শ্রী চৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে ঘুরে ফিরে বারবার উঠে আসে জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের রহস্যময় মৃত্যুর কথা। তার মৃত্যুর পর ২৭ টা বছর পেরিয়ে গেল অথচ খুব অদ্ভুত ভাবেই সমাজ এই অসাধারণ মানুষটাকে নিয়ে আজও নীরব! তাঁর মৃত্যুরহস্য নিয়ে ২টি পর্বে আমাদের প্রতিবেদন। মোবাইলে পড়তে স্ক্রল করুন নিচে...

জয়দেব মুখোপাধ্যায়: চৈতন্য গবেষকের মৃত্যুরহস্য- পর্ব ১

শ্রী চৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে ঘুরে ফিরে বারবার উঠে আসে জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের রহস্যময় মৃত্যুর কথা। মানুষটা গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন এই রহস্য সমাধানের জন্য। তারপর দেখতে দেখতে তার মৃত্যুর পর ২৭ টা বছর পেরিয়ে গেল অথচ খুব অদ্ভুত ভাবেই সমাজ এই অসাধারণ মানুষটাকে নিয়ে আজও নীরব! শুধুমাত্র আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত কুড়ি বছরের পুরনো এক প্রবন্ধ ছাড়া আর বিশেষ কোন সোর্সের উল্লেখ পাওয়া যায়না। আজকালের মূল প্রবন্ধটা দুর্লভ এবং বিস্ফোরক তথ্যে ঠাসা। তাই ‘লেখা’র পক্ষ থেকে আজ মূল প্রবন্ধটা উপহার দেওয়া হল পাঠকদের।

লেখক – অরুপ বসু , শারদীয় আজকাল (বিশেষ সংখ্যা) ১৪০৭ , পৃষ্ঠা ৩৯২

লেখক – অরুপ বসু , শারদীয় আজকাল (বিশেষ সংখ্যা) ১৪০৭

এক

‘বিশ্ব যখন নিদ্রা মগন গগন অন্ধকার / কে দেয় আমার বীণার তারে এমন ঝঙ্কার’। এ গান যখন লিখেছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ঊনপঞ্চাশ। আর আটচল্লিশ বছর বয়সে চৈতন্য যখন বলছেন ‘গোবিন্দ বিরহে আমার কাছে মুহূর্ত হয় যুগের মতন সুদীর্ঘ / চোখে নেমে আসে ঘন বরষা / সমস্ত সংসার আমার কাছে হয়ে যায় শূন্য’, তখন তার মৃত্যু হয়। ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন। এখনও পর্যন্ত রহস্যাবৃত সেই মৃত্যু। খুন বা আত্মহত্যা যাই হোক, দেহটা গেল কোথায়?

৪৬২ বছর বাদে এই সত্যের অনুসন্ধানে নেমে যখন প্রায় প্রমান করতে চলেছেন চৈতন্যকে কিভাবে কারা খুন করেছিল এবং দেহ কোথায় পুঁতে দিয়েছে, ঠিক তখনই মৃত্যু হল সত্যান্বেষী ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের, ১৯৯৫ সালের ১৭ এপ্রিল। ৫ বছর বাদেও জয়দেববাবুর মৃত্যু রহস্যাবৃত। স্থানীয় লোকেরা যাকে সরাসরি খুন বলে সন্দেহজনক ব্যক্তির শাস্তি চায়, সরকারি খাতায় তাকেই আত্মহত্যা বলে দেখানো হয়েছে।

জয়দেববাবু ও তার মা বিমলা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর যদি সঠিক কিনারা হয়, তাহলে বহু মূল্যবান নথি উদ্ধার হবে, এমনকি চৈতন্য মৃত্যুর রহস্যজালও উন্মোচিত হবে। তাই আমরা একটু খননকাজ চালিয়ে দেখি, জয়দেববাবু কে? কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছিল, তা নিয়ে সরকারি তদন্তই বা কতটুকু এগিয়েছিল।

দুই

১৯৯৬ সালে কলকাতায় জয়েদেববাবুকে নিয়ে একটি তদন্তমূলক নাটক দেখি। তার আগে একটি গল্প পড়ি। কোথাও স্পষ্ট করে কিছু বলা ছিল না। কিন্ত ইঙ্গিত ছিল।

