ধরুন আপনি স্নান করতে গিয়েছেন, বালতির জল অর্ধেক ঢালতে না ঢালতেই আপনার ঘরে মােবাইল ফোনটি বেজে উঠল। আধভেজা হয়ে ছুটতে ছুটতে এসে দেখলেন কেউ আপনাকে ফোন করেনি। মনের ভুল ভেবে গােটা ঘটনাটাকে এড়িয়ে গেলেন প্রথমদিন। কিন্তু আবার ঠিক দু’দিন পর হয়তাে গাড়ি চালাচ্ছেন, মৃদু ভলিউমে এফএম চলছে, হঠাৎ মনে হল বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তাে? আর তক্ষুনি ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে দেখলেন কোনও কল আসেনি। ভেবে কূলকিনারা করা গেল না যে, ফোনের রিংটোন কিংবা ভাইব্রেশন স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারলেও কোনও ফোন এল না কেন? ব্যাপারটা কি কৌতুক? নাকি ভৌতিক?


চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই মিথ্যে অনুভূতির নাম ‘ফ্যান্টম ভাইব্রেশন সিনড্রোম। এটাকে ঠিক সিনড্রোম বলবার আগে, জেনে রাখা ভালাে যে, এক ধরনের অর্জিত হালুসিনেশন, যার মূলে রয়েছে আমাদের একমাত্র ডিজিটাল পােষ্য স্মার্টফোন, অ্যাংজাইটি এবং মানসিক অবসাদ। অধিকাংশ সময়ে আমরা কাজের সূত্রে কিংবা অবসরে সােশ্যাল মিডিয়ায় বহুক্ষণ কানেক্টেড থাকি। গত ৫-৬ বছরে মােবাইল ফোনের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। কখনও কখনও এমনও দেখা যায় যে, প্রিয় মানুষের রিংটোন, বাকি রিংটোনের থেকে আলাদা রেখেছেন পকেটের ভিতর থেকেই বুঝে ফেলার জন্য। কোনও আর্জেন্ট খবর বা পার্সেল ডেলিভারি আসার জন্যে সকাল থেকে ঘড়ি ধরে অপেক্ষা করছেন। ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে আপনি ফোন হাতছাড়া করে রান্নাঘরে গেলেন, কিংবা স্নানে গেলেন। আর সেই মুহূর্তে আপনার অবচেতন মন সচেতন হয়ে গেল এই ভেবে যে আপনার এক্ষুনি একটা ফোন আসতে পারে। আর এই অপেক্ষা এবং অ্যাংজাইটিই আমাদের ব্রেনের সংবেদনশীল অংশগুলােকে উত্তেজিত করে তােলে। যার ফলস্বরূপ আশপাশের অজস্র অডিটরি ফ্রিকোয়েন্সির মধ্যে থেকে নিজেদের মােবাইলের আওয়াজ আলাদা করতে পারি না আমরা।

১০০০ থেকে ৬০০০ হার্জের ফ্রিকোয়েন্সি হল মানুষের কাছে সবথেকে বেশি সংবেদনশীল অডিটরি ফ্রিকোয়েন্সি। আর বেশিরভাগ মােবাইলের রিংটোনের ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাঙ্ক সেই একই সীমার মধ্যে অবস্থান করে। তাই মানুষের ব্রেনে অনেক আওয়াজের ভিড়ে মিশে থাকা একই কম্পাঙ্ক পৌঁছলে ব্রেন পার্থক্য বুঝতে পারে না যে, এটি আসলে কোথা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। আর ঠিক তখনই স্পষ্ট নিজের ফোনের রিংটোন বা ভাইব্রেশন আমাদের কানে বেজে ওঠে বা অনুভূত হয়। অনেক সময় এই সিনড্রোমটিকে হাইপােভাইবােকন্ড্রিয়া এবং রিং-জাইটিও বলা হয়ে থাকে।

ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার মার্কেট, দোকান থেকে বাজার, খাবার থেকে খবর, মনােরঞ্জন কিংবা টাকা উপার্জন, রাশিফল থেকে ব্যবসা বাণিজ্য, এত কিছু সামলাতে স্মার্টফোনই অস্ত্র। কোনও গুরুত্বপূর্ণ নােটিফিকেশন কিংবা সােশ্যাল রেসপন্সের অপেক্ষায় নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে বারংবার ফোন দেখা। মিনিটে মিনিটে ফোন বের করে খুঁটিনাটি চেক করা। ফোনের ব্যাটারি সবসময় ১০০% চার্জ করে রাখার প্রবণতা অজান্তেই আমাদের ব্রেনের স্বাভাবিক ফাংশনকে ডিজিট্যালি মডিফাই করে ফেলছে। বারংবার একই জিনিস ঘাঁটা কিংবা চেক করার সঙ্গে অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের খানিকটা মিল পাওয়া যায়, যেটা কিনা বার বার সাবান দিয়ে হাত ধােয়া, কিছুক্ষণ পর পর মানিব্যাগ চেক করে টাকা গুনে রাখার সঙ্গে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ডিজিটাল টেকনােলজির উপর নির্ভরশীল হওয়ার পর থেকে, মানুষের স্বাভাবিক ব্রেনের ফাংশান অনেকাংশে উন্নত এবং অভিযােজিত হচ্ছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত টেক- নির্ভরশীলতা নিয়ে আসছে এক বা একাধিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এই উপসর্গের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানাের একমাত্র রাস্তা হল ঠিক যতটুকু দরকার, ততটুকু স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করা।বই-নিউজ পেপার ইত্যাদি পড়া, ডিজিটাল আড্ডার থেকে বেরিয়ে এসে চিরাচরিত প্রথায় হেলদি আড্ডায় নিজেদেরকে শামিল করা। তাহলেই অদ্ভুত উপসর্গগুলি অনেকটা কমে আসতে দেখা যাবে।

মােবাইল থেকে দূরে থাকা বা মােবাইল বিহীন হয়ে পড়ার ভয়ানক ভয়কে বলা হয় নমােফোবিয়া’। তাই মােবাইলের থেকে নিতান্তই দুরে না থাকতে পারলে অপ্রয়ােজনীয় সমস্ত অ্যাপ্লিকেশন ডিলিট করে এবং সােশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে বেশি ইনভলভ করা থেকে বিরত থাকা। তার পরিবর্তে বাড়িতে ফুলগাছ লাগানাে, লােকাল লাইব্রেরিতে যাওয়া, ডেলি রুটিনে এক্সারসাইজ এবং টুকিটাকি সৃজনশীল কাজের অভ্যাস তৈরি করলে মানসিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু যদি মানসিক অবসাদের কারণে বার বার মােবাইল ফোনের প্রতি অনিয়ন্ত্রিত আকর্ষণ থাকে, তার ফলেও অনেক সময় ফোনের আওয়াজ, মেসেজের শব্দ ইত্যাদি বেজে উঠছে বলে মনে হতে থাকে, সেক্ষেত্রে সমস্ত ঘটনাটি সময় নিয়ে বােঝার চেষ্টা করতে হবে। যদিও এই সিনড্রোমের কোনও নিরাময় কিংবা চিকিৎসা নেই, তবে অভিজ্ঞ মনােবিদের পরামর্শ নিয়ে এই সমস্যার পদ্ধতিগত সমাধান সম্ভব।

পুনঃপ্রকাশিত

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?