হিন্দু আগম সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শনগুলি আছে বৈষ্ণব পরম্পরায়। আগম সাহিত্য হল তন্ত্রের ভিত্তি, অনেক সময় তন্ত্র আর আগমকে সমার্থক ধরা হয়। বৈষ্ণব আগমগুলির মধ্যে প্রাচীনতম হল বৈখানস ও পাঞ্চরাত্র আগম।‌‌ এদের মধ্যে সাহিত্য হিসেবে বৈখানসের আবির্ভাব তুলনামূলক ভাবে আগে হলেও, ধর্মীয় পরম্পরা হিসেবে পাঞ্চরাত্রই প্রাচীনতর। তৈত্তিরীয় সংহিতা ও শতপথ ব্রাহ্মণে পাঞ্চরাত্র পরম্পরার উল্লেখ পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, দ্বিতীয় শতাব্দীতে এই পরম্পরার রীতিমতো পাথুরে প্রমাণ পাওয়া যায় মথুরার একটি মূর্তিতে। তার বিশদে যাবার আগে পাঞ্চরাত্র সম্পর্কে আরেকটু বিশদে জানা যাক।

আগেই বলেছি বিষ্ণু, নারায়ণ ও বাসুদেব অতীতে স্বতন্ত্র ছিলেন এবং তৈত্তীরীয় আরণ্যকের সময়ে তাদের একীকরণ শুরু হয়। পাঞ্চরাত্র পরম্পরা ছিল ঋষি নারায়ণের পাঁচ রাত্রিব্যাপী যজ্ঞ থেকে উদ্ভূত, পরে তা বাসুদেব ও বিষ্ণুর সঙ্গেও যুক্ত হয়। সাধারণভাবে বৈখানস পরম্পরায় বিষ্ণুর গুরুত্ব বেশি আর পাঞ্চরাত্রে বাসুদেবের।

পাঞ্চরাত্রে পাঁচের নানারকম ব্যবহার, তবে পাঁচ রাত্রিব্যাপী যজ্ঞ বলেই একে পাঞ্চরাত্র বলা হত। পাঞ্চরাত্রে উপাস্য দেবতাকে পাঁচটি রূপে উপাসনা করা যায়- পর, ব্যূহ, বিভব, অন্তর্যামী ও অর্চা‌।

১) পর হল পরমসত্তা যাতে সবকিছু লীন হয়, যিনি পর্যায়ক্রমে সকল কিছুর স্রষ্টা এবং আদি কারণ। পর আর বাসুদেব সমার্থক এবং পরকে পরবাসুদেবও বলা হয়।

২) ব্যূহ তিনটি- সংকর্ষণ, প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ। তিনজন বৃষ্ণিবীরের নামে তিনটি ব্যূহ। প্রকৃতি থেকে পঞ্চভূতের জন্ম হয় ব্যূহদের মাধ্যমে। নিচের সমীকরণগুলো ব্যূহের ভূমিকা বুঝতে সাহায্য করে।

প্রকৃতি+ সংকর্ষণ= মন,

মন+ প্রদ্যুম্ন= অহংকার,

অহংকার+অনিরুদ্ধ= পঞ্চভূত,

অর্থাৎ তিনটি ব্যূহ তিনটি সৃষ্টিক্রিয়ায় অনুঘটকের মতো কাজ করছে। লক্ষণীয় যে প্রকৃতি ও ব্যূহ তিনটি হল এখানে মৌলিক বস্তু। মন বলতে বোঝায় বুদ্ধি, আর এই বুদ্ধি থেকেই আসে অহংকার অর্থাৎ অহম্ বা নিজের সম্পর্কে বোধ, আর সেই বোধ থেকেই পঞ্চভূতকে মানুষ অনুভব করে। কিন্তু এই ব্যূহগুলির জন্ম হয় কীভাবে? ছয়টি গুণ থেকে। এই ছয়টি গুণকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়-

– স্থিতির দ্যোতক গুণ অর্থাৎ জ্ঞান, ঐশ্বর্য ও শক্তি

– গতির দ্যোতক গুণ অর্থাৎ বল, বীর্য ও তেজ

সংকর্ষণ জন্মায় জ্ঞান ও বল থেকে।

প্রদ্যুম্ন জন্মায় ঐশ্বর্য ও বীর্য থেকে।

অনিরুদ্ধ জন্মায় শক্তি ও তেজস থেকে।

সবমিলিয়ে ব্যূহবাদ সাংখ্য দর্শনের বিবর্তনমূলক চতুর্বিংশতি তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত। পাঞ্চরাত্র আগম সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত, এবং এরা পরবর্তী কালের তন্ত্রচর্চার ভিত্তি।