১৯৯৫ সালের কাগজগুলো উল্টেপাল্টে দেখি। দু-চার লাইনের একটা খবর বেরিয়েছিল বটে – ‘পুরীতে বাঙালি গবেষকের রহস্যময় মৃত্যু। পুরীর আনন্দময়ী মার আশ্রমে এক বাঙালি গবেষক ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায় ও তার মা বিমলা মুখোপাধ্যায়কে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। স্থানীয় মানুষের ধারনা এটা খুন। পুলিস তদন্তের কাজ শুরু করেছে’ ।

অতঃপর সংবাদমাধ্যম নীরব। কোনও ফলোআপ স্টোরি নেই। অথচ এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। সন্দেহ গভীর হল। এটা যে কোন চক্রের কাজ তাতে আর কোন কিন্ত নেই।

প্রথমেই চৈতন্যের মৃত্যুরহস্য নিয়ে পড়া শুরু করলাম। সাম্প্রতিককালের সব গবেষকের লেখাতেই উঠে এল একটি নাম। জয়দেব মুখোপাধ্যায়। তিনিই নাকি পারেন মুশকিল আসান করতে।

হাতে এল একটি বই। জয়দেববাবুর লেখা ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’। উপন্যাসের আঙ্গিকে লেখা চৈতন্যের সমাধির খোঁজে একটি তদন্তমূলক গ্রন্থের প্রথম খণ্ড। চৈতন্যের সমাধি কোথায় হয়েছিল এখনও পর্যন্ত তা অজ্ঞাত। গ্রন্থের শুরুতে জয়দেববাবু লিখেছেন, পুরীর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কর্মসচিব স্বামী অভিনবানন্দজি এক পত্র লিখে তাকে জানিয়েছেন যে, তার সুনিশ্চিত ধারনা, মহাপ্রভুর দেহটিকে মনিকোঠার রত্নবেদীর নিম্নেই সমাহিত করা হয়েছিল। একই কথা বলেছেন ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন, যিনি প্রথম স্পষ্ট করে বলেছিলেন পুরীর মন্দিরের ভেতর চৈতন্যকে খুন করে পুঁতে ফেলা হয়েছে। ‘Chaitanya and His Age’  গ্রন্থে লিখেছেন,

‘This they did to make time for burying him within the temple. If he left the world at 4 pm, the doors, windows were kept closed till 11 pm.  This was taken for burying him and repairing the floor after burial. The priest at 11 pm opened the gate and gave out that Chaitanya was incorporated with the image of Jagannath.’

একই কথা জানা যায় হালে আবিষ্কৃত প্রত্যক্ষদর্শী বৈষ্ণব দাসের পুঁথি ‘চৈতন্য চকড়া’  থেকে। ‘রাত্রি দশ দণ্ডে চন্দন বিজয় যখন হল, তখন পড়িলা প্রভুর অঙ্গ স্তম্ভ পছ আড়ে’। দশ দন্ড মানে রাত এগারোটায় তিনি গড়ুর স্তম্ভের কাছে চৈতন্যের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছিলেন।

কাঁহা গেলে তোমা পাই এর প্রধান চরিত্র আনন্দ (জয়দেববাবু)। উপন্যাসের মাঝামাঝি জায়গায় আনন্দকে প্রভুজি বলেছেন, চৈতন্য মৃত্যু রহস্যের কিনারা, তার সমাধির খোঁজ করতে গেলে এই পুরীতেই খুঁজতে হবে। যেখানে চৈতন্য জীবনের শেষ এবং মূল্যবান ১৮ বছর কাটিয়েছেন। ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুরীতে আসেন। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। মাঝে কয়েকটা বছর দাক্ষিণাত্যে কাটিয়েছেন মাত্র।

সমসাময়িক চরিতকারদের সাহায্য নিয়ে সুকুমার সেন ‘চৈতন্যাবদান’ গ্রন্থের শেষে লিখলেন, ‘দিব্যোন্মাদের সময় তার চিত্তকে সুস্থতায় ফিরিয়ে আনতেন, শেষ বয়সে তার দুই প্রধান সহচর – রামানন্দ রায় ও স্বরুপ দামোদর। দিব্যোন্মাদের চরম অবস্থায় কোনরকম বাহ্যজ্ঞান থাকত না। তাকে রাত্রিকালে রক্ষা করতে সঙ্গীদের প্রায়ই সারা রাত্রি জেগে থাকতে হত।’

