চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলছি আপনি জীবন সরকারকে চেনেন না। আজ্ঞে না, আমিও চিনতাম না তাঁকে। আজকে হঠাৎ একটা পুরনো খবরের কাগজের ভাঁজে জীবনবাবুকে খুঁজে পেলাম। পঞ্চাশের কোঠায় দাঁড়িয়ে আজও খবরের কাগজে আমার প্রথম পছন্দ চট্টো-বন্দ্যোর রসালো কেচ্ছা অথবা গা গরম করা দেশ বাঁচানো খেলা। সুতরাং আমার জীবনে জীবনবাবুর আসার কথা ছিল না। তবু জীবন সরকার এলেন। (না মশাইরা, আপনাদেরও আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকানো উচিৎ নয়। চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলতে পারি আপনার পছন্দটাও এই আমারই মতন। আসলে চামড়ার নিচে আমরা সবাই একই ছাঁচের যে! নাঃ, এই ঘন ঘন চ্যালেঞ্জ নেওয়াটা কোন কাজের কথা নয়। আমি আবার বয়সে হাফ সেঞ্চুরি পেরোতে চললেও এখনো লটারিতে ১০ টাকার গন্ডিও পেরোতে পারিনি।)

তো এবার আবার জীবনবাবুতে ফেরা যাক। 

জীবনবাবু মানে জীবন সরকার। শহরতলি নৈহাটির বুকে একটা ছোট্ট খাবার দোকান চালান (নাকি চালাতেন বলব?) তিনি। ২০১৮র ১৩ই ডিসেম্বর রাতের দিকে দিদির বাড়ি যাওয়ার জন্য স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলেন জীবনবাবু। সে সময় দুটি মেয়ে লাইন পার হচ্ছিল। এবং আরো অসংখ্য বারের মতন এবারেও তাদের কানে গোঁজা ছিল হেডফোন। দূরের কারোর সাথে ধারাবিবরণীতে ব্যস্ত মেয়েদুটির নজরে ছিল না, দুরন্ত গতিতে আপ লাইন দিয়ে ছুটে আসা ধনধান্য এক্সপ্রেস। হিসেব অনুসারে দুটি মেয়েরই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ফেলার কথা ছিল। কিন্তু সিনেমায় যেমন হয় ঠিক তেমনভাবেই কেউ একজন মুহূর্তের ভগ্নাংশে দুটি মেয়েকেই ধাক্কা মেরে লাইন থেকে সরায়। তারপর লোকজনের জয়ধ্বনী করার মুহূর্তে দেখা যায় নায়ক পড়ে আছেন দূরে। অখ্যাত জীবন সরকার, ট্রেনের ধাক্কায় রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত এবং জ্ঞানহীন। জীবনটা তো সিনেমা নয়, তাই সুপারম্যান জীবনবাবু মেয়েদুটিকে বাঁচালেও নিজেকে ট্রেনের ধাক্কা থেকে বাঁচাতে পারেননি। প্রাণ ছিল শরীরে। এবং প্রাণ ছিল প্ল্যাটফর্মে থাকা সরকারি ছাপ মারা আম আদমি গুলোর মধ্যেও। অতএব ধুকপুকে প্রাণঅলা জীবনবাবু চালান হলেন সরকারি হাসপাতালে। দেখা গেল শরীরের ওপরে প্রাণের টান যথেষ্টই রয়ে গেছে। তাই জীবনবাবু জীবিত রইলেন। পরিজনেরা হাসপাতাল থেকে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন তাঁকে, একটু ভাল চিকিৎসার আশায়। চিকিৎসা হল। এবং বিল এল ৩৯ লক্ষ টাকা। সমূহ সম্ভাবনা ছিল ট্রেনের ধাক্কায় না হলেও, বিলের ধাক্কায় জীবনবাবুর জীবন বেরোনোর। এবং আমাদের আম আদমির জীবননক্সা অনুসারে তাই হওয়া উচিৎ ছিল। পরিজনেরা ৮ লক্ষের জোগাড় করলেন। জীবনবাবুর পাড়ার লোক এবং স্থানীয় কাউন্সিলরের উদ্যোগে খোলা হল ব্যাংক আকাউন্ট। কিছু দিনের মধ্যে জমা হল ১৮ লক্ষের বেশি টাকা। তারপরেও বাকি ১০ লক্ষের বেশি টাকা। প্রচলিত ধারার উল্টো পথে হেঁটে সে টাকা মুকুব করল বেসরকারি হাসপাতাল। বাড়ি ফিরলেন জীবন সরকার। জীবিত অবস্থাতেই। ডান চোখ, ডান হাত এবং ডান পায়ের কর্মক্ষমতা প্রায় হারিয়ে।

বলাই বাহুল্য এই এতটা কিসসার ভেতরে এই আমি মানুষটার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন অংশগ্রহণই নেই। বরং ঘটনাটা জানার পরেও আপনার মতই নৈহাটি স্টেশন সংলগ্ন কোন জায়গায় জীবনবাবুকে জীবিত রাখার জন্য কূপনঅলাদের দেখলে চোখ খুলে উদাসীন থাকার আপ্রাণ চেষ্টা আমিও করব। কিন্তু একটা জায়গায় একটু ঠেকে যাচ্ছি, বুঝলেন মশাইরা! জীবনবাবু হঠাৎ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কান্ডটা ঘটালেন কেন? কেনই বা পাড়ার লোকগুলো বা ওই আমআদমিরা কমবেশি ১৮ লাখ টাকা তাঁর জন্য তুলে দিল? তাঁদের কেউ তো সমাজসেবীর উপাধি পান নি। ঘন্টা খানেক সংগে কাউকে নিয়ে তো তারা চর্চায় থাকেন নি। ভোটে জিতে সর্বোত্তম মানুষও তো তারা কেউ হননি। তবে কেন? নাঃ, হিসেবটা ঠিক মিলছে না।

অনুরোধ থাকল আপনাদের কাছে, কেউ যদি হিসেবটা একটু মিলিয়ে দিতেন… 

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?