মানুষ কিভাবে ছড়িয়ে পড়ল?
আধুনিক মানুষের বিশ্ব বিস্তার
হারারি তাঁর বিখ্যাত সেপিয়েন্স বইতে বলছেন – প্রথম যখন হোমো সেপিয়েন্সরা আফ্রিকা থেকে ইউরেশিয়ার দিকে আসার চেষ্টা করে, তখন মানজাতির আরেক প্রজাতি নিয়ান্ডার্থালদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়। নিয়ান্ডার্থালরা সম্ভবত জ্ঞাতি সেপিয়েন্সদের সে যাত্রায় হঠিয়ে দিয়েছিল। সেটা প্রায় এক লক্ষ সত্তর হাজার বছর আগের ঘটনা।
এর প্রায় এক লক্ষ বছর পর পরবর্তী প্রচেষ্টায় হোমো সেপিয়েন্সরা এই লড়াইতে বিজয়ী হয়। এই দুই লড়াইয়ের পার্থক্য কী ছিল ? কোন অস্ত্রে পরের লড়াইতে সেপিয়েন্সরা জিততে পারল ?
হারারি ইঙ্গিত করেছেন যে এই অস্ত্রটা ছিল ভাষাবিপ্লব। সেপিয়েন্স পৃথিবীর প্রথম প্রাণী হিসেবে এক বিশেষ অর্থে ততদিনে ভাষা শিখেছে আর এই ভাষাবিপ্লবের মধ্যে দিয়ে বড়সড় সামাজিক সংগঠন তৈরি করার কৌশলও ততদিনে সেপিয়েন্স এর রপ্ত হয়েছে। ভাষা শুধু সেপিয়েন্সকে তথ্য আদান প্রদান করতেই শেখায় নি। কাল্পনিক রেস এর ধারণাতে উন্নীত হতে সাহায্য করেছিল। এই ধারণা-জগত একধরনের বিশেষ বস্তুগত শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, অনেকটা আজকের দিনের জাতিয়তাবাদের সাথে তার তুলনা করা যায়। আর এর সাহায্যেই শারীরিকভাবে অনেক শক্তিশালী নিয়ান্ডার্থালদের সে হারাতে পারল।
হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের যাত্রাপথটা শুরু হয়েছিল আফ্রিকা থেকে। প্রথমদিকে অনেক বছর হোমো সেপিয়েন্স আফ্রিকাতেই “লক ডাউন” ছিল। হোমো সেপিয়েন্স এর উদ্ভব দু লক্ষ বছর আগে বলে ধরা হয়। আর্কেকিক হোমো সেপিয়েন্স এর উদ্ভব তিন লক্ষ বছর আগে বলেও কেউ কেক মনে করেন। পূর্ব আফ্রিকা থেকে আরব হয়ে এশিয়ার দিকে হোমো সেপিয়েন্স এর বিস্তার হয় সৌদি আরবের মধ্যে দিয়ে, আজ থেকে প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে। সৌদি থেকে ভারতের পশ্চিমে গুজরাট এলাকায় তারা আসে। পশ্চিম উপকুল করে দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা অবধি এসে আবার উত্তরে যেতে থাকে তারা পূর্ব উপকুল ধরে। এরপর বাংলা অবধি এসে তারা বাঁক নেয়। ঘটনাগুলি অবশ্যই কয়েক হাজার বছর ধরে ঘটছিল। ব্রহ্মদেশ, লাওস, ভিয়েতনাম সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে দিয়ে ইন্দোনেশিয়া হয়ে তারা পৌঁছায় অস্ট্রেলিয়ায়। হোমো সেপিয়েন্স অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছোয় আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছর আগে।
গুজরাট অঞ্চল থেকে কয়েকটি দল যেমন ভারতের পশ্চিম উপকুল ধরে এই অভিযাত্রায় সামিল হয়, অন্য কয়েকটি দল আবার গুজরাট অঞ্চল থেকে উত্তরাভিমুখে যাত্রা করে। এর মধ্যে কয়েকটি দল উত্তরে চলতে চলতে চিন ও রাশিয়ায় গিয়ে পৌঁছায়। কয়েকটি দল আবার পশ্চিমে বাঁক নেয় এবং পূর্ব ইউরোপ হয়ে পশ্চিম ইউরোপের দিকে এগোতে থাকে। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে হোমো সেপিয়েন্সরা ইউরোপে পৌঁছায়। এর এক লক্ষ বছর আগে তাদের প্রথম অভিযাত্রা প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল এবং নিয়ান্ডার্থালদের কাছে তারা লড়াইতে হেরে গিয়েছিল। এইবার উল্টো ঘটনা ঘটে। তারা নিয়ান্ডার্থালদের হারিয়ে দেয়। আজ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগে হোমো নিয়ান্ডার্থালরা বিলুপ্তই হয়ে যায়।