১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন চৈতন্য গান গাইতে গাইতে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকেছিলেন। সেই প্রথম আর শেষ মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের দরজা বন্ধ ছিল। তারপর চৈতন্যকে আর পাওয়া যায় না। এই ব্যাপারে বেশিরভাগ চরিতকার একমত।

সেই সময় স্বরুপ দামোদর ভেতরে ছিলেন। তাকেও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং উধাও হয়ে যায় তার লেখা পুঁথি চকড়া বা কড়চা।

জয়দেববাবু বলতেন স্বরুপ দামদরের সেই নিখোঁজ পুথিটি তিনি আবিষ্কার করেছেন। শুধু তাই নয় তার সময়ের আরও বহু খ্যাত অখ্যাত বাঙালি ও ওড়িয়া লেখকের পুঁথি তিনি পেয়েছেন। তার জোরালো দাবী ছিল, আর কিছুদিনের মধ্যে তিনি প্রমান করে দেবেন চৈতন্য খুন হয়েছিল কোথায়, কখন , কীভাবে। এই সবই পাওয়া যাবে ‘কঁহা গেলে তোমা পাই’ এর দ্বিতীয় খণ্ডে। প্রথম খণ্ডের শেষ দিকে প্রভুজির ভ্রাতুষ্পুত্রী বিদুষী মাধবী আনন্দকে বলেছেন, ‘সে জায়গাটা আমিই দেখিয়ে দিতে পারি তোমাকে, যদি অবশ্য একটি শর্ত রক্ষা করতে রাজী হও তুমি’ ।

কথা হচ্ছে টোটো গোপীনাথ মন্দিরের সামনে কাঁঠাল গাছের মত দেখতে পলাং গাছের ছায়ায়। তার মানে কি টোটো গোপীনাথের মন্দিরেই চৈতন্য সমাধিস্থ? শোনা যায় টোটো গোপীনাথের দেওয়ালে এক সময় মানুষ মাথা খুঁটত। বিশ্বাস ছিল চৈতন্যের কঙ্কাল সেখানে পোঁতা আছে। বছর পঞ্চাশ আগে প্রবাসীতেও এরকম একটা খবর বেরিয়েছিল। তাছাড়া বিশিষ্ট ওড়িয়া পণ্ডিত সদাশিব রঘুশর্মার স্থির বিশ্বাস, টোটো গোপীনাথ মন্দিরের উঠোনে যে দুটি তুলসী মন্দির আছে, তার অপেক্ষাকৃত প্রাচীন মন্দিরের নিচে চৈতন্যকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। ‘কঁহা গেলে তোমা পাই’ এর শেষে দেখেছি, প্রভুজি আনন্দকে চিঠি দিয়েছেন, ‘আর মাত্র দশদিন’। রাজমহেশ্বরী থেকে ফিরলেই সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে। রাজমহেশ্বরী পুরীর কাছেই তৎকালীন একটি প্রদেশ, যার শাসক ছিলেন চৈতন্যভক্ত রায় রামানন্দ।

এই দশদিন আর শেষ হয়নি। দ্বিতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের ঘরে পৌঁছানর আগেই জয়দেববাবুর মৃত্যু হয়।

তিন

পুরীর স্বর্গদ্বার, চৈতন্য চক বা চৈতন্য মোড়। পাঁচশো বছর বাদে পুরীতে প্রথম চৈতন্যমূর্তি স্থাপিত হয় জয়দেববাবুর উদ্যোগেই। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি জৈল সিং এবং কেন্দ্রীয় মানবাধিক কমিশনের চেয়ারম্যান  রঙ্গনাথ মিশ্র। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জয়দেববাবু বলেছিলেন, ‘যে কারণে মহাপ্রভু অন্তর্ধানের পর পঞ্চাশটি বছর উৎকল এবং বঙ্গের বৈষ্ণবমণ্ডলী নিদারুন আতঙ্কে স্তব্ধ করে রেখেছিল নিজেদের পরমপ্রিয় নাম সংকীর্তনকে, ঠিক সেই কারনেই চৈতন্যদেবের উপর লেখা প্রায় সমস্ত গ্রন্থেই ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছে চৈতন্য তিরোধানের শেষ মুহূর্তের দৃশ্য বর্ণনাকে’

