যাদবদের বিভিন্ন কুলের একটি ছিল বৃষ্ণি। এই বৃষ্ণি কুলেই জন্মেছিলেন বাসুদেব, সংকর্ষণ সহ পাঁচ বীর। এদের একত্রে বলা হয় বৃষ্ণি পঞ্চবীর। বাকি তিনজন হলেন – প্রদ্যুম্ন (বাসুদেব ও রুক্মিণীর পুত্র), শাম্ব (বাসুদেব ও জাম্ববতীর পুত্র), অনিরুদ্ধ (প্রদ্যুম্নর পুত্র)। প্রথম শতাব্দীর শক মহাক্ষত্রপ রাজুবুলার দ্বারা স্থাপিত মোরা কূপের শিলালিপিতে দেখা যায় এদের উল্লেখ “ভগবতাম্ বৃষ্ণিনাম্ পঞ্চবীরানাম্ প্রতিমা শৈলদেবগৃহে”। এটি মথুরার নিকটস্থ। এখানে অবশ্য পাঁচজনের নাম নেই। লক্ষণীয় যে ঘোসুণ্ডি শিলালেখর মতো এখানেও একটি পাথরের মন্দিরের কথা আছে- “শৈলদেবগৃহ”। এখানে তাঁদের প্রতিমাও ছিল। আর কী ছিল এই মন্দিরে? “অর্চদেশম্ শৈলম্ পঞ্চম্” অর্থাৎ অর্চনা করার জন্য পাঁচরকমের শিলানির্মিত বস্তু। এগুলি কিন্তু প্রতিমা নয়। সম্ভবতঃ ঘোসুণ্ডি শিলালেখতে বর্ণিত “পূজাশিলা”র মতো কোনো বস্তু। শালগ্ৰামশিলাও হতে পারে। পাঁচজন বৃষ্ণিবীরের জন্য পাঁচটি শিলা। ঘোসুণ্ডি আর মোরা থেকে প্রাপ্ত প্রমাণ এক করলে বোঝা যায় প্রতিমার পাশাপাশি শিলাও ব্যবহার করা হত বৃষ্ণিবীরেদের পূজায়। তখনও বৈষ্ণব ধর্ম নাম হয়নি, ভাগবতধর্ম বলেই পরিচিত। তবু ঐ শিলা-উপাসনার মধ্যে আধুনিক বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে একটা মিল পাওয়া যায়।

কারা ছিল এই বৃষ্ণিবীরেরা? মহাভারতের চরিত্র। তবে তাদের আরও গভীর ইতিহাস আছে- শতপথ ব্রাহ্মণ ৩.১.১.৪ এ “বার্ষ্ণ্য” দেবতাদের যজনের উল্লেখ আছে, অর্থাৎ বৃষ্ণি কুলের মানুষ বা দেবতাদের উপাসনা সেই সময় থেকেই হত। শতপথ ব্রাহ্মণ সপ্তম থেকে তৃতীয় খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীর রচনা। শতপথ ব্রাহ্মণেই ১.১.১.১০এ বর্কু বার্ষ্ণ বলে একটি চরিত্র দেখা যায়। বৃষ্ণির সঙ্গে অপত্যার্থে ষ্ণ, ষ্ণ্য এবং ষ্ণেয় প্রত্যয় যোগ করে বার্ষ্ণ, বার্ষ্ণ্য, বার্ষ্ণেয়।

এছাড়া তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, বৃহদারণ্যক উপনিষদ, জৈমিনীয় উপনিষদ ব্রাহ্মণেও বৃষ্ণি জাতির উল্লেখ আছে। বৃষ্ণিবীরেরা নিজ মহিমাতেই পূজিত হতেন। এঁরা বীরত্বের প্রতীক হিসেবে উপাস্য। ঘোসুণ্ডির চক্রবর্তী রাজা, সাতবাহন সম্রাটপত্নী, আফগানিস্তানের গ্ৰিক রাজা, মথুরার শক মহাক্ষত্রপ- সবাই এদের উপাসনা করেন। তাজিকিস্তান সীমান্ত থেকে অন্ধ্র অবধি তাঁদের উপাসনা ব্যাপ্ত ছিল।

