মরুদ্যানের ফিসফিস
স্কুলের পথে বাসে বসে আছি, আমার পছন্দের একদম পিছনের সিটে। হঠাৎ হিংসে হল ভীষণ, পাশে তখন ভালোবাসার ঝড় উঠেছে…
—হাতটা ধরে রেখে মরেচু ক্যানে!
—ক্যানে আবার, জানুনু কি! বাসটা থামতে তর নাই অমনি ত বিঁড়ি খেতে ছুটবি।
—ত? খাবার জিনিস খাব, আমি কি বিষ খাচ্চি য্যা অমন করে ধরে রেখেচু?
—বিঁড়ি খাবি ত এখেনে খা, তার লেগে ফাঁককে যেতে হবে ক্যানে?
—হ্যাঁ, এখেনে বিঁড়ি খাই আর ভদ্দরলোকেরা সব গাল দেক আর কি!! বাসের ভিতরে বিঁড়ি খেতে নাই জানুনু? ছাড়, ছাড় দিখি…
—না ছাড়বনি৷ বিঁড়ি খাবি যতইচ্ছা খা, বিঁড়ি খেতে যেয়ে যে লটারির টিকিট কাটবি সেইটা কি আমি জানিনি ভেবেচু লায়?
—বাব্বা গৌ! ক্ষেপির বুদ্দি দ্যাখ গৌ!! সারাদিন রাত কি এমন করে ধরে রাখবি নাকি?
ভদ্রলোকের চোখেমুখে কপট রাগের ছোঁয়া, ভদ্রমহিলার মুখে মুচকি হাসি। বাস চলছে নিজের গতিতে। আমি অসভ্য, কান খাড়া করে শুনছি মরুদ্যানের ফিসফিস।
—এত বড় য্যা পুজা গেল, একটা লোতন কাপড় কিনেও ত দিলিনি। সব টাকাগুলান যদি লটারির পঁদেই ঢুকি দিলি, মাগের কাপড় কিনার পয়সা কুথা পাবি!
—বুড়ি হয়ে মত্তে যাচ্চু, এই বয়সে লোতন কাপড় পরে কি করবি?
—হ্যাঁ, সেই ত! এগবারে শশ্মানের ঘাটে উঠলে দিবি। জ্যান্ত মানুষটাকে লোতন কাপড় পরিয়ে কি করবি, আমি মল্লে মড়াটাকে লোতন কাপড় পরিয়ে পুড়াবি।
—বাবা! তুই মরবি? তুই এত তাড়াতাড়ি মরবি!! থালে ত আমার হাড় জুড়াত। তুই এখন মরবিনি রে, যমে এত তাড়াতাড়ি তোখে লিবেনি।
ভদ্রলোক উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন, ভদ্রমহিলা প্রচন্ড রাগে অভিমানে বাসের জানালা পেরিয়ে বাইরে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের ক্ষেতে চোখ রেখেছেন। সামনের গেটের হেল্পার দরজার গায়ে দড়াম করে থাপ্পড় মেরে চিৎকার করে উঠলো, ‘এই জন্তিফুর জন্তিফুর জন্তিফুর…’। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার গায়ে হেলান দিলে ভদ্রমহিলা কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকে সরানোর চেষ্টা করলেন। ভদ্রলোক জোর করে গা ঘেঁসে বসলেন,
—তর দুটা ব্যাটার বউগুলানকে য্যা লোতন কাপড় কিনে দিনুম তার ব্যালা? তোরই ত নিজের ব্যাটার বউ নাকি!
—ধুর মড়া, সরে বস দিখি!! ব্যাটা বউ সবই ত আমার, তোর ত কিছুই লয়। আমি নিজে নিজেই ত ব্যাটা বিইচি, ব্যাটাদের বিয়া দিইচি। তোর ত ব্যাটা লয়।
ভদ্রমহিলার দৃষ্টি এখনও জানালার ওপারে। ইতিমধ্যে অনেকবার চেষ্টা করেছেন ভদ্রলোকের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর, কিন্তু খানিক আগে নিজে থেকে ছেড়ে দিতে চাওয়া হাত এখন সজোরে আটকে রয়েছে।
কিছু ভালোবাসা এমনই হয়। দীর্ঘদিন সম্পর্কে থাকার সময় মনে হয় এই বাঁধনে না বাঁধা হলেই বোধ হয় ভালো হত। আসলে প্রত্যেক আমির তো নিজস্ব একটা আমি থাকে, যখন দুটো মানুষ একসাথে অনেকটা সময় এক নৌকায় পার হয়, অনেক সময় এই নিজস্ব আমিটাকে সরিয়ে দিতে হয়, হয়ত নিজের আমি সত্তাটাকে মেরে ফেলতেও হয়। তবু কখনও কেমন কোন একটা আমি মাথা চাড়া দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিলেই প্রবলেম। সমস্যা শুরু হয় যখন সেই আমি নিজের ব্যক্তিগত পরিসর খুঁজে বেড়ায়। তারপর দুটো আমি আলাদা হয়, নদীর স্রোত কখনও বাড়ে কখনও কমে, অনেকগুলো ঘাট পার হয়ে গোধুলি আসে। নিভে যাওয়া আলোয় হঠাৎ পুরানো দুটো আমি মুখোমুখি হলে???
বাসটা হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো, সামনে পিছনে চিৎকার ‘হে ক্ষিরপাই ক্ষিরপাই ক্ষিরপাই। গাড়ি পাঁচমিনিট দাঁড়াবে।’
ভদ্রমহিলার মুঠো অনেক আগেই আলগা হয়ে গিয়েছিল, খুব সহজেই নিজের আঙুলগুলো মুক্ত করে ভদ্রলোক নেমে গেলেন বাস থেকে। কিছুক্ষন পর ফিরেও এলেন, ডানহাতের দুটো আঙুলের মাঝে জলন্ত বিঁড়ি, ধোঁয়া ভর্তি মুখ। লটারির টিকিটগুলো বুকপকেটে সন্তর্পনে রেখে একটা কাগজের ঠোঙা তুলে দিলেন ভদ্রমহিলার হাতে। ভদ্রমহিলা অন্যমনস্ক ভাবে সিঙ্গাড়ায় কামড় দিলেন, ভদ্রলোক চিন্তিত মুখে সেই দিকে তাকিয়ে,
—ঠান্ডা হয়ে গ্যাছে লয়?
ভদ্রমহিলা অন্যমনস্ক ভাবেই সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। ভদ্রলোক আরেকমুখ ধোঁয়া ছেড়ে রেগে গেলেন,
—***র ছেলেটাকে বললুম, গরম থাগলে দিবি নালে দিবিনি। শালা পয়সা #ড় পেতে রজগার করি লায় যে দাম নাই??
ড্রাইভার উঠে বসতেই বাসটা নড়ে উঠলো, বন্ধ হল দুটো দরজা। ভদ্রমহিলা সিঙ্গাড়া খেতে খেতে ঠোঙার ভেতর থেকে আরেকটা সিঙ্গাড়া বের করে ভদ্রলোককে দিলেন। ভদ্রলোক বিঁড়ি ফেলে সিঙ্গাড়ায় মনোনিবেশ করলেন। ইঞ্জিন স্টার্ট করে বাসটা এগিয়ে চলল। কখন যে পাঁচটা আঙুলে আরও পাঁচটা আঙুল জড়িয়ে গেছে, খেয়ালই করিনি…
শুধুমাত্র নামকরণ ব্যতিত অপরিবর্তিত