নদীর দুই ধারে বসে দু'জন দুঃখী মানুষ। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। দু'জনেই শোকমগ্ন। ক্ষোভমগ্ন। কি হল সেই রাতে? মোবাইলে পড়তে হলে স্ক্রল করুন নিচে...

দুঃখ

নদীর দুই ধারে বসে দু’জন মানুষ। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। দু’জনেই শোকমগ্ন। ক্ষোভমগ্ন।
জগতে আমার চাইতে দুঃখী নেই কেউ। সারাটা জীবন শুধু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে এলাম। একের পর এক ভুল। হায় হায়, এই ভাগ্য নিয়ে মানুষ বাঁচে? প্রাণ যায় যাক। আর সহ্য হয় না।
দু’জনেই একই সময়ে ভাবল। একই সঙ্গে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালো। দু’জনেই দু’জনকে দেখে বিস্মিত হল।
একজন ভাবল, আহা কি ভাগ্যশীল মানুষ! কি পরিতৃপ্ত মানুষ! এই মধ্যরাতে জ্যোৎস্না উপভোগ কর‍তে এসেছে, একা।
আরেকজন ভাবল, আহা, নিশ্চয়ই কোনো সাধক হবেন। জগতের সব কিছুর উপর আসক্তি গেছে। পরমজ্ঞানে তৃপ্ত। সব দুঃখের পার।
দু’জনেই দিল ঝাঁপ। একে অন্যের হাতের নাগালে এলো। এ ওকে বাঁচাতে গিয়ে দু’জনেই এসে উঠল পাড়ে। একদিকেই। দু’জনেই কেঁদে উঠে বলল, আহা কেন বাঁচালে, আমার মত অভাগা, নির্বোধ, দরিদ্র মানুষের বেঁচে কি লাভ?
দু’জনেই দু’জনের কথা শুনে হল বিস্মিত। বলল, তবে এসো দু’জনেই দিই ঝাঁপ।
কিন্তু দেওয়া হল না। দু’জনেই চুপ করে বসে। বিষাদমগ্ন। হঠাৎ শুনল দূরে কোথাও মন্ত্র উচ্চারণের শব্দ।
দু’জনেই তাকালো দু’জনের দিকে। উঠল। হাঁটতে শুরু করল মন্ত্র অনুসরণ করে।
এক বৃদ্ধ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বসে বসে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। সামনে প্রদীপ জ্বলছে। খুব ছোটো একটা মাটির কুটির।
তারা বসল। সন্ন্যাসী চোখ খুলে বললেন, দুঃখ নিবারণের উপায় আত্মহত্যা নয়। সাধনা।
তারা দু’জন চুপ করে থাকল। এ কথা শুনেছে। এ বন্ধ্যা নারীর প্রসব ব্যথার মত।
সন্ন্যাসী বললেন, সাধনা হল দুঃখ নিবারণের উপায়।
তারা দু’জনে বলল, হয় না। এগুলো শুনেছি শুধু। দুঃখ যায় কই? শান্তি পাই কই?
সন্ন্যাসী বলল, শান্তি মানে দুঃখের অন্ত না। দুঃখের স্বরূপকে জানা।
হঠাৎ নূপুরের শব্দ শোনা গেল। অন্ধকারে। কুটিরের বাইরে। দু’জনেই উৎকর্ণ হয়ে উঠল। কে যায়?
সন্ন্যাসী বলল, এ জঙ্গলে থাকে। পরমাসুন্দরী।
তারা বাইরে এলো। পরমাসুন্দরী দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্নায় স্নাত হয়ে। একজন জিজ্ঞাসা করল, কে তুমি?
পরমাসুন্দরী বলল, দুঃখ।
তারা বলল, বিভ্রান্ত কোরো না। কে তুমি, কি তোমার রূপ, কি তোমার সৌরভ! কে তুমি?
সুন্দরী বলল, আমার কোমরের নীচ থেকে পা অবধি সৃষ্টি আসক্তিতে। কোমর থেকে গ্রীবা অবধি সৃষ্টি বিদ্বেষে। আর আমার মস্তিষ্ক সৃষ্টি মোহতে। সে সব নিয়ে আমি – দুঃখ।
তারা অবাক হয়ে বলল, তুমি যতই ভয় দেখাও, আমরা জানি তুমি সুন্দর। আমাদের নাও। আজকের রাতটা হও আমাদের!
পরমাসুন্দরী বলল, বেশ। তবে কথা দাও, ছেড়ে যাবে না, ভোর হওয়ার আগে।
তারা বলল, তুমি না তাড়ালে কোনোদিন যাব না।
পরমাসুন্দরী হাসল। বলল, এসো।