আফ্রিকা থেকে আরো কয়েকটি দলের অভিযাত্রা প্রথম থেকেই অন্য পথে হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেছেন। তারা ভারতের দিকে না এসে সরাসরি তুরষ্কের মধ্যে দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করে।
মানুষের বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে দীর্ঘদিন ধরেই “ফেলো ফিলিং” খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু এই ফেলো ফিলিং এর ব্যাপারটি সরল একরৈখিক নয়। যেহেতু তা একটি নির্মিত আখ্যান, তাই তাকে নানাভাবে পাল্টানো যায়, রদবদল করা যায়। ইতিহাসে আমরা বারবার তার সাক্ষ্য পেয়েছি। কে কার ফেলো, কে কার শত্রু – এই নির্মাণ মানুষের ইতিহাসের অন্যতম নির্ণায়ক ব্যাপার।
বিভিন্ন মানব প্রজাতির মধ্যে কি যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল? জিন সংকর কি ঘটেছিল? এর নিশ্চিত কোনও উত্তর দেওয়া কঠিন।
সেপিয়েন্স যখন মধ্য প্রাচ্যে আসে তখন ইউরেশিয়ার বেশির ভাগ এলাকা অন্যান্য প্রজাতির মানুষে ভরপুর। পরবর্তী সময়ে কোথায় হারালো মানুষের অন্যান্য প্রজাতির সদস্যরা? এ ব্যাপারে দুটো পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব আছে। তার একটা হলো সঙ্কর প্রজনন (Interbreeding) তত্ত্ব। এই তত্ত্ব নিজের প্রজাতির সদস্য এবং অন্য প্রজাতির সদস্যদের সাথে একটি প্রাণীর প্রজনন সম্বন্ধে আলোচনা করে। এ তত্ত্ব অনুসারে, আফ্রিকার মানুষ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে এক প্রজাতির মানুষ আরেক প্রজাতির মানুষের সাথে প্রজননে লিপ্ত হয়। আর আজকের আধুনিক মানুষ এই সঙ্কর প্রজননের ফলাফল।
সঙ্কর প্রজনন তত্ত্ব বলে, যখন সেপিয়েন্স নিয়ান্ডার্থালদের এলাকায়, মানে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ল তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটল। সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থালেরা মিলে সন্তান উৎপাদন শুরু করল। এভাবে দুটি প্রজাতি মিলে মিশে একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত হলো।
এই তত্ত্বের বিপরীতে আরেকটা তত্ত্ব আছে যেটার নাম প্রতিস্থাপন তত্ত্ব বা Replacement Theory। এই প্রতিস্থাপন তত্ত্ব পুরো বিপরীত ধরনের একটি গল্প বলে আমাদের। এ গল্প অসহিষ্ণুতার, এ গল্প ঘৃণার এবং সম্ভবত গণহত্যারও।
