও কৃষ্ণের জনপ্রিয়তা অনস্বীকার্য তাই বৈষ্ণব ধর্মকে হিন্দু ধর্মের মুখ্য ধারা বললে ভুল হয়না। বৈদিক ও বৌদ্ধ ধর্মের স্তর পেরিয়ে যখন ভারতে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উত্থান হচ্ছে সেই সময়টার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত বাসুদেব ও বিষ্ণুর উত্থান। এই যুগসন্ধিক্ষণকালকে বোঝার জন্য বিশেষ ভাবে সহায়ক হল বাসুদেবের সবচেয়ে পুরোনো পাথুরে প্রমাণগুলো।

১) ঘোসুণ্ডি-হাথিবাড়া শিলালিপি: রাজস্থানের চিতোরের নিকটস্থ ঘোসুণ্ডি ও নগরী এই দুটি গ্ৰামে এই শিলালিপি পাওয়া যায় তিন ভাগে বিভক্ত অবস্থায়। এটি দ্বিতীয় থেকে প্রথম খৃষ্টপূর্ব শতকের শিলালেখ। এতে সংকর্ষণ (বলরাম), বাসুদেব দুজনেরই নাম আছে, আর নারায়ণবাটিকা কথাটিও আছে। “পূজাশিলাপ্রাকারো নারায়ণবাটিকা” কথাটা একটা নারায়ণ মন্দিরেরই ইঙ্গিত দেয়, যেখানে আধুনিক মন্দিরের মতো প্রাকার ছিল। পূজাশিলাপ্রাকার বিষয়টা দুভাবে দেখা যায়। এক হল, পূজার জন্য তৈরি শিলানির্মিত প্রাকার। আবার পূজাশিলাকে ঘিরে তৈরি প্রাকার- এভাবেও ভাবা যায়। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রথম অর্থটা ধরেছেন, ভাণ্ডারকর এবং জে সি ঘোষ দ্বিতীয়টা।

কেমন হত এই পূজাশিলা? এই মন্দিরের পূজাশিলা তো অবশিষ্ট নেই, কিন্তু কিছু অনুমান করা যায়। এখন উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের বাইরে বটগাছের নিচে গোল করে অনেক শিলা রাখা থাকে। এক থেকে তিন ফুট উচ্চতার, যাতে ঈশ্বরের রূপ বা নাগ খোদিত থাকে। এরকম শিলা হওয়া সম্ভব। দুই-তিন শতাব্দী পরে রাজস্থানের নগর গ্ৰামে বা মথুরার নিকটবর্তী সোঙ্খে মহিষমর্দিনীর যে ফলকগুলি পাওয়া গেছে সেরকম হতে পারে, যদিও এগুলো শিলা নয়, পোড়ামাটির তৈরী।

আবার শিবলিঙ্গ, গয়ার বিষ্ণুপদশিলা, বা শালগ্ৰামশিলার মতো বিমূর্ত শিলাও হওয়া সম্ভব। জে সি ঘোষের মতে এটি শালগ্ৰামশিলা, তবে সেযুগে এর প্রচলন ছিল কিনা স্পষ্ট জানা নেই।

ঘোসুণ্ডি-হাথিবাড়া শিলালিপিতে আছে রাজা সর্বতাতের অশ্বমেধ যজ্ঞর কথা। লেখাটা থেকে অনুমান করা যায় তিনি পিতৃক্রমে গজ বা গাজায়ন গোত্রের এবং তাঁর মা পারাশর গোত্রের। তাঁকে গাজায়ন এবং পারাশরীপুত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে। গজ+ষ্ণায়ন প্রত্যয় যোগ করে গাজায়ন হয়েছে আমার ধারণা, যেমন দক্ষ থেকে দাক্ষায়ণ। পরাশর থেকে পারাশরী।

ব্রাহ্মী লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা পুরো কবিতাটি এরকম ছিল:

“(ভাগ)বতেন গাজায়নেন পারাশরীপুত্রেন
সর্বতাতেন অশ্বমেধযাজিনা।
ভগব(দ্)ভ্যাম্ সংকর্ষণ-বাসুদেবভ্যাম্
অনিহতাভ্যাম্ সর্বেশ্বরাভ্যাম্
পূজাশিলাপ্রাকারো নারায়ণবাটিকা।।”

বন্ধনীর অংশগুলো অনুমিত। পাঠভেদে নারায়ণবাটক। তিনটে আলাদা আলাদা শিলালেখ যোগ করে লেখাটিকে দাঁড় করানো হয়েছে।

সেই যুগে বাসুদেবের উপাসকরা নিজেদেরকে ভাগবত বলত, যার আরেকটা উদাহরণ আমরা পরের পর্বে দেখব। বৈষ্ণবের থেকে ভাগবত নামটারই চল বেশি ছিল। বৈষ্ণব নামটা ভাগবতের তুলনায় অর্বাচীন। এখানে রাজা নিজেকে ভাগবত বলেছেন।

কবিতাটির বাংলা অনুবাদ দিচ্ছি:

অশ্বমেধযজ্ঞকারী ভাগবত গাজায়ন পারাশরীপুত্র সর্বতাত দ্বারা (নির্মিত হয়েছে) নারায়ণবাটিকা (নামক) পূজাশিলাপ্রাকার, ভগবান সংকর্ষণ-বাসুদেব এই দুই অনিহত সর্বেশ্বরদের জন্য।

