স্মার্ট ড্রাগ
আজকের গল্প, কালকের বিজ্ঞান। ১৯৬৬ সালে কল্পবিজ্ঞান কাহিনিকার আইজ়্যাক আসিমভ লিখেছিলেন উপন্যাস ‘ফ্যান্টাস্টিক ভয়েজ’। মানুষের মস্তিষ্কের রোগ সারানোর জন্য ওষুধকে হাজার হাজার গুণ ছোট বানিয়ে ধমনীর মধ্যে সাবমেরিনের মতো ছুটিয়ে একেবারে লক্ষ্যবস্তু পর্যন্ত পৌঁছনো। রসায়নবিদেরা এখন ল্যাবরেটরিতে বানাচ্ছেন ন্যানোমিটার (এক মিলিমিটারের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ) মাপের ‘মলিকিউলার সাবমেরিন’। উদ্দেশ্য সেই একই, ক্যানসারের মতো ব্যাধিতে কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে ঠিক জায়গায় ঠিক কাজটি করা। এ রকম ওষুধকে বলা যায় ‘স্মার্ট ড্রাগ।
এ ভাবেই নিজের কাজ ব্যাখ্যা করেন নোবেলজয়ী ডাচ রসায়ন বিজ্ঞানী বার্নার্ড এল ফেরিঙ্গা। গ্রনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক ২০১৬ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জাঁ-পিয়ের সভেজ এবং স্যর জে ফ্রেসার স্টোডার্টের সঙ্গে। ওঁদের কাজ পরমাণু জুড়ে-জুড়ে ক্ষুদ্রাকৃতির অণু তৈরি। যা মাপে চুলের হাজার হাজার ভাগের এক ভাগ। ওঁরা নাটবল্টুর মতো জোড়েন পরমাণু, তা থেকে বানান মলিকিউলার মোটর, সুইচ, রোবট।
বলতে গেলে ওঁরা বাস্তবে রূপায়িত করছেন আরও এক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর স্বপ্ন। তিনি রিচার্ড ফিলিপ ফাইনম্যান। আমাদের চারপাশে সব বস্তুই তো অণু-পরমাণুর পাহাড়। ফাইনম্যান বলেছিলেন, পরমাণুর পর পরমাণু জুড়ে মেশিন-টেশিন বানানো যায় না? গেলে, কতটুকু মাপ হতে পারে সেই সব মেশিনের? মানুষের হাত দিয়ে তো অণু-পরমাণু নাড়াচাড়া করা যায় না, সে কারণে বিশেষ কায়দায় বানাতে হবে ওই রকম মেশিন। ফেরিঙ্গা এবং তাঁর সতীর্থরা বানাচ্ছেন সে রকমই মেশিন।
ফেরিঙ্গা বললেন, ‘‘বিদ্যুতের সুইচ যেমন হয়, আমরা বানাচ্ছি তেমনই আণবিক সুইচ। আমাদের দেহে অহর্নিশ কাজ করছে নানা রকম জৈবিক সুইচ। আমি অন্য কাউকে দেখছি, অন্য কেউও যে আমাকে দেখছেন তার মূলে ওই হরেক সুইচের কারসাজি।’’ আমরা বানাতে চাই এমন সুইচ, যা অন-অফ হবে আলোর খেলায়।’’
সিলিকন চিপ যেমন কাজ করে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে, তেমনই ওই আণবিক সুইচও কাজ করবে তথ্য জমিয়ে রাখার বেলায়। একটা সিডি-র মধ্যে ওই ভাবে কত তথ্য জমিয়ে রাখা যায়? উদাহরণ দিয়ে ফেরিঙ্গা বললেন, ‘‘হাজার হাজার গান। এতগুলো গান যে, ছ’-সাত পুরুষ ধরে শুনলেও তার ভাঁড়ার ফুরোবে না।’’
ফেরিঙ্গা এক সময়ে কাজ করতেন রসায়ন শিল্পের গবেষণাগারে। তবু তাঁর মন পড়ে থাকত বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশেষে সেখানেই যোগদান। বললেন, ‘‘রাজনীতিকদের কথায় ভুলবেন না। ভুলবেন না শিল্প-মালিকদের কথাতেও। মনে রাখবেন, মৌলিক গবেষণায় গুরুত্ব কম দিলে শিল্পেরই ক্ষতি। রাজনীতিকেরা কেবল আজ নিয়ে চিন্তিত, কালকের কথা প্রায়ই ভুলে যান। আজকের গবেষণা কিন্তু কালকের জীবন। এ জন্য মৌলিক গবেষণায় উৎসাহ হারানো, বিনিয়োগ কমানো যে কোনও দেশের পক্ষেই সর্বনাশ ডেকে আনে।’’
তাঁর জীবনে শিক্ষকদের ভূমিকা কেমন? প্রশ্নের উত্তরে ফেরিঙ্গা বললেন, ‘‘আমি এখনও ভুলতে পারি না কয়েক জনের কথা। যেমন, ছোটবেলায় আমার কেমিস্ট্রি টিচার। মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন আমায়। কোনও জিনিস কেন লাল, কোনওটা কেন নীল রঙের, কোনওটা কেন নরম, আবার কোনওটা লোহার মতো শক্ত— সে সব আমাকে বুঝিয়ে দিতেন তিনি। এক মহিলা পড়াতেন অঙ্ক। যে বিষয় ফর্মুলায়-ফর্মুলায় কন্টঙ্কিত, তা উনি জলবৎ তরল করে বোঝাতেন। আমার মধ্যে গণিতের প্রতি ভালবাসা উনিই জাগিয়ে তুলেছিলেন। গত বছর দেখা হয়েছিল আমাদের ক্লাসের সেই কেমিস্ট্রি টিচারের সঙ্গে। ওঁর বয়স এখন ৮০ ছুঁইছুঁই। আমাকে কী বললেন জানেন? বললেন, তিনি স্বপ্ন দেখেন সেই দিনের, যে দিন পৃথিবীর প্রতিটি ছাত্র অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্য অন্তত এক জন শিক্ষক পাবে।’’
ডাচ দূতাবাসের পক্ষ থেকে এ দিনের সান্ধ্য অনুষ্ঠানে ডাকা হয়েছিল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষকদের। তাঁদের উদ্দেশ্যে ফেরিঙ্গা বললেন, ‘‘আপনাদের কাছে অনুরোধ, ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করবেন প্রশ্ন করতে। তা সেই প্রশ্ন আপাতদৃষ্টিতে যতই বোকা-বোকা ঠেকুক। মনে রাখবেন, ছাত্রদের প্রশ্ন থেকেই অনেক আবিষ্কারের ক্লু মেলে। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে আমাকে প্রায়ই স্কুলে-স্কুলে যেতে হয় বক্তৃতা দিতে। এক বার একটি স্কুলে গিয়েছি। সেখানে দশ-এগারো বছরের একটি ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, আপনারা যে আণবিক মোটর বানিয়েছেন, তা ট্র্যাফিক জ্যামে পড়ে?’ ল্যাবরেটরিতে আমরা এখন শুধু মোটর নয়, তা যাতায়াতের জন্য এমন পথও বানাচ্ছি, যাতে তা মসৃণ ভাবে চলাচল করতে পারে।’’