তারা হাঁটতে শুরু করল। যত হাঁটে তত পরমাসুন্দরীর গায়ের থেকে এক-একটা করে অঙ্গ খসে খসে যেতে থাকে। দুর্গন্ধ বেরোতে শুরু করে। সব সৌন্দর্য যেন বাতাসে মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।
তারা থেমে গেল। বলল, আর হাঁটব না। আমরা ফিরব।
ততক্ষণে তাদের চারদিকে মৃত কঙ্কালের সারি। যতদূর দেখা যায় শুধু কঙ্কাল আর কঙ্কাল। সে রমণী বলল, এরা সবাই আমার জন্যেই এসেছে। কেউ এগোতে চায়নি। এস, বললে আমায় গ্রহণ করবে, না তাড়ালে যাবেই না।
তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বলল, ছেড়ে দিন। আমরা যাই। আমাদের আর এ ভুল হবে না। আমরা যাই….
বলতে বলতে দেখে, তারা আবার নদীর দুই তীরে বসে। কান্না উঠছে। বিষাদ জন্মাচ্ছে। সব মনে হচ্ছে ব্যর্থ, অর্থহীন। কিছুই হল না জীবনে।
আবার দু’জনে দিল ঝাঁপ। আবার একে অন্যকে করল উদ্ধার। আবার এলো সন্ন্যাসীর কুটিরে। আবার শুনল নূপুরের শব্দ। আবার এলো বাইরে। আবার চলল তাকে অনুসরণ করে। আবার এলো সেই কঙ্কালস্তূপের সামনে।
একজন আতঙ্কে তাকিয়ে বলল, আবার একই ভুল করলাম? এক মুহূর্তেই গেলাম ভুলে সব?
সে রমণী বলল, না, এক মুহূর্তে নয়। সে ছিল গতজন্মের কথা। ওই যে, সে জন্মের কঙ্কাল।
একজন বলল, আমি আর যাব না, আমায় ছেড়ে দিন।
রমণী হাসল। বলল, বেশ। সঙ্গে সঙ্গে সে কঙ্কালে পরিণত হল।
আরেকজন বলল, আমি তোমার সঙ্গে যেতে চাই। চলো।
তারা কঙ্কালের পর কঙ্কাল পেরোলো। রমণী বলে, এসো বসি। এসো, নাও, আমায় গ্রহণ করো।
সে বলে, আরো খানিক এগোই। তারপর।
এগোতে এগোতে সে শুধু তাকিয়ে থাকে সেই রমণীর দিকে। তার কুৎসিত, বীভৎস রূপকে দেখে অপলকে তাকিয়ে। সে আলিঙ্গন করতে চাইলে দেয় ফিরিয়ে। সে আড়ালে গেলে নেয় খুঁজে। এইভাবে গোটা রাত কাটল। ক্রমে সে রমণীর কুৎসিত রূপ, বীভৎসতা লীন হয়ে আসতে লাগল ভোরের আলোয়। ক্রমে সে মিলিয়ে যেতে শুরু করল বাতাসে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। কঙ্কালগুলো হল ঘাস। রমণী ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে যেতে শুরু করল। যাওয়ার আগে বলে গেল, তুমি পেয়ে গেলে পার।
ভোরের সূর্য উঠছে। সন্ন্যাসী বসে ধ্যানে। সে গিয়ে প্রণাম করে বলল, আমি সমস্তটা পথ এলাম হেঁটে।
সন্ন্যাসী বললেন, কি উপলব্ধি করলে?
সে বলল, দুঃখের পার আছে। দুঃখকে জেনেই। দুঃখের ভয় হল মোহ। দুঃখকে স্বীকার হল জ্ঞান। দুঃখকে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করাই হল নির্বাণ। দুঃখকে বুঝলে দুঃখ আর নেই।

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?

লেখক পরিচয় |

জন্ম ১৯৭৬-এ হাওড়ার সালকিয়ায়। বর্তমান নিবাস হালিশহরে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশা শিক্ষকতা। সাহিত্য জীবন শুরু কবিতা দিয়ে। 'উদ্বোধন' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা। প্রিয় বিষয় দর্শন ও মনোবিজ্ঞান। জীবনে জীবন যোগ করার কাজ করে চলেছেন লেখনীর মাধ্যমে আর পাঠককে এক জীবনে অনেক জীবন যাপন করাচ্ছেন প্রতিটা শব্দের অভ্যন্তরস্থ অনুভূতির মধ্যে দিয়ে, সেতু বাঁধছেন লেখকে-পাঠকে।

Start typing and press Enter to search