বিষ্ণু, নারায়ণ আর বাসুদেব অতীতে স্বতন্ত্র ছিলেন। তৈত্তীরীয় আরণ্যক -১০/১১তে এদের প্রথম একীভূত হতে দেখা যায়। আবার নারায়ণ আর বাসুদেবের একীকরণের প্রথম পাথুরে প্রমাণ মেলে এই ঘোসুণ্ডি-হাথিবাড়ার শিলালিপিতে। এই লিপির আরেকটা বড় তাৎপর্য হল- এটি সংস্কৃতে লেখা প্রাচীনতম শিলালিপি বলে ধারণা করা হয়। এর চেয়ে পুরোনো যা কিছু আছে, মূলতঃ অশোকের শিলালেখ আর কিছু সাতবাহনদের, সেগুলো সবই প্রাকৃত।

২) নানাঘাট: গোদাবরী আর কৃষ্ণা। পশ্চিমঘাটে এদের শুরু, বঙ্গোপসাগরে এদের সমাপ্তি। এই দুটি নদীর উৎসমুখ থেকে মোহনা অবধি পুরো অঞ্চল জুড়ে একসময়ে রাজত্ব করেছিল সাতবাহন রাজবংশ, প্রায় চার শতাব্দী জুড়ে। সাতবাহন সাম্রাজ্যের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে ছিল সোপারা, চাউল, কল্যাণ ও ভারুচের মত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর। আর দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে ছিল কৃষ্ণা গোদাবরীর বদ্বীপ যাকে দাক্ষিণাত্যের শস্যভাণ্ড বলা হয়। পুরো সাম্রাজ্য জুড়েই ছিল বাণিজ্যপথ। যে সে বাণিজ্য নয়, সাতবাহন বাণিজ্যিক রপ্তানির ক্রেতা ছিল রোমানরা। বৃহত্তর রোমান বাণিজ্যপথ যা শুরু হত দূর ভূমধ্যসাগর থেকে সেই পথের উপরেই ছিল সাতবাহন রাজ্যের বন্দরগুলো।

কৃষ্ণা গোদাবরীর নিম্ন অববাহিকার সমতল অংশে পাওয়া গেছে অমরাবতী আর নাগার্জুনকোণ্ডার মত বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহার, এদের উৎসমুখে ছিল‌ নানাঘাট গিরিবর্ত্মের উপর নানাঘাট বৈষ্ণব গুহা, যেটি এই বাণিজ্যপথের যাত্রীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল ছিল। আবার বাণিজ্যপথের একদম পশ্চিমে আরব সাগরের উপর আছে কানহেরি বৌদ্ধ গুহা আর সোপারার বৌদ্ধ বিহারের অবশেষ।

বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও সাতবাহনরা মূলতঃ ব্রাহ্মণ্যধর্মী ছিলেন। নানাঘাট বা নানেঘাট গুহার শিলালেখগুলি তৈরি করিয়েছিলেন সাতবাহন রাজা সাতকর্ণীর বিধবা পত্নী নয়নিকা। সেখানেই আমরা বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবীর প্রাচীনতম কিছু খোদিত নামোল্লেখের দেখা পাই- ধর্ম, ইন্দ্র, সংকর্ষণ, বাসুদেব, এবং চারজন লোকপাল যাদের নাম বলা হয়েছে- যম, বরুণ, কুবের, বাসব। সংকর্ষণ-বাসুদেবকে চন্দ্রসূত বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

এই শিলালেখতে আমরা সেযুগের যজ্ঞের দান-দক্ষিণার পরিমাণ, বিধবা রানির ব্রহ্মচর্যপালন ও মাসব্যাপী উপবাসব্রতপালনের বিবরণ দেখি। মুদ্রার একক হিসেবে কার্ষাপণ ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাকৃত ভাষা ও ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা দ্বিতীয় খৃষ্টপূর্বশতকের এই শিলালেখগুলি হিন্দু ধর্মের প্রাচীনতম পাথরে লেখা ও টিকে থাকা নথিগুলির একটি।

নানাঘাট ও ঘোসুণ্ডির চেয়ে পুরোনো বাসুদেবের লিখিত পাথুরে প্রমাণ নেই কেন? কারণ ভারতে শিলালিপির ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করে অশোকের সময়ে, তাই তার আগে শিলালেখ পাওয়া মুশকিল। মুদ্রায় লিপির ব্যবহার আর দেবদেবীদের উপস্থিতি ইন্দোগ্ৰীকদের আগে আসেনি।

“মানুষ” বুদ্ধর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য ব্রাহ্মণ্যধর্মেও প্রয়োজন হয়েছিল একজন দেবোত্তীর্ণ মানবচরিত্রের- এবং বাসুদেব সেটাই হয়ে উঠলেন।

পরের পর্বে আমরা বাসুদেবের সন্ধানে যাব আফগানিস্তান।

তথ্যসূত্র:

১. ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, আনন্দ (২০১৩), পৃঃ ১৩০-১৩৩

২. Report On The Elura Cave Temples And The Brahmanical And Jaina Caves In Western India, by Burgess, page 59-63

৩. Epigraphia Indica, Vol XXII 1933-34, (1938), Page 202-204

(চলবে)

Series Navigationবিষ্ণুর উৎস সন্ধানে- দ্বিতীয় পর্ব >>

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?