চাকুরি
চাকুরি কাহাকে বলে? অভিধান বলিতেছে “অফিস কারখানা ইত্যাদীতে বেতন লইয়া নিয়মিত কাজ করিবার দায়িত্ব”। ইহা একটি বিশেষ্য এবং বাংলাতে এই শব্দটি ফারসি ভাষা হইতে আগত। সরকারি হিসাব বলিতেছে পশ্চিমবঙ্গের মোট সরকারি চাকুরিজীবীর সংখ্যা দশ লক্ষাধিক। সংখ্যাটি সুবিশাল এবং এই দশলক্ষাধিক কমর্চারী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করিতেছে প্রায় ৫০ লক্ষ মনুষ্যজীবন। অনুরূপে বে-সরকারি সংগঠিত ক্ষেত্রে চাকুরিজীবির সংখ্যাটি অনুমানিক এক কোটি। অর্থাৎ মোট চাকুরিজীবির সংখ্যা এক কোটি দশ লক্ষ। এবং এই এক কোটি দশ লক্ষের কর্মীবাহিনী নিয়ন্ত্রন করিতেছেন আনুমানিক ৭-৮ কোটি মানুষকে। ধারে এবং ভারে সংখ্যাটি সত্যই গুরুতর।
সময় আসিয়াছে এই বিপুল কর্মী বাহিনীকে দেখিবার আঙ্গিকে পরিবর্তন করিবার। ইতিহাস সাক্ষী স্বাধীন ভারতের যে কোন কর্তৃপক্ষ কর্মচারীকে কর্মী নহে দাস হিসেবে ভাবিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। সংবিধানে এবং দেশীয় নানাবিধ আইনে দাসপ্রথাকে একটি আইনি অপরাধ হিসাবে স্বিকৃতি দেওয়া হইয়াছে। এ প্রসঙ্গে এই প্রথার সহিত যুক্ত সকল ব্যক্তিই আইনের চোখে অপরাধী। কিন্তু কিমাশ্চর্য্যম, আইনকে প্রকৃত অর্থেই কদলী প্রদর্শন করিয়া আইন ভঙ্গ করা হইতেছে। অনেকসময়েই ইহা করিতেছেন সমাজের উন্নত সম্প্রদায়ের কর্তাব্যাক্তিরাই। সম্প্রতি খবরে আসিয়াছে ডেবরার একটি স্বল্প শিক্ষিত পরিবারের শিক্ষিতা সন্তান সবিতা লায়েকের ঘটনা। কারিগরি শিক্ষা দপ্তরে অস্থায়ী চাকরি করিতে গিয়া এক ভয়ানক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইয়াছেন সবিতা। মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর, রাজ্যপাল এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের নিকট তাঁহার করা লিখিত অভিযোগে তিনি জানাইয়াছেন যে অস্থায়ী চাকুরীর নামে তাঁহাকে দিয়া ঘর ঝাঁট, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, তিন চারিটি কুকুরের মল পরিষ্কার করানো হইতো। তৎসহ কাজে সামান্য ভুল হইলেই জাত তুলিয়া গালি দেওয়া হইত। অভিযোগটি গুরুতর। বিশেষ করিয়া অভিযোগটি যখন দফতরের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে করা হয় তখন তাহা ধারে এবং ভারে বিশেষ করিয়া গুরুতর হইয়া ওঠে। মন্ত্রী বলিতেছেন এমনকিছু ঘটে নাই সবিতা তাহার গৃহে ব্যক্তিগত সহায়ক হিসেবে কাজ করিতেন এবং তিনি স্বেচ্ছায় কাজ ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন। সত্য-মিথ্যা তদন্তে প্রকাশ পাইবে। কিন্তু অভিযোগটি উঠিয়াছে।
পরিতাপের বিষয় হইল অভিযোগটি নূতন নহে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ দারোগাবাবুর গৃহে পুলিশের ড্রাইভার বাজার সরকারের কাজ করিতেছেন, ক্ষমতাশালী অফিসারের অধঃস্তন কর্মচারী সরকারি গাড়ি লইয়া অফিসারের সন্তানকে বিদ্যালয় হইতে আনিতে যাইতেছেন, ইহা নূতন দৃশ্য নহে। মনস্তাত্ত্বিকেরা বলিবেন ইহা প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কের প্রতিফলন। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর এই পৃথিবীতে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কটাই একটি মস্ত অপরাধ। তাহা হইলে এই অপরাধটির প্রতিফলন এখনও হইতেছে কেন?
হইতেছে, কারন সমাজ এখনও দাসপ্রথা সমর্থন করে। ইটভাঁটায় যে শ্রমিকেরা প্রানান্ত পরিশ্রম করিতেছেন, বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি শ্রম দিতেছেন, আপনার গৃহে যে চাকরটি কাজ করিতেছে তাহার প্রতি মালিকের অথবা গৃহকর্তার ভাব প্রভুর ন্যায়। ‘যে অর্থ দিতেছি তাহা সম্পূর্ণ উশুল করিয়া লইতে হইবে’ – এই মানসিকতাই প্রাধান্য পাইতেছে। কতটা অর্থ কতটা পরিশ্রম ‘খরিদ’ করিতে পারে, কতটা পরিশ্রম পাইলে অর্থটি সঠিকভাবে ‘উশুল’ হয়, ইহা সম্পূর্ণভাবেই প্রভুরূপী মালিকই ঠিক করিতেছেন। সরকারি ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু জটিল। দফতরপ্রধানের কৃপাদৃষ্টি পাইবার জন্য অধস্তনঃ কর্মচারিটি আকুল। ঈশ্বরতুষ্টি হইলে প্রাপ্ত হইবে ‘সুবিধা’, অন্যায্য আয়টি হইবে ন্যায়-সঙ্গত, সার্ভিসরুলটি ইচ্ছামতন বাঁকানো যাইবে, দফতরের হাজিরাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হইবে না। আর রহিয়াছে শোষন। সরকারি ক্ষেত্রে বর্তমানে অস্থায়ী কর্মচারির সংখ্যা বহুগুন হইয়াছে। অস্থায়ী হিসাবে এই নিয়োগ বহুক্ষেত্রেই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অঙ্গুলি হেলনেই হইয়া থাকে। তাহারা কি করিতে পারেন উপরের খবরটিতেই পাঠক তাহার আন্দাজ পাইবেন। সরকারি ক্ষেত্রে দফতরের রাজনৈতিক মাথাটির আচরণ হইয়া থাকে প্রভুর ন্যায়।
সময় আসিয়াছে এই দাসপ্রথাকে সমূলে উৎপাটন করিবার। দাস-প্রভু নহে, কর্মচারী-কর্তৃপক্ষের সম্পর্ক হওয়া উচিত সংবিধান মোতাবেক। এ সংক্রান্ত আইন কঠোরভাবে মানিয়া চলা সরকারের আশু কর্তব্য। কিন্তু ইহা অপেক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ হইল সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন। ‘পরিশ্রম করিব এবং উহার বিনিময় অর্থোপার্জন করিব’, পেশা যাহাই হউক, কর্মনীতি ইহাই হওয়া উচিত। আইনের ফাঁক খুঁজিয়া, কর্তৃপক্ষকে যথাবিহিত তৈলমর্দন করিয়া বিনা পরিশ্রমে উপার্জন করিব এমন মানসিকতা অবিলম্বে পরিহার করা প্রয়োজন। এই মানসিকতাই বর্তমানের কর্মচারী-কর্তৃপক্ষের ভিতরে জন্মানো দাস মানসিকতার সৃষ্টিকর্তা।