প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী সেপিয়েন্সের সাথে অন্য কোন প্রজাতির মানুষের, নিয়ান্ডার্থাল বা ইরেক্টাস কারো সাথে কোনো প্রকার যৌন সম্বন্ধ সংঘটিত হয়নি। সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থালদের দেহের গঠন ভিন্ন ছিল এবং তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা যৌনমিলন প্রক্রিয়া ছিল। এমনকি তাদের শরীরের গন্ধও ভিন্ন ভিন্ন ছিল। অন্য কোন প্রজাতির সাথে যৌন মিলনে আবদ্ধ হওয়ার প্রতি তাদের খুব কমই আগ্রহ ছিল। যদি কোন নিয়ান্ডার্থাল রোমিও সেপিয়েন্স জুলিয়েটের প্রেমে পড়েও এবং তাদের যদি কোনো সন্তানও হয়- প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী এ শিশুটি হবে বন্ধ্যা (Infertile)। ঠিক যেভাবে গাধা এবং ঘোড়া মিলিত হতে পারে, কিন্তু তারা শুধু প্রজনন-অক্ষম খচ্চরেরই জন্ম দিতে পারে। একইভাবে নিয়ান্ডার্থাল রোমিও এবং সেপিয়েন্স জুলিয়েট কেবল প্রজনন-অক্ষম সঙ্কর প্রজাতিরই সৃষ্টি করতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিস্থাপন তত্ত্ব বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর পক্ষে জোরালো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মিলেছে আর এই তত্ত্ব রাজনৈতিক দিক থেকে অধিক উপযোগী (আর বিজ্ঞানীরাও আধুনিক মানুষের জিনের ভিন্নতা দেখিয়ে সাম্প্রদায়িক কলহ তৈরি করতে চাননি)। কিন্তু ২০১০ সালে তা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। চার বছর চেষ্টার পর নিয়ান্ডার্থাল জিনোম (Genome) প্রকাশের ফলে তা আর চাপা থাকেনি। জিন-বিশেষজ্ঞরা ফসিল থেকে যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ান্ডার্থাল মানুষের ডিএনএ সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছেন। এই ডিএনএর সাথে সমকালীন মানুষের ডিএনএ তুলনা করে যে ফলাফল পাওয়া গেলো তা চমকে দেওয়ার মতো।
সমীক্ষায় দেখা গেলো, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বর্তমান মানুষের ১ থেকে ৪ শতাংশ মৌলিক ডিএনএ হলো নিয়ান্ডারর্থাল ডিএনএ। মিলের পরিমাণটা খুব বেশি না হলেও একেবারে অগ্রাহ্য করার মতো নয়। কয়েক মাস পর আরও বড় একটি চমক আসে। ডেনিসোভা গুহায় প্রাপ্ত জীবাশ্মে রূপান্তরিত মানুষের আঙুলের ডিএনএ মানচিত্র তৈরী করা হয়। ফলাফলে দেখা গেলো, আধুনিক মেলানেসিয়ান এবং অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ডিএনএর সাথে ডেনিসোভা মানবের ডিএনএ প্রায় ৬ শতাংশ মিলে যায়।
তবে এখনই কোনো উপসংহার না টানাই উচিত, কারণ এ গবেষণা এখনও শেষ হয়নি, শেষ পর্যন্তু এই ফলাফল নাও টিকতে পারে। যদি এই ফলাফলগুলোই টিকে থাকে, তবে সঙ্কর প্রজনন তত্ত্বের সমর্থকদের দাবি আরেকটু জোরালো হবে। তাই বলে প্রতিস্থাপন তত্ত্বকে একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। আজকের মানুষের জিনে নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভা মানুষের জিনের পরিমাণ খুবই অল্প, তা থেকে বোঝা যায় সেপিয়েন্সদের সাথে অন্যান্য মানব প্রজাতিগুলোর ‘মিশে যাওয়ার’ সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সেপিয়েন্সদের সাথে মানুষের অন্যান্য প্রজাতির জিনের পার্থক্য এত বেশি ছিল না যাতে তাদের সন্তান জন্মদান ব্যাহত হয়, কিন্তু তারপরেও এমন ঘটনা ছিল বিরল।