লুডো-র ইতিবৃত্ত
গত বছর থেকে ‘ ঘরবন্দি ‘ জীবনের ক্লান্তি কাটাতে ছোট থেকে বড় সব মানুষের কাছে বোধহয় সেই শৈশবের দিনগুলো ফিরে এসে গেলো এক ঘরোয়া খেলায় — যা আমরা সবাই জানি , ছোট-বড় সকলের জনপ্রিয় ‘ লুডো ‘ বা ‘ লুডু ‘। দু’ ধরণের খেলা খেলতে সবাই ভালোবাসতো । লাল – নীল – হলদে – সবুজ ঘরের খেলা আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিলো ‘ সাপ-লুডো ‘ । ছোটবেলায় লুডো খেলা খেলেনি এমন বাঙালি পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। বাড়ির বয়স্ক মহিলাদের সাথে ছোটরাও মজে যেতো এই লুডো খেলায়। তবে লুডো-বোর্ডের পরের পাতাটিই থাকতো সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সাপ আর মইয়ের এই খেলা ছিল দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ। মই দিয়ে উপরের ধাপে উঠে যাওয়া, আবার অমনি সাপের মুখে পড়ে নিচে নেমে আসা- এমনই উত্তেজনা থাকতো এই খেলায়, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে খেলাটি কিন্তু আজকের নয়, ইতিহাসের অনেক পথ ঘুরে এই খেলাটি আজকের রূপ পেয়েছে। সাপ-লুডোর সেই অজানা ইতিহাস নিয়েই আজকের আলোচনা !
‘ সাপ – লুডো ‘ আজ এই ডিজিটাল যুগেও তার জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি ! ভারতে ও বাংলাদেশে অন্যতম বিনোদন হিসেবে এই খেলা ঘরের বিছানায় অথবা মাটিতে মাদুর পেতে যে কোন বয়সের বিশেষ করে কৈশোর অতিক্রান্ত ছেলেমেয়েরা এ খেলাটি খেলে অবসর সময় পার করে থাকে। এই খেলাটির সরঞ্জাম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন করা হয়। গ্রামের বিবাহিত মহিলারাও অবসর সময়ে এই খেলাটি খেলতে পছন্দ করে থাকে। তবে গত বছর থেকে প্রায় ঘরে ঘরে সব বয়সী মানুষের কাছে এই ‘লুডো’ এখন এক অবসর বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে গেছে । তাই আজ এ প্রসঙ্গে দু ‘চার কথা !
শোনা যায় , ‘ লুডো ‘ খেলার মধ্যে নাকি এক গভীর রহস্য লুকিয়ে রয়েছে — বলা হয় এই খেলা মূলত এক আধ্যাত্মিক খেলা ! জানা যায়, সাপলুডোর উৎস ভারতে এবং এর আসল উদ্দেশ্য ছিল খেলোয়াড়দের ‘মোক্ষ ‘ সম্পর্কে সচেতন করা ! বিশেষত শোনা যায় প্রাচীনকালেই এই ‘ সাপ লুডো ‘ খেলার আদি ভারতীয় নাম ছিলো ‘মোক্ষপট ‘ ! তাই সহজেই অনুমেয় যে প্রাচীন ভারতে এর জন্ম ! সাপ – লুডো খেলা আসলে মোক্ষের রাস্তা বাতলায়। এখানে ছক্কার দান-কে ‘কর্ম’ হিসেবে ধরতে হয়। সাপ আসলে ‘পাপ’ – এর প্রতীক। তার মুখে পড়লে পতন অনিবার্য। অপরদিকে অবশ্যম্ভাবী ভাবে ‘মই’-গুলি পুণ্যকর্মকে বোঝায় ! তাতে চড়লে মোক্ষের পথ সহজ হয়। আর অবিরত বারবার সাপ ও মইতে ওঠা-নামাকে ” জন্মান্তরচক্রের কথা ” বলে। কর্মফল অনুযায়ী উত্থান অথবা পতন নির্ধারিত হয়। ছকের চূড়ান্ত স্তরে রয়েছে ‘ মোক্ষ ‘ ! সেই ঘরের নম্বর ১০০ — যা আসলে পূর্ণতার প্রতীক, সমগ্রের প্রতীক ! এখানে পৌঁছাতে পারলে পুনর্জন্মচক্র থেকে মুক্তি মেলে। জাগতিক পাপ-পুণ্যের হিসেব থেকেও মুক্তি মেলে। আদিতে এই খেলায় সাপের মুখগুলিতে কোন কোন পাপের ফলে পতন ঘটছে, তাদের নামগুলি লেখা থাকতো। লেখা থাকত মইয়ের গায়ে পুণ্যকর্মগুলির নামও। ১৯০০ বছর আগেও ছিল এই সনাতন লুডো খেলা !