আমরা তিনটি ব্যূহের কথা বললেও বাসুদেবকে যোগ করে অনেক সময় চতুর্ব্যূহ ধরা হয়। বাসুদেব থেকেই প্রকৃতি এবং অন্য তিনটি ব্যূহের জন্ম। পাঁচজন বৃষ্ণি বীরের মধ্যে শাম্ব বাদ গেছে ব্যূহ থেকে।

এবার আমরা মথুরার ঐ মূর্তিটির আলোচনা করব যেটা দ্বিতীয় শতাব্দীতে পাঞ্চরাত্র বিশেষ করে ব্যূহবাদের অস্তিত্বের পাথুরে প্রমাণ দেয়। মথুরায় দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রাপ্ত একটি কুষাণযুগের মূর্তিতে চতুর্ব্যূহের ধারণা দেখা যায়। কেন্দ্রে বাসুদেব, পিঠে কদম্ব গাছ ও তার তিনটি শাখা। ডানদিকের শাখায় সংকর্ষণ, উপরের শাখায় প্রদ্যুম্ন। বামদিকের শাখায় অনিরুদ্ধ, তবে এটি ভেঙে গেছে। সংকর্ষণকে স্পষ্ট চেনা যায় হাতের সুরাপাত্র ও পিঠের নাগ দেখে। সংকর্ষণের নাগ নিয়ে এই লেখকের একটি লেখা এই গ্ৰুপেই আছে। পিঠের কদম্ব গাছটিতে কদম ফুলও দেখা যায়। আমার ব্যক্তিগত মত- ভারতে পাথর ও পোড়ামাটির মূর্তির চল হবার আগে কাঠ বা সরাসরি গাছ খোদাই করে মূর্তি বানানো হত, আর তার কিছু ছায়া রয়ে গেছে পাথর-পোড়ামাটির যুগেও। সেখান থেকেই শালভঞ্জিকা, সেখান থেকেই এই কদম্ববৃক্ষের চতুর্ব্যূহ। বুদ্ধ-সুজাতার কাহিনীতেও এরকম বৃক্ষদেবতার উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে সুজাতার দাসী বৃক্ষদেবতা আর গাছের নিচে তপস্যারত শীর্ণজীর্ণ বুদ্ধকে এক করে ফেলেছিলেন।

পাঞ্চরাত্র সাহিত্যের যা কিছু এখন আছে প্রায় সবই একাদশ শতাব্দীর পরের। কিন্তু কুষাণযুগের এই মূর্তিতে ব্যূহবাদের অস্তিত্ব থেকে বোঝা যায় মূল পাঞ্চরাত্র সাহিত্য কতখানি পুরোনো।

আরও পরে, অষ্টম শতক থেকে এই চতুর্ব্যূহকে বৈকুণ্ঠ চতু্মূর্তি রূপে বেশি দেখা যায়। এই রূপে একটি মূর্তির চারটি মস্তক চারদিকে তাকিয়ে। চারটি মস্তকের একটি হল মানুষ (বাসুদেব), ডান বা দক্ষিণ দিকের মস্তক হল সিংহ (সংকর্ষণ), পিছন বা পশ্চিম দিকে রাক্ষসতুল্য মস্তক (প্রদ্যুম্ন), বাম বা উত্তর দিকের মুখটি হল বরাহ (অনিরুদ্ধ)। এই রূপটি অবশ্য গুপ্তযুগের একটি মূর্তিরূপ থেকে অনুপ্রাণিত।‌‌ পঞ্চম শতাব্দীর মথুরার বেশ কিছু মূর্তিতে দেখা যায় ঐ রূপটাই, তবে পিছনের রাক্ষসের মুখটি বাদে। দুদিকে বরাহ ও নৃসিংহ, আর মাঝে বাসুদেব কিংবা বিষ্ণু। কেন্দ্রের মুখটি যদি বিষ্ণু হয় তবে এটি বিশ্বরূপ। আর সেটি যদি বাসুদেব হয়, তবে এটি বৈকুণ্ঠ চতু্মূর্তি। দুটি মূর্তিরূপে একটা সাধারণ সূত্র আছে- মানুষের মুখের দুদিকে নৃসিংহ ও বরাহ।

ছবির বৈকুণ্ঠ চতু্মূর্তি হল কাশ্মীরের- নবম শতাব্দীর।

মনে রাখতে হবে চতুর্ব্যূহের নাম বৃষ্ণিবীরদের নামে হলেও এর সঙ্গে মানুষ বৃষ্ণিবীরদের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যূহগুলি ধারণা মাত্র। নারায়ণ এবং বাসুদেবের একীকরণের ফলে এই নামকরণগুলি হয়ে থাকতে পারে। নারায়ণের পাঞ্চরাত্র আর বাসুদেবের বৃষ্ণিবীরদের কাহিনী একসাথে জুড়ে যাবার ফলে ব্যূহগুলির নামকরণ বৃষ্ণিবীরদের নামে হবার সম্ভাবনা থাকে।

