সৃষ্টিশীলতার মৃত্যু
ঈশ্বর স্বততই সৃষ্টিশীল। তাঁহার সৃষ্টিশীলতার লাখো উদাহরণে পৃথিবী পরিপূর্ণ। তাঁহার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকর্ম হইল মনুষ্যজাতি। ঈশ্বরের অংশ রহিয়াছে মনুষ্যের মধ্যে। এবং যথারীতি ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে সৃষ্টিশক্তি মনুষ্যেরও একটি বৈশিষ্ট্য। বস্তুতপক্ষে এই সৃষ্টিশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে শিশু বয়স হইতেই। ঘুড়ি ওড়ানোর ন্যায় তুচ্ছাতিতুচ্ছ খেলাও শিশুর সৃষ্টিশক্তির ‘শোকেস’ বিশেষ। কখন ঘুড়ি উড়াইতে হইবে, কোন বিশেষ কৌণিক টান অপর একটি ঘুড়িকে কাটিতে সক্ষম, কতটা মাঞ্জা দিলে ঘুড়ি হাল্কা থাকিবে অথচ লক্ষ্যে অবিচল থাকিয়া অন্য ঘুড়িকে বশ করিতে পারিবে -এ সবই শিশুর জানা। ইহার জন্য তাহাকে কোন বিজ্ঞান বইএর সাহায্যও লইতে হয় না, অথবা কোন শিক্ষকের বাড়ির চাটাই এর অংশও হইতে হয় না। যে বিশেষ জ্ঞানে সেই শিশু অজান্তেই অ্যারোডাইনামিক্স এর প্রাথমিক জ্ঞানটি লাভ করে তাহার নাম পণ্ডিতেরা দিয়াছেন ট্রায়াল এন্ড এরর মেথড, আমাদের সহজ ভাষায় ‘ঠেকিয়া শেখা’। প্রখ্যাত দার্শনিক রুশো শিখাইবার এই মাধ্যমটির একজন বড় সমঝদার ছিলেন।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাটি এই ঠেকিয়া শিখিবার বিষয়টি হইতে অনেক দূরে অবস্থান করিতেছে। একটি বিষয়ে অনেক কিছু জানিবার পূর্বে বুঝিয়া লওয়া প্রয়োজন। এক্ষণে ঠেকিয়া শিখা অন্যান্য সব কিছুর তুলনায় ভাল কেন? কোন কিছু শিখিবার পিছনে সব থেকে জরুরি জিনিসটির নাম প্রয়োজন। উহা না থাকিলে শিক্ষক যতই চেষ্টা করুন না কেন, student টি শিখিবে না। Flogging a dead Horse এর ন্যায় প্রচেষ্টাটি শুরুতেই শেষ হইবে। পক্ষান্তরে কেন শিখিব বিষয়টির একটি পরিস্কার হেস্তনেস্ত হইলেই শিক্ষা একটি জরুরি জিনিস হইয়া ওঠে, শুধুমাত্র পিতামাতার নিকট নহে, একজন ছাত্র বা ছাত্রীর নিকটেও। ইহার পরে সমস্যা সমাধানের necessity যুক্ত হইলেই-ষোলকলা পূর্ণ হইবে। ছাত্র আপনমনেই শিখিয়া লইবে। এই সময়টিই সৃষ্টিশীলতার বিকাশের শ্রেষ্ঠ সময়।
আদি অনন্তকাল হইতেই শিশু সৃষ্টি করিতেছে, কখনও তাহার কল্পনার জগতে আবার কখনও বাস্তবে। সাদা কাগজের কিম্ভুত রংচং-এ ছবি, তাহার বাক্সের কোনে রাখা রঙীন পাথর অথবা ভাঙা মার্বেল হয়ত বড়দের-চোখে নির্ভেজাল আবর্জনা কিন্তু নিষ্পাপ সেই ক্ষুদে মালিকটির কাছে সেই আবর্জনাই হয়ত কোন সৃষ্টি কর্মের প্রাথমিক স্তর।
পড়াশোনার সময়েও দেখা যায় সৃষ্টিশীল উত্তর বা লেখা প্রায় সময়েই শিক্ষক বা পিতামাতার নিকট গ্রহণযোগ্য হইতেছে না। ‘থোড় বড়ি খাড়া’ বা ‘খাড়া বড়ি থোড়ের’ ন্যায় নোটবুক নির্ভর বা কোন শিক্ষকের বাঁধা নোট এর উত্তরটিই তাহাকে মুখস্থ করিতে বাধ্য করা হইতেছে। ইহার ফল একটিই, কচি মনটি তাহার সৃষ্টিশীলতাকে বর্জন করিয়া পরীক্ষার হলের নম্বরের পিছনে দৌড়াইতেছে। ইনকুইজিটিভ মনটির নিয়ত মৃত্যু ঘটিতেছে। ইহাতে কেবল শিশুটির নহে, রাষ্ট্রেরও চরম ক্ষতি হইতেছে।
এই সমস্যার আশু সমাধানের প্রয়োজন। শিক্ষা ব্যবস্থার নম্বর কেন্দ্রিক ভাবধারাটিকে ঝাঁটাইয়া বিদায় দেওয়ার প্রয়োজন। নতুবা সৃষ্টিশীলতাকে খুন করিবার দায় হইতে সমাজের এবং উহার মাথাদের মুক্তি হইবে না।