স্বর্গদ্বারের ডানদিকে শ্মাশান ছাড়িয়ে আরো কিছুদূর গেলে, মীনাক্ষী হোটেল, তার পাশে ট্রাভেলিং এজেন্ট কার্তিক দাসের দপ্তর। পাশে একটা সরু গলি সমুদ্রের দিকে নেমে গেছে। গলির শেষে আনন্দময়ীর আশ্রম বাড়ি। কিন্ত গলির মাঝামাঝি গেলেই ডান হাতে ছোট দরজা। দরজা দিয়ে ঢুকলেই উঠোন। বাঁদিকে বিশাল আশ্রমবাড়ি। ডানদিকে দুটো ঘর, বারান্দা, চাতাল। চাতালের একদিকে দুটো অগভীর চৌবাচ্চা।

… ঐ চৌবাচ্চার মধ্যেই দাদুর দেহটা পড়েছিল। ভেতরে মাথা, বাইরে পা। ভেতরে আধ চৌবাচ্চা জল। মাথাটা পুরো জলে ডোবা ছিল’। অনন্দময়ী আশ্রমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন কার্তিক দাস। ‘এখানে সবাই জয়দেববাবুকে দাদু বলে ডাকত, যার যা বিপদ, যার যা সমস্যা – সব ব্যাপারেই দাদুর কাছে আসত। কত বেকার ছেলেকে দাদু চাকরি জুটিয়ে দিত, ব্যবসার জন্য ব্যাঙ্ক লোনের ব্যবস্থা করে দিত, গরিব মেয়ের বিয়েতে সাহায্য করত।  দাদু রাস্তা দিয়ে হাঁটলে ভিড় জমে যেত। কত নামীদামী লোক দেখা করতে আসত’

‘কি যেন একটা বই লিখছিলেন দাদু। চিঠিতে টেলিগ্রামে হুমকি দিত। পুলিসকেও জানিয়েছিল দাদু। ভয় পেত না দাদু। বলত এত মানুষ ভালোবাসে, গুণ্ডারা মেরে গেলেই হল’ !

‘সেদিন, কালুর মাকে চেনেন তো, নীলমণি প্রধান, ওর মেয়ে দাদুর ঘরদোর পরিষ্কার করে দিত। রান্না করে দিত। সকালে এসে দেখছে, দরজা বন্ধ। ধাক্কালেও খুলছে না। দাদু তো অনেক সকালে ওঠে’।

‘মেয়েটি কালুর মাকে , আমাকে ডেকে আনে’।

‘পাঁচিলে উঠে দেখি ঐ দৃশ্য। মাথা চৌবাচ্চায়, পা বাইরে, হাত দুটো পিছন দিকে দড়ি দিয়ে বাঁধা। ঘরের দরজা খোলা। খাটের তলায় মেঝেতে দাদুর মা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মুখ দিয়ে গাঁজলা বেরোচ্ছে’।

‘লাফিয়ে নামলাম। আরও অনেকে এল। তখনও জ্ঞান আছে দাদুর মার। ঘরের মধ্যে ঘুমের ওষুধের ছেঁড়া রাংতা। ইংরেজিতে লেখা দুটো সুইসাইড নোট। আর প্রচুর বই , প্রাচীন পুঁথি – সব লন্ডভণ্ড করা’।

কার্তিকবাবুর সাথে আনন্দময়ী আশ্রমে দাঁড়িয়ে এসব কথা হচ্ছিল। জয়দেববাবুর মৃত্যুর দেড় বছর বাদে। ১৯৯৬ সালের ২৮ অক্টোবর।

গলির মুখে একটা পানের দোকান। নীলমনির স্বামীপরিত্যক্তা কন্যার দোকান। নীলমণির সাথে কথা হচ্ছিল, ‘জয়দেববাবুই দোকান করতে সাহায্য করেছেন। বেঁচে থাকতে রোজ কত মানুষ আসত। রাজীব গান্ধীকেও দেখেছি আসত! সেই মানুষটিকে যখন দাহ করতে আনল, ভয়ে কেউ শ্মশানে গেল না! পুলিশ দাহ করে দিয়ে চলে গেল। আর ঘরের সব বইপত্র নিয়ে কোথায় গেল, কে জানে! বলতেন মহাপ্রভুর শেষটা বড় কষ্টের। কারা কষ্ট দিয়েছিল, তাদের নাম ফাঁস করে দেব। সব পুঁথি পেয়েছি। পুজোর সময় গরীবদের কাপড় দিতেন  প্রসাদ খাওয়াতেন। কোত্থেকে টাকা পেতেন, কে জানে’!