১৯৭৭ সালে দীপক সিংখাদা নামের এক যুবক শিকাগো শহরের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে বসে নেপাল এবং তিব্বতের বিভিন্ন ছবির সংগ্রহ তালিকা প্রস্তুত করছিলেন। এ সময় মিউজিয়ামের এক কোনে পড়ে থাকা এক অদ্ভুত ছবির ওপর তার দৃষ্টি চলে যায়। জাদুঘরের রেজিস্টারে ছবিটি নিয়ে শুধু বলা হয়েছে — ‘ রিলিজিয়াস ওয়ার্ক ’। ছবিটি এক ভারতীয় আর্ট ডিলারের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ছবিটি দেখে দীপক বেশ অবাকই হয়। কারণ ছবির মধ্যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহাদেবের উপস্থিতি। জাদুঘরে এ ধরনের বিষয় নিয়ে আর কোন ছবিই চোখে পড়েনি। নানা পুঁথিপত্র পড়ে দীপকের কাছে বিষয়টি কেবল ধর্মীয় বিষয় বলে মনে হলো না, কেবলই তার মনে হতে লাগলো এর সাথে অন্য কোনো বিষয় জড়িয়ে আছে। তিনি বুঝতে পারলেন, ছবিটি উত্তর ভারত থেকে সংগ্রহ করা হলেও এর মূল লুকিয়ে আছে নেপালে। তার এক পরিচিত অধ্যাপককে দীপক বিষয়টি জানালে তিনি জানিয়েছিলেন এ ধরণের একটি ছবি তিনি নেপালের জাদুঘরে দেখেছেন, তখন এই ছবির রহস্য উন্মোচনের জন্য দীপক রওনা হলেন নেপালে। নেপালে পৌঁছেই উপস্থিত হলেন নেপালের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে।
মিউজিয়ামের রেজিস্টার ঘাঁটতে শুরু করলেন যদি এই বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়। রেজিস্টারে শিকাগো মিউজিয়ামে দেখা এমনই এক ছবির কথা বলা আছে। জাদুঘর থেকে সে চিত্রকর্মটি বের করা হলো। নেপালের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে পাওয়া এই চিত্রপটের নাম দেখা গেলো ‘নাগপাশ’।
এই চিত্রকর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে দীপক দেখেন এটি কোনো ধর্মীয় বিষয় নয়। এটি একটি খেলার ছক। নেপালিরা শুদ্ধ করে এ খেলাকে ‘নাগপাশ’ বললেও মুখে তারা বলেন ‘ বৈকুন্ঠ খেল ’ যা আসলে আমাদের সেই পরিচিত খেলা ‘সাপ লুডো’। নেপালে পাওয়া নাগপাশের ছকেও রয়েছে এই সাপ। তবে নাগপাশে দুই ধরনের সাপ দেখতে পাওয়া যায়। লাল সাপ আর কালো সাপ। লাল সাপ হলো শুভ-লাভ এবং সৌভাগ্যের প্রতীক। অন্যদিকে কালো সাপ অশুভ এবং দুর্ভাগ্যের প্রতীক। নেপালি নাগপাশে লাল-সাপের লেজে গুটি পৌঁছতে পারলে খেলোয়াড়কে তা অনেক উঁচু জায়গায় পৌঁছে দেয়। আর কালো সাপের মাথায় গুটি পড়লে একেবারে লেজের শেষে নেমে যেতে হয়।
আমরা যে সাপ-লুডো খেলি, তাতেও সাপের ব্যবহার আছে। এখানেও গুটি সাপের মাথায় পড়লে সাপের লেজের শেষে নেমে যেতে হয়। তবে এখানে উপরে উঠার জন্য লাল সাপের পরিবর্তে মই ব্যবহার করা হয়। আর তাই লাল সাপগুলো এখানে অনুপস্থিত। তবে এখনকার সাপ-লুডোতে কোথাও মই, কোথাও তীর আবার কোথাও রকেটও ব্যবহার করা হচ্ছে।