৩) বিভব: এই রূপের সঙ্গে আমরা বহুপরিচিত। এটি বাসুদেবের অবতাররূপ।‌‌ বিভব মানে বিশেষরূপে আবির্ভাব। লক্ষণীয় যে বৈকুণ্ঠ চতু্মূর্তির সিংহ ও বরাহ পরবর্তীকালে অবতাররূপ পেয়েছে। আমরা দশাবতারের সঙ্গে বেশি পরিচিত হলেও, বিভিন্ন সময়ে কুড়িরও বেশি অবতার বিভিন্ন তালিকায় দেখা যায়।

৪) অন্তর্যামী: এটি পরবাসুদেবের প্রসারিত রূপ, যা মানুষের ভিতরে প্রবেশ করেছে।

৫) অর্চা: অর্চনার বস্তু বা মূর্তি। আগের বিভিন্ন পর্বে বর্ণিত শিলাগুলিও অর্চা।

মহাভারতের শান্তিপর্বে বৈশম্পায়ন ও জনমেজয়ের কথোপকথনে পাঁচটি জ্ঞান বা ধর্মমতের উল্লেখ পাওয়া যায় – সাংখ্য, যোগ, পাঞ্চরাত্র, বেদ এবং পাশুপত (মহা-১২/৩৪৯/৬৪)। অমরসিংহ (গুপ্তযুগ) ও কুমারিলভট্ট (অষ্টম শতক)- এদের লেখা এবং আরো পরবর্তীকালের সূতসংহিতা থেকে বোঝা যায় পাঞ্চরাত্র এবং পাশুপত (পশুপতি শিবের উপাসনা) – এই দুটি প্রান্তিক মানুষের ধর্ম ছিল, এবং পতিত ব্রাহ্মণরাই এদের জন্য পৌরোহিত্য করত। এখানে একটা প্যারাডক্স আমরা দেখি। ঘোসুণ্ডিতে চক্রবর্তী রাজা বা নানঘাটে সাতবাহন সম্রাটরা বাসুদেবের উপাসক, কিংবা মথুরায় মহাক্ষত্রপরা পঞ্চ বৃষ্ণিবীরের উপাসক। গুপ্তসম্রাটরা বিষ্ণুর উপাসক। তাহলে পাঞ্চরাত্র কীকরে পতিত ধর্ম হয়? উত্তর হিসেবে অনুমেয় যে, পাঞ্চরাত্রের বাইরেও বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপ্তি ছিল, শাখা ছিল। বৈষ্ণব আগমের মধ্যে অন্ততঃ দুটি ভাগ ছিল আমরা দেখেছি – বৈখানস ও পাঞ্চরাত্র।

বেদের থেকে স্বতন্ত্র হলেও পাঞ্চরাত্র পরম্পরা বেদবিরোধী নয়। বৌদ্ধ, জৈন, আজীবক বা চার্বাক দর্শনের মধ্যে যে নিরীশ্বরবাদ, সন্দেহবাদ ও যজ্ঞবিরোধিতা দেখা যায় তা পাঞ্চরাত্র ধর্মে ছিল না। বরং বাসুদেবকে প্রায় একেশ্বর ধরে নিয়েই পাঞ্চরাত্রের বিকাশ হয়েছে। যজ্ঞবিরোধিতার প্রশ্ন ওঠে না, কারণ পাঁচ রাত্রিব্যাপী যজ্ঞ থেকেই এর জন্ম। আধুনিক হিন্দুধর্ম যেমন সম্পূর্ণ বৈদিক নয়, আবার বেদবিরোধীও নয়, পাঞ্চরাত্রও তাইই। আধুনিক হিন্দুধর্মের ভিত্তিপ্রস্তর অনেকটাই পাঞ্চরাত্রের মাধ্যমে স্থাপিত হয়েছিল। এটি বৈদিক এবং বেদপরবর্তী হিন্দুধর্মের দুটি গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্রের একটি। অন্যটি ছিল পাশুপত ধর্ম।

শিলালিপির বাসুদেব, দ্বিমাত্রিক চিত্রে বাসুদেব ও ত্রিমাত্রিক মূর্তির বাসুদেব – সবারই আদিরূপ আমরা এই চার পর্বে দেখেছি – কিন্তু সবই ছিল বাসুদেব। বিষ্ণুর খোঁজ আমরা এখনও পাইনি। বিষ্ণুর প্রাচীনতম মূর্তি খুঁজতে আমরা পরের পর্বে যাব ছত্তিশগড়।

তথ্যসূত্র:

– ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট- নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

– Elements of Hindu Iconography Vol. 2 – Part – 1 by T.A. Gopinatha Rao [page 7]

– Vrishnis in Ancient Literature and Art, Vinay Kumar Gupta.

Series Navigation<< বিষ্ণুর উৎস সন্ধানে- তৃতীয় পর্ব

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?