১৭ এপ্রিল মারা যান জয়দেববাবু। তার মা বিমলাদেবী মারা যান তিনদিন পর ২০ এপ্রিল। এই তিনদিনে কি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা হয়েছিল? তার কাছ থেকে তো অনেক কিছু জানা যেত!

‘বাঁচানো ? দাদুর মাকে মেরে ফেলা হয়’, বললেন কার্তিকবাবু। ‘পুরী হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রেখেছিল। এখানকার লোকেরা চেঁচামেচি করায় তাকে কটক মেডিকেল কলেজে সরিয়ে দেওয়া হয়, কী না, সেখানে ভাল চিকিৎসা হবে’।

চার

‘আনন্দময়ী আশ্রমের তপন মহারাজ বললেন, জয়দেব মুখোপাধ্যায় খুন হয়েছিলেন। খুন হওয়ার দিনই আগরতলা, হরিদ্বার, উত্তর কাশী, কংখল – সব আশ্রমেই খবর গেছিল। আশ্চর্য, কেউ আর যোগাযোগ করেনি।’

তপন মহারাজ অরফে গোপালানন্দ ওরফে তপন ব্যানার্জি। কলকাতার বরানগরের ছেলে। অনাথ। সাধুসঙ্গে পড়ে আনন্দময়ী মার শিষ্য। উত্তর কাশীর আশ্রম তিনিই দাঁড় করিয়েছেন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পুরীর আশ্রমের দায়িত্বে তিনি। সংস্কারের কাজ চলছে। জয়দেববাবুর ঘর দুটো বন্ধ।

তপন মহারাজ বললেন, আমাকে এখানে আসার আগে বলা হয়েছে, ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না। অথচ ১৯৭৫ সাল থেকে জয়দেববাবু এই আশ্রমের দায়িত্বে। আমাকে বলা হয়েছে তিনি শিষ্য ছিলেন না। অথচ এই আশ্রমের দায়িত্বে তিনিই ছিলেন। এবং সেটা মার নির্দেশে।

১৯৯৬ সালের ২৯ অক্টোবর। তখন দুপুর। কথা বলতে বলতে তপন মহারাজ দরজা বন্ধ করে দিয়ে এলেন। বললেন ১৯৮২ সালে মা এখানে আসেন। মা ওনাকে স্নেহ করতেন। জানতেন উনি পণ্ডিত, ভাষাবিদ। ওনার গবেষণার বিষয় চৈতন্যের অন্তর্ধান। মা কিন্ত নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘যা বলছ, তা হয়তো ঠিক। কিন্ত মনে হচ্ছে বিপদে পড়বে। এতদিন যখন কেউ কিছু করেনি, তুমি একা কেন বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছ?’

এসব শোনার পর কংখলে ফোন করি। স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয় যে জয়দেববাবু আশ্রমের কেউ ছিলেন না।

আশ্রমের কেউ নন অথচ ২০ বছর ধরে আশ্রমের সেক্রেটারি! সাগর তীরে আশ্রমের জমি পাণ্ডারা দখল করবে বলে লড়াই করছেন?

বালানন্দ তীর্থাশ্রম। ভারপ্রাপ্ত কর্তার নাম গোকুলানন্দ। দেওঘরে ছিলেন। কংখলে আনন্দময়ী মাকে দেখেছেন। ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা, ওড়িয়া ভালো বলেন। পুরীতে এর আগে বছর কয়েক থেকে গেছেন। ফের এসেছেন ১৯৯৫ সালের এপ্রিলেই। জয়দেববাবুর প্রসঙ্গ তুলতেই – ‘ও সেই ভদ্রলোক! শুনেছি বটে চৈতন্য নিয়ে কি সব কাজ করছিলেন। ছেলেবেলায় শুনেছি, সমুদ্রের জলে মিলিয়ে গেছেন। আত্মহত্যা। বড় হয়ে নতুন করে জানলাম পাণ্ডারা খুন করেছিল। আমরা ধর্মকর্ম নিয়ে থাকি। এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। জয়দেববাবু তো গৃহী ছিলেন। দুর্ঘটনায় মারা গেছেন’।

দুটো আশ্রমের মধ্যে দূরত্ব দশ মিনিটের হাঁটা পথ। যা নিয়ে সে সময়ে পুরী তোলপাড়, তা নিয়ে গোকুলানন্দের নিরাসক্ত এবং ‘গৃহী’ মন্তব্যটির মধ্যে যে খোঁচা, তা গভীর চক্রান্ত এবং পরিকল্পিত খুনের ইঙ্গিত দেয় নাকি?

