শ্রী চৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে ঘুরে ফিরে বারবার উঠে আসে জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের রহস্যময় মৃত্যুর কথা। তার মৃত্যুর পর ২৭ টা বছর পেরিয়ে গেল অথচ খুব অদ্ভুত ভাবেই সমাজ এই অসাধারণ মানুষটাকে নিয়ে আজও নীরব! তাঁর মৃত্যুরহস্য নিয়ে ২টি পর্বে আমাদের প্রতিবেদন। মোবাইলে পড়তে স্ক্রল করুন নিচে...

জয়দেব মুখোপাধ্যায়: চৈতন্য গবেষকের মৃত্যুরহস্য- পর্ব ২

সত্যি বলতে কি, প্রবন্ধটা পড়ে কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয়। গোটা ঘটনাটাকে অন্তঃকরণ করতে বেশ কিছুটা সময় লাগে।

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল ১৯৩০ এর দশকের শেষের দিকে বোলপুরে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন; বাবা এবং দাদামশাই, দুজনেই ছিলেন বিচারপতি। দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায় তার বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন যে জয়দেববাবু ছিলেন আই.সি.এস পিতার একমাত্র সন্তান। তিনি প্রাচ্য দর্শনের উপর ডক্টরেট করেন এবং ভারতীয় সভ্যতার শেকড় খুঁজতে একসময় এশিয়ার বহু দেশে ঘুরেছিলেন। শিবের ঐতিহাসিকতা বিষয়ে গবেষণা করার জন্য বহুবার প্রাণ বিপন্ন করে কৈলাসের মানস সরোবর এবং সংলগ্ন বরফে ঢাকা পাহাড়ের আনাচে কানাচে খুঁজে বেড়িয়েছেন। একাধিক ভাষা জানতেন এবং প্রাচীন সাহিত্য, সংস্কৃত এবং শাস্ত্রজ্ঞানের জন্য তিনি একাডেমিক সার্কেলে অত্যন্ত পরিচিত ছিলেন সেসময়। জগন্নাথদেবকে নিয়ে তার লিখিত বইগুলো এখনো বেস্টসেলার। কিছু বই অবশ্য এখন আর খুঁজে পাওয়া যায়না, কিছু তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি। ভদ্রলোক সমস্ত সুখ ঐশ্বর্য ত্যাগ করে একদমই সাধারন দীনহীনের মত জীবন যাপন করতেন। দুঃখের বিষয় হল, গোটা মানুষটার অস্তিত্বটাকেই আজ এমন ভাবে ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়া হয়েছে যে তার একটা ছবিও আর খুঁজে পাওয়া যায়না ইন্টারনেটে! ‘ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে’ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় প্রকাশক সুরেশ দাস ১৯৮৯ সালে কলকাতা থেকে লিখেছেন যে ১৯৭৮ সালে প্রথম পর্ব প্রকাশিত হবার পর কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসু এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ডঃ শান্তি কুমার দাশগুপ্তের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। জয়দেববাবুর সাথে পরিচয় হবার পরই এনারা এই বিষয়ে বই লিখেছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, সুরেশ দাস সেই ১৯৮৯ সালে লিখেছিলেন যে ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’ এর দ্বিতীয় খণ্ড রচনা প্রায় সম্পূর্ণ করে ফেলেছেন জয়দেববাবু এবং এর জন্য তিনি বাংলা ও উড়িষ্যার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে চৈতন্যের সমসাময়িক বহু প্রাচীন পুঁথিও আবিষ্কার করেছিলেন। এর বছর ছয়েক বাদে তার রহস্যমৃত্যু ঘটে।

জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের লেখা তিনটি বিখ্যাত গ্রন্থ (কাঁহা গেলে তোমা পাই , দারুব্রহ্ম রহস্য এবং ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে )

তার মৃত্যুর পর বেশ কিছু গুজব রটানো হয়েছিল। পুলিস বলেছিল আত্মহত্যা আবার কেউ কেউ দাবী করেছিলেন যে মন্দিরের জমি সংক্রান্ত বিবাদের কারণেই তাকে খুন করা হয়। একটা ব্যাপার খুব আশ্চর্যজনক যে এরকম একটা অসাধারণ মানুষ, বহুবার হুমকি পেয়েও কেন তার বইয়ের দ্বিতীয় পর্বের একাধিক পাণ্ডুলিপি বানিয়ে যান নি?