শুধু মজা পাওয়ার জন্য আমরা যেমন সাপ-লুডো খেলি, নাগপাশ খেলার উদ্দেশ্য ছিল তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। নাগপাশ খেলার উদ্দেশ্য ছিল অনেক গভীর এবং তার সাথে কিছুটা ধর্মেরও যোগাযোগ আছে। প্রাচীনকালে এই খেলার মাধ্যমে একজন খেলোয়াড় তার কর্মফল পরিমাপ করতেন। ভালো কাজের ফল পুণ্য, মন্দ কাজের ফল পাপ। সেকালের মানুষরা বিশ্বাস করতো, মানুষের এই পাপ-পুণ্য বা শুভাশুভ ফল ভবিষ্যৎ জীবন এবং পরজন্মের জন্য সঞ্চিত হয়ে থাকে। তারা বিশ্বাস করতো, ভালো কাজ করলে ‘ স্বর্গ ‘ আর খারাপ কাজ করলে ‘ নরক ‘ ভোগ করতে হয়। এই হলো খেলার আধ্যাত্মিকতা !
অন্যদিকে পশ্চিমি ধারণা আবার অন্য ইতিহাসের কথা বলে । তাঁদের মতে ‘ লুডু ‘ শব্দটি আসলে একটি ল্যাটিন শব্দ। ল্যাটিন ‘ লদো ‘ শব্দ থেকে লুডু শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে — যার নিহিত অর্থ হচ্ছে ‘ আই প্লে মানে আমি খেলি ‘ ! লুডু একটি কৌশল বোর্ড খেলা যেখানে ২ থেকে ৪ জন খেলোয়াড় এক সাথে খেলতে পারে। অনেকে মনে করেন , হিন্দি ‘ পাচিসি ‘ বা বাংলা ‘ পাশা ‘ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে লুডু খেলার উৎপত্তি হয়। লুডু বা লুডো খেলার পদ্ধতি ও বৈচিত্র্য অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে এই খেলা বিভিন্ন নামে পরিচিত ।
২৪০০-২৫০০ খ্রিস্টপূর্ব সালের দিকে রাইন নদীর তীরে রোমান সৈন্যদের একটি ঘাটি ছিলো। সেইখানে ছক্কার সন্ধান পাওয়া যায় ২০১৬ সালে।
প্রাচীনকালে দণ্ড ডাইস দিয়ে ‘ পঁচিশি ‘ খেলা হতো, ১৮৯৬ সালে ইংল্যান্ডে লোকজন দণ্ড আকৃতির ডাইস বাদ দিয়ে ঘনাকৃতির পাশার প্রবর্তন ঘটায় সেখান থেকেই ‘ লুডু ‘ খেলার উৎপত্তি। এরপর ইংল্যান্ডের রয়েল ন্যাভি এটাকে বর্তমান রূপ উস্কার্স রুপের বোর্ডগেমে বা ছকের খেলায় রুপান্তরিত করে। এটাই বর্তমান লুডু খেলা। এমনও জানা যায় যে মুঘল সম্রাট আকবর নিজেও লুডু খেলেছেন ! লুডো খেলা সারা বিশ্বে চললেও আমাদের দেশের শহরে বা গ্রামেগঞ্জে সর্বোচ্চ জনপ্রিয় ‘লুডো’ খেলা। লুডো খেলায় ব্যবহৃত ” ছক্কা বা ডাইস ” এতো হাজার বছরেও তেমন পরিবর্তিত হয়নি। সম্প্রতি গবেষকরা রোমান সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শনের সঙ্গে লুডো খেলায় ব্যবহৃত ডাইস আবিষ্কার করেছেন। এই তথ্য এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিলো ” ফক্স নিউজ ” !