পাঁচ

জয়দেববাবু কলকাতার ভোলানাথ প্রকাশনীর সুরেশ দাস’কে লেখা শেষ চিঠিতে কিছুদিন ধৈর্য ধরার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তথ্যসূত্র – ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে (দ্বিতীয় খণ্ড)।

ঝাড়গ্রামে গিয়ে দেখা করি ঝাড়গ্রাম বার্তার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র ভকতের সাথে। মায়ের শিষ্য। আনন্দময়ী মায়ের কথাতেই ‘কঁহা গেলে তোমা পাই’ ছেপেছেন। বললেন ‘জয়দেববাবু একবার এখানে অজ্ঞাতবাসে ছিলেন। সঙ্গে মা বিমলা। বেনারসের পাথু মহারাজ বলেছেন, ওনাকে খুন করা হয়েছে চৈতন্য গবেষণার জন্যই। সুরেশ তুমি আর পুরীতে যেও না’। ছেলে চিত্তরঞ্জনের টাটা কলেজে পড়ে। গেছিল পুরীতে। তখন জয়দেববাবু মারা গেছেন। ভারত সেবাশ্রমের মহারাজ চিত্তকে বলেছিল বাবা যেন এদিকে না আসে।

সুরেশবাবু বললেন, অনেক প্রাচীন পুঁথি আর দ্বিতীয় খণ্ড বইয়ের পাণ্ডুলিপি মে মাসেই আমাকে দেবেন বলেছিলেন। বলতেন গৌরস্তম্ভের তলায় চৈতন্যকে পুঁতে ফেলেছিল। অনেকেই ওনাকে উৎসাহ দিতেন। বেনারসে, কংখলে, ত্রিগুনা সেন, হরেকৃষ্ণ মহতাব আর রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজেরা তাকে উৎসাহ দিতেন।

শুনেছি জয়দেববাবুরা ঢাকার লোক। বাবা সি আই এস ছিলেন। নিজে কেন্দ্রীয় তথ্য দপ্তরে ছিলেন। বলতেন, দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের পর সব পরিচয় জানিয়ে দেব।

অজ্ঞাতবাসের সময় ঝাড়গ্রামে সরস্বতী বৈজনাথ কেডিয়া স্কুলে থাকতেন। লালজলের কাছে জঙ্গলের কাছে একটি আশ্রমেও যেতেন।

‘লালজল, জঙ্গলের মধ্যে এক দুর্গম আশ্রম। আদিবাসীরা আমাকে বলেছিল, এক সাধুবাবা বাগালদের প্রশ্ন করতেন, এইরকম কোন পাথর দেখেছ?  কোন পাথরের কোনও চিহ্ন দেখেছ’?

শোনা যায় চৈতন্য এদিকে এসেছিলেন এবং পাথরের গায়ে নানারকম খোদিত চিহ্নও দেখা যায়। জয়দেববাবু ঝাড়গ্রামে কতটা কি পেয়েছিলেন জানা যায়নি। তবে সুরেশবাবুর কথায় এটা স্পষ্ট জয়দেববাবু যে খুন হয়েছেন, ভারত সেবাশ্রমের মহারাজ সেটা টের পেয়েছেন। আর পুরীতে গেলে গুরুত্বপূর্ণ নথি ও পাণ্ডুলিপির জন্য সুরেশবাবুকেও খুন করতে পারে তারা !

ছয়

সার্কিট হাউসে উঠেছিলাম। সেখান থেকে কোনওদিন কটকে যাই ডিআইজি ক্রাইমের সাথে কথা বলতে, কোনওদিন পুরীর এসপি। একদিন সার্কিট হাউসে ফিরে দেখি একজন পুলিস অফিসার আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন। বললেন একটা বড় ভালো কাজে হাত দিয়েছেন। ঠিক পথেই এগোচ্ছেন। কলকাতার সিবিআই এর এসপি (স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চ) লোকনাথ বেহরার সাথে কথা বলুন। ওর মা ক্ষুব্ধ। জয়দেববাবুর ভক্ত ছিলেন। এখানকার পুলিস আত্মহত্যা বলে চালাচ্ছে। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে যান। পরে সঙ্গে লোক নিয়ে আসবেন। একা ঘুরবেন না।