এই নিয়েও কিছু গল্প প্রচলিত আছে। দু-একজন দাবী করেছিলেন যে জয়দেববাবু নাকি একাধিক পাণ্ডুলিপি আলাদা আলাদা ভাবে কপি করে রেখেছিলেন এবং মৃত্যুর আগে তার ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষকে পাঠিয়ে যান। আবার কেউ বলে যে পাণ্ডুলিপি সহ সমস্ত প্রাচীন পুঁথি এখনো সিবিআই কিম্বা উড়িষ্যা পুলিসের গোপন লকারে জমা করা আছে। কেউ বলে সেই পাণ্ডুলিপির ছেঁড়া কয়েকটা পাতা বহুদিন বাদে পুরীর সমুদ্রসৈকতে পাওয়া গিয়েছিল। আবার একজন সাংবাদিককে ফেসবুকে দাবী করতে দেখলাম যে এই বইটা আজও ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট হিসেবে ভুবনেশ্বর মিউজিয়ামের ভল্টে রাখা আছে। জয়দেববাবু সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য অন্য শিরনাম ব্যবহার করে বইটা লিখেছিলেন। তবে এই নিয়ে বিশদে কিছু বলা সম্ভব নয় কারণ পুরোটাই কিংবদন্তী বা মিথের মত ভেসে বেড়ায়! জয়দেববাবুর মৃত্যুর খবর – যুগান্তর পত্রিকা (আনন্দময়ী আশ্রমে রহস্যজনক মৃত্যু – ১৯.৮.১৯৯৫)The Telegraph (Diary entry hints at dispute over property : New Twist to Puri Death – 30.4.1995) এবং The Statesman (Death of two ashram-dwellers baffle Police in Puri – 28.4.1995) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আগ্রহীরা খুঁজে দেখতে পারেন । আমি এত পুরনো পেপার জোগাড় করতে পারিনি।

জয়দেববাবুর মৃত্যুর বছর পাঁচেক বাদে ২০০০ সালের ১৫ই জুন (তারিখটা দুচারদিন আগে পরে হতে পারে। জোর দিয়ে কেউ বলতে পারেনি), আনন্দবাজার পত্রিকার পাঁচ নম্বর পাতায় একটা খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল যে ASI জগন্নাথ মন্দিরের সংরক্ষণ করার সময় মন্দির গাত্রের এক প্রাচীরের মধ্যে থেকে একটা/দুটো কঙ্কাল উদ্ধার করেছে। এরপর কঙ্কালটাকে/ কঙ্কালগুলোকে ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য ল্যাবেও পাঠানো হয়েছিল। কিন্ত খুব আশ্চর্যের কথা হল, এরপর কোন প্রভাবশালী মহল থেকে পুরো ঘটনাটাকে চেপে দেওয়া হয়। এরপর আর সেই কঙ্কালের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি! সম্ভবত ল্যাব থেকেই কঙ্কালগুলোকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