ডাইসের সাহায্যে দান ফেলে ঠিক করা হয়, কে আগে গন্তব্যে পৌঁছবে। ডাইসে ছয় বা ছক্কা পড়লে ( আবার কোথাও এক বা ‘ পুট ‘ পড়লে ) ঘুটি ঘর থেকে বের হতে পারে। প্রতিপক্ষের ঘুটিকে পেছন থেকে তাড়া করে কেটে দিতে হয় এবং সবার প্রথমে যে সবগুলো গুটি গন্তব্য স্থানে পৌঁছাতে পারে সেই খেলায় বিজয়ী হয়। লুডু খেলতে অনেক চালাক হতে হয় না, মোটামুটি বুদ্ধিমান হলেই লুডু খেলা যায়। তবে অনেকেই এই খেলায় বিশেষ চতুরতা দেখিয়ে জয়ী হতে খেলায় জিততে চায় ।
২৪০০ থেকে ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বের দিকে রাইন নদীর তীরে রোমান সেনাদের একটি ঘাঁটি ছিল এবং সেই এলাকায় অনুসন্ধানে চালিয়ে পুরনো আমলের সেই ডাইসের সন্ধান পাওয়া যায়। জানা যায়, আবিষ্কৃত এ ডাইসটি প্রায় ১৯০০ বছর আগে ব্যবহৃত হত।
সংস্কৃতির শহর ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে প্রায় ৩১ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান গার্নসহেইম থেকে ডাইসটি আবিষ্কৃত হয় এবং গবেষকরা জানায় যে এ ডাইসটি মোটামুটি খ্রিস্টীয় ১২০ সালের দিকে তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে রোমানরা এ এলাকায় বসতি স্থাপন করে বসবাস করা শুরু করে। এরপর ১৮০০ সাল থেকে এ স্থানটি রোমানদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত ছিল।
এ প্রসঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব ফ্রাঙ্কফুর্টের গবেষক ও খনন দলের প্রধান থামাস মউরর বলেন, আমরা এখন জানি, এখানে গ্রামীণ গুরুত্বপূর্ণ বসতি বা ভাইকাস প্রথম শতাব্দী থেকে গোড়াপত্তন শুরু করে এবং তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
গত ২০১৬ সালে এ এলাকায় খননের পর ডাইসটি পাওয়া যায় এবং এখানে একটি দুর্গের ভিত্তিও পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে মউরর আরও বলেন,
‘’ আমরা এখানে সত্যিকার প্রাচীন সম্পদ খুঁজে পেয়েছি, যেমন দুর্লভ হুক, কিছু মুক্তা, বোর্ড গেমের উপাদান ( ডাইস, খেলার উপকরণ ) ও হাড় দিয়ে তৈরি নারীমূর্তি। “
মজার ব্যাপার হলো , এত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির পরেও দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে লুডো খেলা বেশ জনপ্রিয়। আর তা খেলতে হলে প্রয়োজন হবে সেই বাপ – ঠাকুরদার আমলের সেই বোর্ড ও গুটি ! আর চুরি নিয়ে সেই ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ নিয়ে সেই মান – অভিমান ! বর্তমানে এই লকডাউন – এর সময়ে নতুন করে পরিবারের সকলেই একাকীত্ব কাটাবার জন্য এই লুডো খেলা ননতুন করে আবার ঘরে ঘরে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে । আবার অনেকে মুঠোফোনেও এক অন্যতম আকর্ষণীয় লুডো খেলা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে — যার নাম Ludo King। কুইক লুডো (Quick Ludo) ও সিক্স প্লেয়ার মোড (Six Player Mode) নামে দু’টি ফিচার আছে এই গেমে। এই নতুন ধরনের খেলায় আবার চারজনের জায়গায় ছয়জন মিলে একসঙ্গে খেলতে পারবেন। পাওয়া যাবে ভয়েস চ্যাটের সুবিধাও। একই সঙ্গে মাত্র পাঁচ মিনিটেই এক রাউন্ড লুডো খেলা হয়ে যাবে।
সে প্রসঙ্গ আপাতত থাক !
তবে আর দেরি কেন !! চলুন , এক দান হয়ে যাক !
ঋণ স্বীকার ~ ইতিবৃত্ত / ইন্টারনেট / প্রকাশ নাথ