মৃত্যু মুহূর্ত- পর্ব চার
- মৃত্যু মুহূর্ত- পর্ব এক
- মৃত্যু মুহূর্ত- পর্ব দুই
- মৃত্যু মুহূর্ত- পর্ব তিন
- মৃত্যু মুহূর্ত- পর্ব চার
অনুরাগের একেবারেই বিপরীত অবস্থান যদিও বিরাগ ও বীতরাগের। শেষ ইচ্ছাপত্রে তার নিদর্শনও বড় কম নয়। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির এক ধনী জমিদার ফ্রান্সিস তাঁর স্ত্রীর জন্য রেখে গিয়েছিলেন মাত্র ১ শিলিং! ভারতীয় টাকায় এখনকার বিনিময়-মূল্যে যা ৪ টাকারও কম। তার থেকেও বড় কথা, শেষ ইচ্ছাপত্রে এই আণুবীক্ষণিক অর্থ দানের কারণও উল্লেখ করে গিয়েছেন তিনি এক ঘৃণিত ভাষ্যে, ‘‘ট্রামভাড়া বাবদ এটি দিলাম, যাতে এই রাহাখরচ দিয়ে কোথাও গিয়ে ও ডুবে মরতে পারে!’’
আদালত কোনও ভাবেই মান্যতা দিতে পারেনি এমন ইচ্ছাপত্রেরও নজির আছে।
১৯৩৪-এ দক্ষিণ আফ্রিকার সমুদ্রতীরে একটি মুখবন্ধ বোতল ভেসে এসেছিল। যা খুলে জানা যায়, জাহাজডুবির পর ঢেউয়ের মাথায় চেপে অজানা কোনও খাদ্য-পানীয়হীন দ্বীপে পৌঁছনো এক নাবিক ফিলিপ সেগ্রানডেজ মৃত্যু আসন্ন জেনেই গাছের ছালের ওপর নিজের রক্ত দিয়ে এক শেষ ইচ্ছাপত্র লিখে, ওই বোতলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।
সেই ইচ্ছাপত্রে সেগ্রানডেজ স্পেনের লিসবন শহরের প্রান্তে থাকা ওঁর একমাত্র বসতবাড়িটিকে কয়েক জন নিকটাত্মীয়ের মধ্যে ভাগ করে দিতে চেয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, স্পেনীয় কর্তৃপক্ষের কাছে বোতলটি নিয়মমাফিক পৌঁছে দেওয়া হলেও তাঁরা কিছু করতে পারেননি।
কেননা ইচ্ছাপত্রটি ছিল ১৭৮ বছর আগের!
মহাসমাধির আগে
‘ধর্মতত্ত্ব’ পত্রিকার ৩১ অগস্ট ১৮৮৬ সংখ্যার ঘোষণা অনুসারে: মহাসমাধি লাভের মুহূর্তটিতে পরমহংস তিন বার ‘কালী’ নাম উচ্চারণ করেছিলেন। একই কথার সমর্থন পাওয়া যায় ঠাকুরের স্নেহধন্য কবি অক্ষয়কুমার সেনের ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-পুঁথি’ গ্রন্থেও: ‘আজি পূর্ণকণ্ঠে নাহি বিয়াধি যেমন/তিনবার কালী কালী কৈলা উচ্চারণ।’ যদিও স্বামী বিবেকানন্দের মতে (বাণী ও রচনা, ৮/ পৃ: ৩৯০) তিনি ‘ওঁ’ উচ্চারণ করতে করতেই মহাসমাধিস্থ হয়েছিলেন।
ভগবানকে দিয়ে গেছেন সব সম্পত্তি
অন্তিম লিপি যে শুধু পুরুষেরাই লিখে গেছেন, তা নয়। বরং নারীরাও যথেষ্টই লিখেছেন। এবং যথোপযুক্ত রসেবশেই লিখেছেন। তার মধ্যে দু’টিকে দেখা যাক।
ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূল ঘেঁষা বোর্নমাউথ শহরের এক সুরসিকা মহিলা ব্রিজেট ফিলিসন ১৯৩৮-এ শেষযাত্রায় ভেসে যাওয়ার আগের দিন এক বিচিত্র ইচ্ছাপত্র লিখে যান।
তাতে তিনি তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তিকে দু’ভাগ করে এক ভাগ দিয়ে যান স্বামীকে, আর এক ভাগ দেন নিজের বোনকে। তবে সবটাই একটি শর্তাধীনে। তা হল, স্বামীর অংশের অধিকারপত্রটি তিনি সরাসরি পাবেন না। পাবেন ব্রিজেটের বোনের মারফত। এবং তাও কীভাবে?