আমি ASI এর Annual Report পড়ে দেখেছি যে ১৯৯৯ সালে জগন্নাথ মন্দির কর্তৃপক্ষ ASI এর কর্মীদের সত্যিই মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করে Measure Drawing করার অনুমতি দেয় এবং ২০০০ সালে জগন্নাথ মন্দিরের বেশ কিছু অংশ সংরক্ষণও করা হয়েছিল। ২০০০ সালের জুন মাসের আনন্দবাজার পত্রিকাগুলো কারোর কাছে থাকলে খুঁজে দেখতে পারেন, আমি জোগাড় করতে পারিনি। গোপালকৃষ্ণ রায়ের লেখা – জ্ঞাননৌকা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, বইতেও ঘটনাটার উল্লেখ আছে। এই প্রসঙ্গে গবেষক এবং অধ্যাপক তমাল দাশগুপ্তের সাথে আমার দিন কয়েক আগেই কথা হয়েছিল। তমালদাই প্রথম দীর্ঘ গবেষণা করে ‘চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে‘ নামে একটা অসাধারণ প্রবন্ধ লেখেন, যার পর বাঙালি নেটিজেনদের মধ্যে এই বিষয়ে আবার নতুন করে আগ্রহ জন্মায়। তমালদা বলছিলেন, সেসময় কঙ্কালের খবরটা বেশ কয়েকটা সংবাদপত্রে ছাপা হয় এবং আজ থেকে সাত-আট বছর আগেও নেটে এই নিয়ে সার্চ করলে একটা আর্টিকেল পাওয়া যেত। উনি নিজেই দেখেছেন! কিন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার মাঝে কোন একটা সময়ে ইন্টারনেট থেকে সেটা সরিয়ে নেওয়া হয়। ঘটনাটার পর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের যিনি স্থানীয় অধিকর্তা তাকেও সেদিনই বদলি করে দেওয়া হয় কেরালায়। দুটো কঙ্কালের মধ্যে একটার আকার ছিল দীর্ঘ; প্রায় সাড়ে ছয় ফুটের মত এবং অপর কঙ্কালটার আকার ছিল ছোট। তবে কি ছোট কঙ্কালটা স্বরুপ দামোদরের? উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। হয়তো এতদিন বাদে আর উত্তর খুঁজে পাওয়া সম্ভবও নয়।

এই প্রসঙ্গে আরেকটা ভীষণ আশ্চর্যজনক তথ্য দিয়ে লেখাটা শেষ করি। সাংবাদিক অরুপ বসু লিখেছেন যে জয়দেববাবু ঝাড়গ্রামের লালজল জঙ্গলে পাথরের উপর চিহ্নের খোঁজে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতেন দিনের পর দিন। সাম্প্রতিককালের চৈতন্য গবেষক তুহিন মুখোপাধ্যায়ও কিন্ত তার বই ‘চৈতন্যের শেষ প্রহর’ বইতে উড়িষ্যার চুরঙ্গগড়/সারঙ্গগড় দুর্গের পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে এমনই এক পাথুরে সাঙ্কেতিক লিপির উল্লেখ করেছেন। সিদ্ধেশ্বর মন্দিরের পিছনের দুর্গম অরণ্যের মধ্যে এক পাথরের উপর কিছু সাঙ্কেতিক লিপি এবং প্রাচীন এক অজ্ঞাতপরিচয় সাধকের সমাধির উল্লেখ আছে। তুহিন বাবু তার লেখায় তৎকালীন সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিচার করে যুক্তি দিয়েছেন সে সময়ের ধর্মভিরু হিন্দুদের পক্ষে খোদ মন্দির প্রাঙ্গনেই সচল জগন্নাথকে হত্যা করাটা বেশ অস্বাভাবিক শোনায়। তাছাড়া মন্দিরের মাদলপঞ্জিতেও সে সময় মন্দির শুদ্ধিকরণেরও কোন উল্লেখ পাওয়া যায়না। তাই হয়তো শ্রী চৈতন্য নিজেই কোন গুপ্তপথে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসেন কিম্বা বিগ্রহ দর্শনের পর তার প্রবল উত্তেজনায় যে ভাবসমাধি হয়েছিল তার সুযোগ নিয়ে গোবিন্দ বিদ্যাধর ও তার দলবল নদীপথ বেয়ে পার্শ্ববর্তী দুর্গম চুরঙ্গগড় (Chudanga Gada) দুর্গে এনে তাকে বন্দী করে রাখে। মনে রাখতে হবে যে এই গোবিন্দ বিদ্যাধরই কিন্ত কয়েকবছর বাদে ঘৃণ্য চক্রান্ত করে রাজা প্রতাপরুদ্রের সমস্ত বংশধরদের হত্যা করে উড়িষ্যার সিংহাসনে বসেছিল। তবে কোন আশ্চর্য কারণে তুহিনবাবু, মন্দির চত্বর থেকে পাওয়া কঙ্কালের খবরটা নিয়ে বিশেষ আলোচনা করেন নি তার বইতে।

