সব মায়া
আপনি উঠছেন, বসছেন, দৌড়চ্ছেন। সকাল সাড়ে ন’টায় ব্যাগ কাঁধে করে অফিসে ছুটছেন। কাজ করছেন, কাজের ফাঁকে সুন্দরী কলিগের সঙ্গে মেসেজ চালাচালি করছেন। সব নিজের ইচ্ছেতেই করছেন।
নাকি, আপনি মনে করছেন নিজের ইচ্ছেয় করছেন, আসলে পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে অদৃশ্য হাত! সেই যে ‘ম্যাট্রিক্স’ সিনেমায় যেমন দেখা গিয়েছিল, আসল শরীর অন্য জায়গায় থেকে এক ‘সিমুলেটেড’ দুনিয়ায় ঘোরাফেরা করছে নিও। আমাদের দুনিয়াও কি একটা সিমুলেশন হতে পারে?
কয়েকজন উৎসাহী বিজ্ঞানী সেই ভাবনায় হাওয়া দিতে পিছপা নন একেবারেই। তালিকায় আছেন এমআইটি বা নাসা-র বিজ্ঞানীও। যাঁরা মনে করেন, আমাদের পৃথিবীতে দিন কাটানোটা একটা সিমুলেশন। পুরো ব্যাপারটাই একটা কৃত্রিম জগৎ। যেখানে আমাদের ‘ক্যারেক্টার’ তৈরি হয়েছে গেমের আদলে। আমরা যা করছি সেগুলো আসলে গেমের ক্যারেক্টারের জন্য ‘অ্যাসাইনমেন্ট’।
একটা বিখ্যাত মাল্টিপ্লেয়ার গেম খুব জনপ্রিয়— ‘ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ারক্র্যাফ্ট’। যে গেমের একটা নিজস্ব দুনিয়া আছে। সেখানে গেমাররা এক বা একাধিক ‘ক্যারেক্টার’ তৈরি করেন। তার নাম দেন। সেই ক্যারেক্টারের লেভেল শুরুতে এক থাকে। বিভিন্ন ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ সম্পূর্ণ করতে হয়। ‘প্রোফেশন’ শেখাতে হয়। ধীরে ধীরে লেভেল বাড়তে থাকে। যে দুনিয়ায় গেমটি খেলা হচ্ছে, সেখানে নানা উপায়ে ট্র্যাভেল করা যায় এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে। ম্যাপে দেখে নেওয়া যায় অবস্থান।
আমাদের পৃথিবী ওই রকম ধাঁচের, কিন্তু আরও আধুনিক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমন্বিত কোনও ‘গেম’ নয় তো?
সিমুলেশন হাইপোথিসিস নামে ডাকা হয় এই মতবাদকে। টেসলা, স্পেস এক্স-এর মতো সংস্থার সিইও, বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি এলন মাস্ক বছর তিনেক আগে দাবি করেছিলেন, ‘আমরা হয়তো সিমুলেশনে বাস করছি’। এ রকম মতবাদে বিশ্বাস করেন অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট নীল ডি গ্রাস টাইসন, যাঁকে ডিসকভারি চ্যানেলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যায়।
তাঁদের এই ধারণার ভিত্তি কী? আসল কাণ্ডটা ঘটিয়েছিলেন নিক বস্ট্রম। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির দর্শনের এই অধ্যাপক ২০০৩ সালে ফিলজফিক্যাল কোয়ার্টারলি জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেই পেপারে বস্ট্রম দাবি করেন, দীর্ঘ দিন ধরে ব্রহ্মাণ্ডে কোথাও যদি অত্যাধুনিক কোনও জাতি বাস করে, তারা যদি কম্পিউটার সিমুলেশন তৈরি করে অত্যন্ত আধুনিক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কাজে লাগিয়ে, তা হলে সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বসবাসকারী ক্যারেক্টারগুলি নিজেরাও হয়তো জানবে না তারা আদতে সিমুলেশন। আমরাও হতে পারি, সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমন্বিত ক্যারেক্টার।
ব্যস! এই যুক্তিই যথেষ্ট ছিল বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বিজ্ঞানীকে নাড়িয়ে দিতে। মাস্ক বা টাইসন সে রকমই সিমুলেশনে বিশ্বাসী। এমআইটি-র বিজ্ঞানী রিজওয়ান ভির্ক বলেছেন, ‘হেডসেট লাগিয়ে ফাঁকা ঘরে বসে একটা গেম খেলছিলাম। গেমটা খেলার সময় ভুলেই গিয়েছিলাম, একটা কৃত্রিম দুনিয়ায় আছি। তখন মনে হয়, আমরাও কোনও গেমে ‘এম্বেডেড’ নয় তো? যে গেমটা তৈরি করেছে প্রযুক্তিগত ভাবে খুব এগিয়ে থাকা কোনও জাতি?’
পাসাডেনায় নাসা-র জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী রিচ টেরাইলের মন্তব্য, ‘এখনকার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানে শুধু কৃত্রিম মেধা নয়। হয়তো খুব শীঘ্রই সেন্টিয়েন্স তৈরি করা যাবে’। সেন্টিয়েন্স অর্থাৎ কি না অনুভূতি ও সংবেদনশীলতা বোঝার ক্ষমতা। যেমন আমরা বুঝতে পারি। কোনও আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন জাতি যদি আমাদের তৈরি করে থাকে, তা হলে তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সেন্টিয়েন্সও জুড়তে পেরেছে।
তবে সব বিজ্ঞানীই তো আর মানেন না এই সিমুলেশন হাইপোথিসিস। ২০১৬ সালে নিউ ইয়র্কের আমেরিকান মিউজিয়াম ও ন্যাচারাল হিস্ট্রি একটা বিতর্ক সভার আয়োজন করেছিল। সেখানে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ লিসা র্যান্ডালের মন্তব্য ছিল, ‘সিমুলেশন হাইপোথিসিস সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা আসলে শূন্য’। তাঁর প্রশ্ন, ‘প্রথমত, এখনও এ রকম প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে আমাদের বিশ্ব তারা, গ্যালাক্সি দিয়ে তৈরি নয়। আর দ্বিতীয়, কোনও অত্যাধুনিক জাতি কেন হোমো স্যাপিয়েন্সকে সিমুলেশন করবে? অনেক কিছুকেই সিমুলেশন করতে পারে। আমাদের নিয়ে মাথাব্যথা রাখবে কেন?’
নাসা-র টেরাইলের আবার যুক্তি, ‘সিমুলেশন হাইপোথিসিস সত্যি হলে, ধর্মের সত্যতাও পাওয়া যাবে। দেখা যাবে, একজন ক্রিয়েটর আছে আমাদের। যে রকমটা বলা হয় ধর্মে’।
এই যুক্তি এবং সিমুলেশন মতবাদ উড়িয়ে দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডের পদার্থবিদ সিলভেস্টার জেমস গেটস। বলেছেন, ‘এই যুক্তির জন্য সিমুলেশন হাইপোথিসিস বিজ্ঞান থেকে অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছে। বিজ্ঞান-ই দেখিয়েছিল, কোনও অদৃশ্য হাতের পরিচালনায় থাকা পুতুল আমরা নই। সিমুলেশন হাইপোথিসিসের কথাগুলো আসলে ধর্মের মতো শোনাচ্ছে’।
খণ্ডনের যুক্তি আছে। আবার সিমুলেশনের পক্ষেও যুক্তি আছে। কিন্তু কোনও পক্ষেই কি নিশ্চিত কোনও প্রমাণ আছে?