গীতায় দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণ সম্বোধিত হচ্ছেন বার্ষ্ণেয় নামে। বার্ষ্ণেয় মানে বৃষ্ণিকুলজাত (বৃষ্ণি + ষ্ণেয় প্রত্যয়)। এখনও উত্তর ভারতে আগ্ৰা-মথুরা অঞ্চলে অনেক বৈশ্য কাস্টের সাব-কাস্ট বা পদবী হয় বার্ষ্ণেয়। তবে তাদের সঙ্গে বৃষ্ণিকুলের যোগাযোগের কোনো প্রমাণ নেই।

মথুরাতেই আরেকটি কূপের মধ্যে আরেকটি শিলালিপি পাওয়া গেছে যাকে বসু শিলালিপি বলা হয়। এটিতে শক মহাক্ষত্রপ রাজুবুলার পুত্র সোদাসের নাম পাওয়া যায়। এটিও প্রথম শতাব্দীর। এটিতে “ভগবতো বাসুদেবো মহাস্থান শৈলম তোরণম বেদিকা” লেখা আছে। অর্থাৎ একটি বাসুদেবের মন্দির যেখানে পাথরের তোরণ ছিল। মোরা আর বসু শিলালিপি দুটি থেকে বোঝা যায় আজ থেকে দু হাজার বছর আগেও মথুরাতে বাসুদেবের একাধিক মন্দিরের উপস্থিতি ছিল। আরেকটা জিনিস বোঝা যায় যে ইন্দো গ্ৰিকদের মতো শকরাও বাসুদেবের পরম ভক্ত ছিল। বিভিন্ন বিদেশি জাতির মধ্যে ভাগবত ধর্মের এই জনপ্রিয়তা খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয়। আবার এই জাতিগুলির মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মও জনপ্রিয় ছিল। কঙ্কালী টিলার শিলালেখ থেকে বোঝা যায় সোদাস জৈনধর্মকেও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন।

টিকলা গুহাচিত্র

বাসুদেব ও বৃষ্ণিদের অনেকগুলো লেখ্য প্রমাণ আমরা পেলাম – ঘোসুণ্ডি-হাথিবাড়া, নানাঘাট, হেলিওডোরাস, মোরা, বসু। এবার আমরা মূর্তিরূপের খোঁজ করব। এদের সবচেয়ে পুরোনো প্রতিকৃতিগুলো দ্বিমাত্রিক। এই ব্যাপারে তিনটি ভালো উদাহরণ হল-

এক, গোয়ালিয়রের কাছেই টিকলা গুহাচিত্র যেখানে বাসুদেব ও সংকর্ষণের পাশে একানংশাকেও দেখা যায়। একানংশাই পরবর্তীকালের সুভদ্রা। এটি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতাব্দীর। দুজন পুরুষের হাতে চক্র, গদা আর লাঙল। একানংশার হাতে ছত্র।

দুই, আফগানিস্তানের গ্ৰিক রাজা আগাথোক্লিসের মুদ্রা যা আগের পর্বে আলোচিত- খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর।

তিন, পাকিস্তানের গিলগিট বাল্তিস্তানের চিলাস প্রস্তরচিত্র। এটি প্রথম শতাব্দীর। এখানে বৌদ্ধ প্রস্তরচিত্রই বেশি। আগেরগুলোয় ছবির সঙ্গে নাম ছিল না, এটায় আছে – “রাম(কৃ)ষ(ণ)”। অর্থাৎ বলরাম ও কৃষ্ণ। কিভাবে বোঝা গেল এরা তারাই? একজনের হাতে গদা ও চক্র আছে।

ত্রিমাত্রিক মূর্তি আসবে আরেকটু পরে। ঐ মোরা কূপের ওখানেই বেশ কয়েকটি মূর্তি পাওয়া গেছে, দুটি পুরুষের আর একটি নারীর। দুঃখের বিষয় এদের মুখ বা হাত অবশিষ্ট নেই। গায়ের গহনা আর ধুতি দেখে পুরুষ মূর্তিগুলিকে যক্ষ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও শরীরে বৃষ্ণি বীরদের লক্ষণ নেই, তবু কৌতুহল জাগে এরা কি বাসুদেব, একানংশা ও সংকর্ষণ হতে পারে?

তথ্যসূত্র:

ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট- নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

Gupta, Vinay. (2019). Vrishnis in Ancient Literature and Art.

Series Navigation<< বিষ্ণুর উৎস সন্ধানে- দ্বিতীয় পর্ববিষ্ণুর উৎস সন্ধানে- চতুর্থ পর্ব >>

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?