নন্দনকাননের (প্রাচীন চন্দকা অরণ্য) উত্তরে গহন জঙ্গলের মধ্যে স্থিত অত্যন্ত সুরক্ষিত সেই চুরঙ্গগড় /সারঙ্গগড় দুর্গ যার কথা তুহিনবাবু তার লেখায় উল্লেখ করেছেন। চৈতন্যের সময় এই দুর্গ ছিল গোবিন্দ বিদ্যাধরের অধীনে এবং প্রাচী নদীর মোহনা থেকে কাকতপুর হয়ে জলপথে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এখানে পৌঁছানো সম্ভব ছিল  ।

এছাড়া সাম্প্রতিক কালের চৈতন্য গবেষক স্নেহাশিস মুখার্জিও তার লেখায় (তারেই খুঁজে বেড়াই) এমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি নিজে পুরীতে গিয়ে গবেষণা করে বলেন যে জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ দ্বারের দিক থেকে একটা গুপ্তপথ এসে শেষ হয়েছে বাসুদেব সার্বভৌমের বাড়ি বা বর্তমান গঙ্গামাতা মঠ। এখনো এই সুরঙ্গ পথের অস্তিত্ব আছে। তিনি এর ছবিও দিয়েছিলেন তার ফেসবুক পোস্টে। ভদ্রলোক এই বিষয়ে অনুসন্ধান করে এখন অব্দি ঊনিশটা পর্ব লিখেছেন।

তবে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ডঃ নীহাররঞ্জন রায়, নির্মল নাগ, ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়,  যুধিষ্ঠির জানা (মালীবুড়ো), ডঃ দীপক চন্দ্র, দুর্গাদাস চট্টোপাধ্যায়ের মত অসংখ্য গবেষক সরাসরি দাবী করেছিলেন যে নীলাচলেই চৈতন্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার মৃতদেহ খুব গোপনে সমাধিস্থ করা হয়েছিল যা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। সত্যি বলতে কি, প্রত্যক্ষ প্রমানের অভাবে আজকে এই সমস্ত দাবীগুলোর সত্যতা নিরূপণ করা প্রায় অসম্ভব। তাই Circumstantial Evidence এবং Inductive Reasoning এর ভিত্তিতে সত্যান্বেষণ করা ছাড়া উপায় নেই। জোরালো প্রমান হয়তো পাওয়া সম্ভব ছিল যদি সেই কঙ্কালের ডিএনএ টেস্ট করা যেত কিম্বা মুরারি গুপ্ত, বৈষ্ণবদাস, স্বরুপ দামদর বা বৃন্দাবন দাসের লেখার হারানো অংশগুলো খুঁজে পাওয়া যেত যেগুলো জয়দেববাবু উদ্ধার করেছিলেন। কে বলতে পারে, হয়তো ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’ এর দ্বিতীয় পর্বটা এখনো অন্ধকার ঘরের কোন ধুলোমাখা আলমারির কোনায় অবহেলায় অনাদরে পড়ে রয়েছে! শুনেছি জয়দেববাবুর জন্ম বোলপুরে। ঐ অঞ্চলের কেউ খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন ওনাদের বাড়িটা এখনো রয়েছে কিনা।

আসলে একটা বিষয় ভেবে আমার খুব অবাক লাগে যে বাংলার ইতিহাসের দুই যুগনায়ক, যারা বাংলার সমাজজীবনে বিপ্লব নিয়ে এসেছিলেন সেই – শ্রী চৈতন্য এবং সুভাষচন্দ্র বসু, দুজনের মৃত্যুই কি অদ্ভুত রহস্যের মোড়কে জড়ানো। ইতিহাসের কি আশ্চর্য সমাপতন না! হয়তো এই জন্যই একজন বাঙালি হিসেবে এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করি এই বিষয়ে।

