শিশুকালে পঠিত সেই ‘সুবোধ’ বালক ভূবন এবং তাহার মাসির কথা কি পাঠকের স্মরনে আছে? ভূবন মোটেই সুবোধ ছিল না, সে যখন মৃত্যুদন্ডের সম্মুখীন তখন সে মাসিকে শেষবারের ন্যায় দর্শনেচ্ছা প্রকাশ করে। মাসি আসিবামাত্র তাহার কর্ণে একটি বিশাল কামড় দেয় এবং ঘোষনা করে যে এই কামড় আসলে মাসির জন্য শাস্তি, কারন শিশুকালে মাসি তাহাকে আদর দিয়া বাঁদর করিয়াছেন, তাহার কোন অপরাধেরই শাস্তি দেন নাই এবং তাহাকে নিজের ভুল সংশোধন পূর্বক দোষমুক্ত হইবারও কোন সুযোগ দেন নাই। মোটের ওপর নিজের দূর্ভাগ্যের হেতু হিসেবে ভূবন নিজের মাসিকেই ঠাওরাইয়াছিল।

উপরোক্ত ঘটনাটি ‘ভালবাসা অতি বিষম বস্তু’ -র একটি উদাহরন মাত্র। উদাহরণটি অতি চলিত। বস্তুতপক্ষে বর্তমানে গৃহে এবং বাহিরে এই অতি প্রেম-এরই রমরমা। শিশু তাহার ‘আবদারটি’র ঘোষনা করিবামাত্রই পিতামাতা সহ সমস্ত আত্মীয়েরাই তাহা মিটাইতে সচেষ্ট হন। তাহারা ভুলিয়া যান যে আবদারটির ঘোষনা নহে, জরুরি হইল সেই আবদারটির দাবিরূপে প্রতিষ্ঠা। কাঠামোই হউক অথবা দাবি, প্রতিষ্ঠা না পাইলে টিকে না, সামান্য কম্পন অথবা ধাক্কাতেই পতিত হয়। ‘আবদার’ -এর দাবিরূপে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তি একটি দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি। এই রূপান্তরে দাবিদারের ন্যায়বুদ্ধি এবং বিবেচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ন্যায়বুদ্ধি এবং বিবেচনার চালুনিতে ‘আবদার’ তাহার বালখিল্যভাব হইতে মুক্ত হইয়া একটি পরিনত, যুক্তিগ্রাহ্য দাবিতে রূপান্তরিত হয়। অর্বাচীন দাবি এবং তাহার মান্যতা একটি অন্যায়ের জন্ম দেয়। ইহা একটি ধ্রুব সত্য।

সমাজে অন্যায় বাড়িতেছে । অধিকাংশক্ষেত্রেই অন্যায়কারী অন্যায় করিতেছে বুক ফুলাইয়া । সে যে অন্যায় করিতেছে সে বিষয়ে তাহার লজ্জাবোধ তো নাইই উপরন্তু এই অন্যায়ের ফলে তাহার যে দন্ড হইতে পারে সে বিষয়েও সে অকুতোভয়। সে নিশ্চিত থাকে শক্তিশালী পিতা অথবা কোন মাতুল বরাবরের ন্যায় এবারেও তাহার আব্দার মিটাইবে অর্থাৎ তাহাকে নিরাপদে আব্দার উপভোগ করাইবার সুবন্দোবস্ত করিবে।

অন্যায়কারীদের প্রতি প্রশাসন এবং ন্যায়ালয় পক্ষপাতীত্ব করেন – এমৎ বক্তব্য বলিয়া আমজনতা প্রায়শই চায়ের পেয়ালায় সাইক্লোন তুলিতেছেন। কিন্তু আতসকাচের তলায় রাখিয়া দেখিলে দৃশ্যমান হইবে অন্যায়কারীর অভিভাবকেরা, যাহারা আবদার মানিয়া লইয়াছেন, মানিতেছেন এবং মানিবেন। বস্তুতপক্ষে নিজের লোকটির প্রতি এই পক্ষপাতিত্ব, তোষণ এবং ধৃতরাষ্ট্রসুলভ অন্ধত্ব সমাজকে অস্থির করিতেছে। ফল – হাথরস হইতে হাঁসখালি ছুঁইয়া আরও অসংখ্য জায়গায় দগদগে ঘায়ের মতন ভরিয়া উঠিতেছে।

দুষ্ট বালক ভূবনের কাহিনীর স্রষ্টা বলিয়াছিলেন অন্যায় যে করে এবং অন্যায় যে সহে দুইজনকেই ঈশ্বরের ঘৃণার দুঃসহ অগ্নিতে পুড়িতে হয়। ইহা শাশ্বত সত্য। অতএব অভিভাবকেরা জাগিয়া উঠুন। সন্তানকে তাহার আবদারটিকে দাবিরূপে প্রতিষ্ঠা করিতে দিন । সমাজকে একটি সুস্থ নাগরিক উপহার দিন। নচেৎ আপন কর্ণের ওপর প্রিয়জনের কামড় শুধু সময়ের অপেক্ষা হইবে।

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?