ইচ্ছাপত্রে ব্রিজেট বোনকে তারও স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন—‘‘আমাদের বাড়ির কাছেই যে ‘পাব’-টা রয়েছে, সেখানে গিয়েই ওর হাতে কাগজগুলো সব তুলে দেবে। আমার দুঃখ ভুলতে ও যে ঠিক ওখানে বসেই মদ খাবে, তা আমার বিলক্ষণ জানা আছে!’’
তবে সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে হাসির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা প্রদেশের চেরোকি কাউন্টির এক বিপুল ধনী মহিলার শেষ ইচ্ছাপত্রকে আইনি মান্যতা দেওয়ার সময়। আসলে একটু খ্যাপাটে ধরনের নিঃসঙ্গ ওই মহিলার মৃত্যুর পর ওঁর লেখা যে-ইচ্ছাপত্রটি পাওয়া গিয়েছিল, তাতে দেখা যায়—ওঁর সমস্ত সম্পত্তিই উনি ‘ভগবানকে’ দিয়ে গিয়েছেন!
ফলে, তাঁর উইলটি যখন নর্থ ক্যারোলিনার আদালতে পৌঁছয়, মহামান্য বিচারপতি এই সমস্যার কোনও কূলকিনারা করতে না পেরে শেষে চেরোকি কাউন্টির শেরিফকে ডেকে ওই সম্পত্তি-প্রাপককে ‘সমন দেওয়ার’ হুকুম দেন।
যথারীতি দিন সাতেক বাদে শেরিফ ভদ্রলোক সে বিষয়ে একটি রিপোর্টও জমা দেন আদালতে।
তা এই যে—‘‘দায়িত্ব সহকারে এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান চালিয়েও গোটা চেরোকি কাউন্টির কোথাও ভগবানকে পাওয়া যায়নি।’’
নিষ্পলক চোখে জল শুধু
যত মন, তত বেশি পৃথক মনন। শেষ কথার ভাণ্ডারও ততই বিচিত্র।
এলভিস প্রেসলির ‘বই পড়তে যাচ্ছি’, ফ্র্যাংক সিনাত্রার ‘সব হারিয়ে ফেলছি’, নবোকভের ‘বড় অদ্ভুত আর আলাদা রকমের একটা প্রজাপতি উড়ছে’ কিংবা থমাস এডিসনের ‘কী অপূর্ব সুন্দর ওই দিকটা’র পাশেই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘একটিও সার্থক কাজ করে যেতে পারলাম না মানুষের জন্য’ অথবা কার্ল মার্ক্সের ‘শুধু বোকারাই শেষ কথা বলে যেতে চায়’ শুনলে মনে হয়, কী সীমাহীন পার্থক্য একেক জনের চিন্তার বা দর্শনের!
যাঁরা বিদায়কালে কথা বলতে বা লিখে জানাতেও পারেন না তাঁদের দলটিও কম ওজনদার নয়। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেমন। শেষ মুহূর্তে যে-দেওয়ালে ওঁর মায়ের ছবি টাঙানো, হঠাৎ সেই দিকে ঘুরে গিয়ে নিষ্পলক চোখে ছবিটির দিকেই চেয়ে ছিলেন। এর পর আমৃত্যু ওঁর চোখ থেকে অবিরল অশ্রু বয়ে গেছে।
ঋণ: ‘আমাদের নিবেদিতা’ (শঙ্করীপ্রসাদ বসু), ‘Stranger Than Science’ (Frank Edwards), ‘ভগবান বুদ্ধ’ (বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী), ‘বঙ্কিমচন্দ্রজীবনী’ (অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য), ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’ (ইন্দ্রমিত্র), ‘Mohammed Rafi: Golden Voice of the Silver Screen’ (Sujata Dev) ও তথাগতর অন্তিম ভাষ্যের উচ্চারণ-সহায়তা: নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, ‘শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা’ (স্বামী প্রভানন্দ), ‘শ্রীমা সারদা দেবী’ (স্বামী গম্ভীরানন্দ), ‘পরম পিতা শ্রীশ্রী বাবা লোকনাথ’ (অঞ্জনকুমার রায়), ‘ভারতের সাধক’ (শঙ্করনাথ রায়)