মাস খানেক আগে ঠিক এই কথাগুলোই হচ্ছিল নিজের বন্ধু সার্কেলে। এমবিএ’র সহপাঠী অরিজিতের সাথে আমার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। অরিজিতের পদবী পাত্র। শেকড় উৎকলে হলেও গত কয়েক প্রজন্ম ধরেই বাংলার বাসিন্দা এবং একজন খাঁটি বাঙালি তথা যদুবংশীয় (JU)। অরিজিতকে এই রহস্যমৃত্যুর কথা বলতেই ও প্রথমে কিছুক্ষণ থমকে গেল। তারপর দ্বিধা কাটিয়ে বলল যে পুরীতে আমাদের পরিবারের পাণ্ডারা অন্তত ১৫-২০ প্রজন্ম ধরে ওখানেই বাস করছে। বর্তমানে যিনি পাণ্ডা, তিনি ছোটবেলায় ওকে এরকমই এক ঘটনার কথা বলেছিল। সেই পাণ্ডাও নিজে বংশপরম্পরায় এই হত্যার ঘটনাটা শুনে আসছে। ছোটবেলায় ও ঘটনাটার গুরুত্বটা বুঝতে পারেনি, কিন্ত আজকে বহুবছর বাদে আবার শোনার পর পুরো ঘটনাটা কানেক্ট করতে পারল। ওর মুখ থেকে শোনার পর আমার শরীরে একটা মৃদু শিহরন খেলে গেছিল সেদিন! পরবর্তীকালে আমি নিজে একাধিক সোর্স থেকে ঘটনাটার সত্যতা যাচাই করেছিলাম। অরিজিত মিথ্যা বলেনি সেদিন।

আজ থেকে ২৫ বছর আগে জয়দেববাবুকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।  সে সময় ইন্টারনেট ছিলনা,  সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। কিন্ত আজকের পৃথিবীতে মুহূর্তের মধ্যে দাবানলের মত ইনফরমেশন আমাদের আঙুলের ছোঁয়ায় হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে পৌঁছে যায়। যে বা যারা সত্যিটাকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন তারা হয়তো সেদিন বোঝে নি যে একজন জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে চুপ করিয়ে দিলেও ভবিষ্যতে তার জায়গায় আরো দশজন বাঙালি আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসবে একদিন। সত্যিটাকে বেশিদিন চেপে রাখা যায়না। একদিন না একদিন সে প্রকাশ পাবেই।

আজকের মত এটুকুই। ভালো থাকবেন।


দীর্ঘ ৫০০ বছর ধরে ধামাচাপা দিয়ে রাখা এই সত্যিটা সমস্ত বাঙ্গালির জানা উচিত।

পুনশ্চ : 

১। জয়দেব বাবুর কোন ছবি বা পুরনো পেপার কাটিংগুলো থাকলে, ফেসবুকে পোস্ট করে স্থাপত্যকে ট্যাগ করে দিতে পারেন। এই নির্ভীক জ্ঞানতাপসকে এভাবে ভুলে গেলে জাতি হিসেবে আমরা এক ক্ষমাহীন ভুল করব।

২। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিক ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের ৫/৮/১৯৭৬ তারিখে জয়দেববাবুকে লেখা চিঠির মূল বয়ানটা ছিল এরকম –

” শ্রী মহাপ্রভু চৈতন্যদেবকে গুমখুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং সন্ন্যাসী চৈতন্যদেবের দেহের কোন অবশেষের চিহ্নও রাখা হয়নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটে কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল। ঐ গুমখুনের সমস্ত ব্যাপারটাই একটা বহুদিনের চিন্তিত , বহুজন সমর্থিত চক্রান্তের ফল। কে বা কারা ঐ চক্রান্ত করেছিল সে সম্পর্কে আমার অনুমান একটা আছে কিন্ত তা বলতে পারব না । কারণ এখনও আর কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই। চৈতন্যদেব , গান্ধী martyr হতে পারেন, আমার martyr হবার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই।”

