বহুবার ভাবিয়াছি এই ‘না’ শব্দটি লইয়া। ক্ষুদ্র কিন্তু ধারে এবং ভারে বহু বৃহৎ শব্দকে নাকানিচোবানি খাওয়াইতে পারে ‘না’। পাঠক নিশ্চয়ই দেখিয়াছেন, অনুভব করিয়াছেন এই একটি ক্ষুদ্র শব্দবন্ধের ক্ষমতা। বস্তুতপক্ষে ‘না’ শব্দটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাঙ্গে। কখনও মন, কখনও সম্পর্ক, কখনও জীবিকা আবার কখনও ভবিষ্যৎ – ‘না’ সর্বদা ভাঙ্গিতেছে। কিন্তু সম্প্রতি ‘না’ শব্দটি তাহার নঞর্থক অর্থের প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া এক অন্য অর্থে প্রতিভাত হইতেছে।

সোমা দাস

অতিসম্প্রতি এই ‘না’ শব্দটি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা শ্রীমতী সোমা দাসের কণ্ঠনিঃসৃত হইয়াছে। দিন তিনেক আগেও পশ্চিমবঙ্গবাসী এই নামটির সহিত পরিচিত ছিল না। থাকার কথাও নহে। প্রান্তিক মানুষদের কথা কয়জনই বা মনে রাখিতেছেন? কয়জনই বা ধর্মতলার গান্ধীমূর্তির তলদেশের শিক্ষক চাকুরি প্রার্থীদের বিক্ষোভের দিকে নজর করিতেছেন ? মুখ বা নামের সন্ধান তো দূরস্থান! বীরভূমের নলহাটির পাইকপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের আশ্রমপাড়া গ্রামের কন্যা সোমা। বাংলাতে স্নাতক। ২০১৬ তে স্কুল সার্ভিস কমিশন আয়োজিত ৯ম – ১০ম শ্রেণীর জন্য শিক্ষক নির্বাচনের পরীক্ষায় বহু লক্ষ পরিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগীতায় তিনি সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হইয়া এম্প্যানেলড হন। অর্থাৎ চাকুরির নিয়োগপত্র শুধুমাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু কথায় বলে চা এবং ঠোঁটের ভিতরের ব্যবধানটি দুস্তর। ঘটনাচক্রে ২০১৬ সালে SSC-তে ব্যাপক দূর্নীতির ফলে এমন অনেককে চাকুরি দেওয়া হইয়াছিল যাহারা পাশ তো দূরের কথা পরিক্ষাতেও বসেন নাই। সুতরাং প্রকৃত যোগ্যরা নকল যোগ্যদের বিরুদ্ধে মামলা করিলেন। এবং জটিলতায় শ্রীমতী দাসের চাকুরিটি মোকদ্দমার চোরাবালুতে তলাইবার উপক্রম হইল। বহু ঘাত প্রতিঘাতের শেষে এ সংক্রান্ত বিবিধ মামলা বর্তমানে কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে বিচারাধীন। শ্রী গঙ্গোপধ্যায় এই সুবিশাল দূর্নীতির বটবৃক্ষটিকে মূল সমেত ঝাঁকাইতেছেন।

পাঠক নিশ্চয়ই ভাবিতেছেন এতদুর পর্যন্ত গল্পে তো কোনো চমক নাই। আরো বেশ কয়েক সহস্র শিক্ষিত বেকার চাকুরিপ্রার্থীদের সহিত সোমা দাসের পার্থক্য কি? ২০১৬ সাল হইতে গঙ্গা দিয়া বহু জল প্রবাহিত হইয়াছে। শ্রীমতী সোমা দাসের জীবনেও দুর্ভাগ্যের কালো ছায়া প্রলম্বিত হইয়াছে। ২০১৯ সালে তাহার শরীরে দুরারোগ্য ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। চাকুরিহীন পিতা, চাকুরিপ্রার্থী ভ্রাতা, নিম্নবিত্ত পরিবারের আর্থিক সংকট, লকডাউন, সর্বোপরি চাকুরীর পরীক্ষায় এম্পানেলড হইয়াও চাকরি না পাওয়ার যন্ত্রণার ওপরে ইহা এক শাকের আঁটির বিষম বোঝা চাপিল। শ্রীমতী দাস ততদিনে ২০১৬ র বঞ্চিত চাকুরিপ্রার্থীদের ধর্না মঞ্চে পরিচিত মুখ। এর ভেতরেই মুম্বাই গমন, বারোটি কেমো এবং ফিরিয়া আসিয়া পুনরায় ধর্না মঞ্চে। পাঠক নিশ্চয়ই এক্ষণে একটি যারপরনাই জেদি চরিত্রের সন্ধান পাইতেছেন। কিন্তু ইহাতে আমাদের আলোচনার ‘না’ কোথায়?

বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মাননীয় শ্রী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয় শ্রীমতী সোমা দাসের দূরারোগ্যব্যাধি সত্ত্বেও ধর্নামঞ্চের উপস্থিতির খবরটি পাওয়ার পরে তাহাকে নিজের এজলাসে ডাকিয়া পাঠাইয়া ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত শ্রীমতী দাসের কোন একটি চাকুরির মাধ্যমে মাথা উঁচু করিয়া বাঁচিবার ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া। এবং যেহেতু শিক্ষা দপ্তরের চাকুরী সংক্রান্ত বহু মামলা আদালতে বিচারাধীন তাই শ্রীমতী দাসের চাকুরিটি শিক্ষা দপ্তর ছাড়া অন্য কোন দপ্তরে হইবে। পাঠক ভাবিয়া দেখুন প্রস্তাবটি শুধু লোভনীয় তাহাই নহে, দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত একটি মানুষের কাছে ভবিষ্যতে টিকিয়া থাকিবার চাবিটিও হইতে পারিত। কিন্তু সোমা দাস বিনীতভাবে না বলিয়াছেন। তিনি ইহাও বলিয়াছেন যে চাকুরীটি নিলে হয়তো তাঁহার জীবনে অনেক ভালো কিছু ঘটিত কিন্তু শিক্ষক হইবার স্বপ্নটি পূরণ হইতো না, তিনি সব হারাইয়াছেন স্বপ্নটি হারাতে চাহেন না। তদুপরি হকের লড়াইটি যে সাথীদের লইয়া লড়িতেছেন তাহাদের ত্যাগ করা তাহার পক্ষে সম্ভব নহে। শিক্ষকের চাকুরীটি হইলে সবারই হইবে। বিচারপতি বিস্মিত হইয়াছেন। এবং একই সাথে এই জেদি মেয়েটির তারিফ করিয়াছেন। বলিয়াছেন আদালত তাহাকে স্মরণে রাখিবে।

শ্রীমতী দাসের এই ‘না’-টি এক কথায় অশ্রুতপূর্ব। স্বার্থপরতা, অর্থগৃধ্নুতা এবং ধান্দাবাজির এই পঙ্কিল সমাজে শ্রীমতি সোমা দাসের এই ‘না’-টি একটি পাহাড়প্রমাণ ‘হ্যাঁ’, চতুর্দিকের এই অমানুষদের ভিড়ে ‘মান’ এবং ‘হুঁশ’ সম্পন্ন মানুষের অস্তিত্বের। অবিশ্বাসের ভিড়ে বিশ্বাসের অস্তিত্বেরও।

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?