পরী- পর্ব ২
- পরী- পর্ব ১
- পরী- পর্ব ২
শরৎকাল নৃত্যকালীর সবথেকে পছন্দের ঋতু… আর সন্ধ্যাবেলা সবথেকে পছন্দের সময়… আর সাদা সবথেকে পছন্দের রং … আর … “ধূর! কি হবে লিস্টি বানিয়ে, অনন্যা দিদিমনিও যেমন, কিসব কাজ যে দেন!” ভেবেই জিভ কাটল সে। একে বয়োজ্যেষ্ঠা তায় দিদিমনি ! “হে মা সরস্বতী দেখো মা মাফ করে দিও।”, বলে একটু শান্তি পেল নৃত্যকালী সেন ওরফে নিতি। এর থেকে যদি অপছন্দের তালিকা বানাতে দিতেন অনন্যাদিদি তাহলে চট করেই হয়ে যেত। এক নম্বরে থাকত তার নিজের নামটাই। নৃত্যকালী সেন – একটা নাম হল! বন্ধুদের নামগুলো কত সুন্দর – রাজন্যা , বনানী, বিদিপ্তা … তা না নৃত্যকালী ! ইস্কুলে সবাই কি পেছনেই না লাগে! নাম নিয়েই সবাই খ্যাপায় কাশডাঙ্গা গ্রামের ভুবনসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ফার্স্ট গার্ল নৃত্যকালী সেনকে। বাবা বিকাশ সেনের কাছ থেকে সে শুনেছে তার নামটি রেখেছিলেন দাদু স্বর্গীয় কালীকিংকর সেন। ছেলের মৃদু আপত্তির মুখে মুচকি হাসি দিয়ে তিনি নাকি বলেছিলেন, ” এটাই থাক, এটাই রেখো। পরে বুঝবে।”
দাদুর কথা মনে এলেই চোখে জল আসে নিতির। তার সময় কাটত ওই দাদুর ঘরেই। বড্ড দাদু ন্যাওটা ছিল নিতি। রোজ বিকেলে নাতনিকে ডেকে নিতেন কালীকিংকর । নাতনিকে দেখাতেন পাখিদের ঘরে ফেরা।
“নিতি দেখেছিস, সাঁঝবেলায় সব পাখি যখন ঘরে ফেরে সবাই কেমন ডান দিক থেকে বাম দিকে যায়?” অবাক হয়ে দশবছরের নিতি তাকিয়েছিল তার দাদুর দিকে। “দাভাই সত্যি?!” মাথার ওপরে একঝাঁক শামুকখোল তখন বাসায় ফিরছে। অবাক হয়ে দেখে নিতি তাইতো! সব কেমন ডানদিক থেকে বাঁ দিকে ফিরছে। “ওরা সবাই কি তবে ডান দিকেই খাবার খুঁজতে যায় দাভাই? সব্বাই?” নিতির প্রশ্ন শুনে হাসেন কালীকিংকর । “তাই তো মনে হয়। ওরা সবসময় ওদের বামদিকে যায় কাজ করতে। প্রকৃতি মায়ের কোলে কত রহস্যের ভান্ডারই না আছে!!”
রোজ কিছু না কিছু শিখত নিতি তার দাদুর কাছে। ছ ফুট লম্বা মানুষটা নিতির সাথে হয়ে যেতেন তার খেলার সাথি। একটা খেলা প্রায়ই খেলতেন কালিকিংকর। পশু পাখিদের ডাক শুনে বলতে হত ওরা কি চাইছে। নিতিকে বলতেন “বলত দিদিভাই ওই কুকুরটা ওভাবে ডাকছে কেন?” অথবা “বলত’ ওই পাখিটা কাকে ডাকছে?” নিতি আন্দাজে বলত, কখনও ঠিক হত কখনও ভুল। কিন্তু অবাক হয়ে দেখত নিতি, কালীকিংকর কখনও ভুল বলতেন না। নিতি জিজ্ঞেস করত, “কি করে বুঝছ দাভাই ওরা কি চাইছে, কি বলছে?” হাসতেন কালীকিংকর, বলতেন, “শিখতে হয় দিদিভাই। এই চরাচরে সব কিছু, যা দেখা যায় অথবা যায় না, প্রতিটি পদার্থ, জড় অথবা জীবন্ত – কথা বলে। তোমাকে শুধু তাদের ভাষাটা শিখে নিতে হবে, ব্যস।” শিখতেই তো চেয়েছিল নিতি।
কালীকিংকর এর ঘর ছিল নিতির সবথেকে প্রিয় জায়গা। ঘরে ঢুকলেই একটা কেমন কর্পূর আর গুঁড়ো ধূপের অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ। বিরাট বড় ঘরটির একদিকে দেওয়াল জোড়া বইয়ের তাক, বিরাট বড় একটি পড়ার টেবিল, কাঠের চেয়ার। কালীকিঙ্করের শোয়ার ব্যবস্থা ছিল খুব সাধারণ। শুধু একটা চৌকি তার উপরে পাতলা গদি, কিন্তু পরিপাটি। কালীকিংকর নিজের হাতেই গোছাতেন ঘর। কিন্তু নিতির কাছে সবথেকে আশ্চর্য্য জায়গা ছিল কালীকিংকরের পূজার সিংহাসনটি। সেগুন কাঠের বিশাল সিংহাসনে মূর্তি শুধু একটিই।