– তথ্যসূত্র –  শ্রীচৈতন্য অনন্ত জীবনের সত্যান্বেষণ (দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়), পৃষ্ঠা – ৩১৫।

৩। লেখাটা ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করার পর একজনের মন্তব্য দেখে ভীষণ প্রাসঙ্গিক মনে হল। তাই এখানে তুলে দিলাম। নামটা ইচ্ছে করেই গোপন রাখলাম।

”আমি আধা বাঙালি এবং আধা ওড়িয়া, জন্মের পর থেকে যতবার পুরীর মন্দিরে গিয়েছি, প্রতিবারই বাবা মন্দির থেকে বেরোনোর পর কানধরে ক্ষমা চাইতে বলেন, যদি অসাবধানতা বশত মহাপ্রভু অঙ্গে পা লেগে থাকে। শেষবারের যখন যাই, বিগ্রহ প্রদক্ষিণের সময়, আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, অন্ধকারময় স্যাঁতসেঁতে জায়গা, মেরে পুঁতে রেখে দিলেও কেউ টের পাবেনা। ওড়িয়া পান্ডাসহ সমস্ত ওড়িশার জনগণের কাছে এটা ওপেন সিক্রেটের মত।”

৪। ফেসবুকে পোস্টটা করার পর একজন আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে জানান যে – ‘জয়দেব বাবুর কেসটা পরবর্তীকালে সিবিআইয়ের হাতে দেওয়া হয়েছিল , কিন্ত ওড়িশা পুলিশের চরম অসহযোগিতার দরুন শেষ অব্দি একরকম বাধ্য হয়েই কেসটা বন্ধ করে দেওয়া হয়”। আমি এই তথ্যের সোর্স জানতে চাইলে উনি বলেন যে কয়েক বছর আগে পুরীতে গিয়ে উনি এই খবরটা পেয়েছিলেন। এর সত্যতা যাচাই করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।


চৈতন্যের রহস্যমৃত্যু বিষয়ে জানতে যে লেখাগুলো পড়তে পারেন :

১। আর্টিকেল :

a. চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে

b. শ্রী চৈতন্যের রহস্যজনক মৃত্যু প্রসঙ্গে কিছু কথা

c. রহস্যে ভরা চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্ধান কেন হারিয়ে গেলেন যুগ পুরুষ

২। বই – কাঁহা গেলে তোমা পাই (ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়) , চৈতন্যের শেষ প্রহর (তুহিন মুখোপাধ্যায়)ক্ষমা কর হে প্রভু (রুপক সাহা) , শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য – যুধিষ্ঠির জানা (মালীবুড়ো), চৈতন্য শেষ কোথায় ? (রজত পাল), জ্যেতির্ময় শ্রীচৈতন্য (কালকূট – সমরেশ বসু), সচল জগন্নাথ শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য (ডঃ দীপক চন্দ্র),শ্রী চৈতন্যের দিব্যজীবন এবং অজ্ঞাত তিরোধান পর্ব (বিষ্ণুপদ পাণ্ডা), গোরা (শৈবাল মিত্র), শ্রী চৈতন্য অন্তর্ধান রহস্য (দেবাশিস পাঠক), শ্রীচৈতন্য অনন্ত জীবনের সত্যান্বেষণ (দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়), সেথায় চরণ পড়ে তোমার (দেবশ্রী চক্রবর্তী)

এছাড়া কিছু বই আছে যেগুলো নিষিদ্ধ কিম্বা আউট অফ প্রিন্ট যেমন – ইতিহাসে শ্রীচৈতন্য (অমূল্য চরণ সেন)

ঋণস্বীকারঃ স্থাপত্য

Series Navigation<< জয়দেব মুখোপাধ্যায়: চৈতন্য গবেষকের মৃত্যুরহস্য- পর্ব ১

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?

লেখক পরিচয় |

Start typing and press Enter to search