পরদিন কটকে গিয়েই বুঝলাম, অজ্ঞাত পরিচয় পুলিস অফিসারটি ঠিক বলেছেন। আই জি ক্রাইম যিনি ঘটনার সময় পুলিসের এসপি ছিলেন, একজন ইন্সপেক্টরকে ডাকলেন। তিনি আমার প্রশ্ন না শুনেই বললেন, ওটা তো আত্মহত্যা। ডিসেম্বরে ফাইল ক্লোজ করে দেওয়া হয়েছে।

– আত্মহত্যা কেন করবে?

-টাকার অভাব। পাস বইয়ে দেখলাম, টাকা তেমন ছিল না। তাছাড়া ঐ ভদ্রমহিলার সঙ্গে তো অবৈধ …

-আত্মহত্যা যিনি করেছেন তার হাত পিছন থেকে বাঁধা!

১৯৯৬ সালের অক্টোবরে যিনি আই জি ক্রাইম ছিলেন তিনি এবার বেশ ক্ষুব্ধ! ‘আপনার এ নিয়ে এত মাথাব্যাথা কেন? ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর রত্নাকর দাস বডি দেখে এটাকে আত্মহত্যা বলেছেন। কয়েক বস্তা বই, পুঁথি , রঙ্গনাথ মিশ্রকে লেখা চিঠি পেয়েছি ; দেখি কি করা যায়’।

কটক মেডিকেল কলেজের ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ ডঃ রত্নাকর দাস বললেন, ‘দেহ আমি দেখিনি। কয়েকটা ছবি আমাকে দেখানো হয়েছিল। আত্মহত্যা আমি বলিনি। আমি এখানে থাকি। চাকরি করি । যা বলার তাই বলেছি’। 

সাত

ধরে নিলাম, বিমলাদেবী জয়দেববাবুর মা নন। ধরে নিলাম, পিছন দিকে হাত বেঁধে, ঘুমের ওষুধ খেয়ে মুণ্ডিতমস্তক সন্ন্যাসী জয়দেববাবু চৌবাচ্চার জলে মাথা ডুবিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কিন্ত সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এবং কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রঙ্গনাথ মিশ্র এবং রাষ্ট্রপতিকে লেখা চিঠি, ২৫ বছরের পরিশ্রমে আবিষ্কৃত দুর্লভ পুঁথি, জয়দেববাবুর পাণ্ডুলিপি হজম করার অধিকার পুলিসকে কে দিল?

১৯৭৬ সালের ৫ই আগস্ট জয়দেববাবুকে লেখা ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের চিঠিতে আছে,

‘চৈতন্যদেবকে গুম খুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং চৈতন্যদেবের দেহের কোন অবশেষের চিহ্নও রাখা হয়নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটে কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল। …এই বয়সে শহীদ হবার ইচ্ছে নেই বলেই বলতে পারবো না ঠিক কোথায় চৈতন্যকে খুন করা হয়েছিল’।

আর তা বলতে গিয়েই শেষ পর্যন্ত জয়দেববাবু জীবন দিলেন। ১৫৩৩ সালে চৈতন্য, ১৯৯৫ সালে জয়দেব। এর কোনও প্রতিকার নেই? পৃথিবী কি একবিন্দু এগোয়নি?


উপরের আর্টিকেলটার সমস্ত স্বত্বাধীকারি হল আজকাল পত্রিকা এবং লেখক তথা অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক অরুপ বসু। ‘লেখা ডট টুডে’ কোনভাবেই এই লেখার কোনরকম স্বত্ব দাবী করেনা। জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু সম্পর্কিত একমাত্র প্রামাণ্য লেখা এবং মূল সোর্স হিসেবে, কুড়ি বছর আগে প্রকাশিত শারদীয় আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এই লেখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক দলিল। অরুপ বসুই একমাত্র সাংবাদিক যিনি সেসময় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে খোদ পুরীতে গিয়ে ঘটনাটা কভার করেছিলেন, যার জন্য তাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।  


ঋণস্বীকারঃ স্থাপত্য

Series Navigationজয়দেব মুখোপাধ্যায়: চৈতন্য গবেষকের মৃত্যুরহস্য- পর্ব ২ >>

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?

লেখক পরিচয় |

Start typing and press Enter to search